ধরা পড়ল কিমের ফাঁকিবাজি

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Oct 12, 2020 03:14 pm
ধরা পড়ল কিমের ফাঁকিবাজি

ধরা পড়ল কিমের ফাঁকিবাজি - ছবি সংগৃহীত

 

উত্তর কোরিয়ার ওপর অনেক রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপিত থাকলেও তারা কীভাবে আন্তর্জাতিক আইন ফাঁকি দিচ্ছে, অস্ত্র বিক্রি করছে - তা বের হয়ে এসেছে এক নতুন প্রামাণ্যচিত্রে।

'দি মোল' নামের এই ছবিটি মূলত একটি "স্টিং অপারেশন" বা ছদ্মবেশী প্রামাণ্য চিত্রকারের কাজ। এর ড্যানিশ পরিচালক ম্যাডস ব্রুগার বলছেন, এই জটিল স্টিং অপারেশনের জাল বিছাতে তাকে অনেক বছর ধরে কাজ করতে হয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর উচ্চাভিলাষের কারণে ২০০৬ সাল থেকেই জাতিসঙ্ঘ দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

জাতিসঙ্ঘের একটি বিশেষজ্ঞ দল ২০১০ সাল থেকে নজর রাখছে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র কর্মসূচির অগ্রগতি ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর। তারা এ বিষয়ে নিয়মিত রিপোর্টও দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রামাণ্যচিত্রে যা দেখা যাচ্ছে, তা সত্যি নজিরবিহীন।

এতে দেখা যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তারা ক্যামেরার সামনে আলোচনা করছেন, কীভাবে অস্ত্র রফতানি করার ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞাগুলোকে এড়ানো যায়।

ছবিটিতে একটি মুহূর্ত আছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে দেখা যাচ্ছে, জেমস নামধারী একজন ছদ্মবেশী "অস্ত্র ব্যবসায়ী" এবং উত্তর কোরিয়ার একটি অস্ত্র কারখানার প্রতিনিধি একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন।

এই 'চুক্তি স্বাক্ষর'-এর দৃশ্য ভিডিও করছেন প্রামাণ্যচিত্রটির মূল চরিত্র, এবং সেখানে উত্তর কোরিয়ার কিছু সরকারি কর্মকর্তাও উপস্থিত রয়েছেন।

ঘটনাটা ঘটেছে পিয়ংইয়ং-এর শহরতলীতে, একটি চটকদার রেস্তোরাঁর বেজমেন্টে।

এগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য?
প্রশ্ন হলো, ছবিটিতে যা দেখানো হয়েছে, তা কি সত্যি হতে পারে?

উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ একজন সাবেক জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, তার মনে হয়েছে এটা "অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য।"

এই ছবিটি নির্মিত হয়েছে বিবিসি এবং কয়েকটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সম্প্রচার কোম্পানির যৌথ প্রযোজনায়।

প্রামাণ্যচিত্রটি একই সাথে মজার, বিদঘুটে ও একেক সময় অবিশ্বাস্য।

ব্রুগার নিজেই এ ছবিতে এক জায়গায় বলেছেন, আমি এমন একজন ফিল্মমেকার যে সবসময় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে চায়।

উত্তর কোরিয়া বিষয়ে ২০১৪-১৯ সালে জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের যে প্যানেল ছিল, তার সমন্বয়কারী হচ্ছেন হিউ গ্রিফিথ।

তিনি বলছেন, এ ছবিতে যা উদঘাটিত হয়েছে তা "অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য।"

"চেয়ারম্যান কিম জং উনকে লজ্জায় ফেলতে পারে এমন যত কিছু আমরা আগে দেখেছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে গুরুতর। এ ছবিতে এমন অনেক কিছু আছে, যা আমরা ইতিমধ্যেই যা জানি তার সাথে মিলে যায়।"

বিচিত্র সব চরিত্র
প্রামাণ্যচিত্রটিতে আছে বিচিত্র কিছু চরিত্র ।

একজন হলেন বেকার ড্যানিশ শেফ বা রাঁধুনি - যিনি কমিউনিস্ট একনায়কদের সম্পর্কে ভীষণ আগ্রহী। একজন স্প্যানিশ অভিজাত ব্যক্তি, যিনি উত্তর কোরিয়া বিষয়ে প্রচারণার সাথে জড়িত - এবং তার আগ্রহের বিষয় হলো সামরিক বাহিনীর পোশাক। আরেক জন সাবেক ফরাসী সৈন্য এবং দাগী কোকেন বিক্রেতা - যিনি একজন রহস্যময় 'আন্তর্জাতিক' ব্যক্তি।

বেকার রাঁধুনীটি হচ্ছেন উলরিখ লারসেন। তিনি ব্রুগারের সাহায্য নিয়ে কোরিয়ান ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন (কেএফএ) নামে একটি স্পেন-ভিত্তিক সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেন - যা উত্তর কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর সমর্থক।

লারসেন ধীরে ধীরে এ সংগঠনের ওপরের কাতারের নেতা বনে যান এবং শেষ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের 'আস্থা' অর্জন করেন।

এই কেএফএ-র সদস্য হবার সূত্রেই তার সাথে যোগাযোগ হয় আলেইয়ান্দ্রো কাও দে বেনোসের সাথে। ইনি হচ্ছেন একজন স্প্যানিশ অভিজাত ব্যক্তি, যাকে সারা দুনিয়া চেনে "উত্তর কোরিয়ার দ্বাররক্ষী" হিসেবে।

এই লোকটিকে কখনো কখনো ছবিতে দেখা যায় উত্তর কোরিয়ার সামরিক পোশাক পরে থাকতে।

প্রামাণ্যচিত্রে তিনি গর্বের সাথেই বলেন, পিয়ংইয়ং-এর শাসকগোষ্ঠীর ভেতরে তার পরিচিতি এবং প্রভাব কতটা আছে।

এর পরে আছেন জিম লাত্রাশ-কুভোরট্রাপ। তাকে বর্ণনা করা হয় ফ্রান্সের একজন সাবেক লেজিওনেয়ার বা সৈনিক হিসেবে। তিনি কোকেন নামের মাদক বেচাকেনার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। প্রামাণ্যচিত্রে তাকে নিয়ে আসা হয় দামী স্যুট পরে একজন আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ীর ভূমিকায় 'অভিনয়' করতে।

এর পরে আছেন ব্রুগার নিজে। তিনি নিজেকে বলেন পাপেট মাস্টার, এবং দাবি করেন যে তিনি এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ১০ বছর ধরে কাজ করছেন।

ভুয়া কোম্পানির সাথে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি
ওই চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে যে নর্থ কোরিয়ানরা আছেন, তাদের সবাইকে ঠিকমত শনাক্ত করা যায়নি।

লাত্রাশ-কুভোরট্রাপ বলছেন, কোরিয়ার কর্মকর্তারা যখন তাকে নানাভাবে জেরা করছিলেন, তখন তাকে একটা কোম্পানির নাম বানিয়ে বলতে হয়েছিল। এখন ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয় যে তারা এমন একটা প্রাথমিক তথ্য আগে থেকে ভেবে রাখেননি।

তার ওপর এটাও বিশ্বাস করা কঠিন যে কোরিয়ান কর্মকর্তারা এমন একটা বৈঠক এবং দলিলপত্র স্বাক্ষর করা ফিল্মে ধরে রাখার অনুমোদন দিয়েছিলেন।

দলিলে স্বাক্ষর রয়েছে যার, তিনি হলেন কিম রিয়ং-চল। তিনি হচ্ছেন নারে ট্রেডিং অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট। কোরিয়ায় এটি একটি খুবই সাধারণ নাম। কিন্তু জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে একই নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কথা আছে।

২০২০ সালের অগাস্টের ২৮ তারিখের ওই দলিলে বলা হয়, কোরিয়া নারে ট্রেডিং করপোরেশন নামে একটি কোম্পানি নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর নানা কর্মকান্ডে জড়িত আছে - যার উদ্দেশ্য উত্তর কোরিয়ার নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের সমর্থনে অর্থ আয় করা।

'আপনি কি সিরিয়ায় অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবেন?'

সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা গ্রিফিথ বলছেন, এটা একটা লক্ষণীয় ব্যাপার যে একজন ব্যবসায়ীর সম্পর্কে ওই কোরিয়ানরা কিছুই না জানলেও তার সাথে অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে চুক্তি করতে আপত্তি করছেন না।

"এতে বোঝা যায়, জাতিসঙ্ঘ নিষেধাজ্ঞায় কাজ হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ানরা তাদের অস্ত্র বিক্রি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে", বলেন তিনি।

ছবিটির একপর্যায়ে ২০১৭ সালে কাম্পালায় অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক দেখানো হয়।

এতে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র ব্যবসায়ী বলে কথিত "মি. ড্যানি" লাত্রাশ-কুভোট্রাপকে জিজ্ঞেস করতে দেখা যায় যে তিনি সিরিয়ায় উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবেন কি-না।

গ্রিফিথস বলেন, এ প্রশ্ন থেকে বোঝা যায় উত্তর কোরিয়া নিজে থেকে এসব কাজ করার ক্ষেত্রে অসুবিধার মধ্যে রয়েছে।

অবকাশকেন্দ্রের মাটির নিচে অস্ত্র-মাদকের কারখানা?
জেমসকে দেখা যায় যে তিনি উগান্ডায় গেছেন এবং তার সাথে পিয়ংইয়ং-এ যে উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের দেখা গিয়েছিল, তারাও আছেন। তারা লেক ভিক্টোরিয়ায় একটি দ্বীপ কিনে সেখানে একটি বিলাসবহুল অবকাশকেন্দ্র বানাতে চান।

উগান্ডার কর্মকর্তাদের কাছে এ উদ্দেশ্যের কথা বললেও কোরিয়ানরা গোপনে পরিকল্পনা করছেন, সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ কারখানা তৈরি হবে - যাতে উৎপাদিত হবে অস্ত্র ও মাদক।

শুনলে যতই কল্পকথার মত মনে হোক, উত্তর কোরিয়া এমন কাজ আগেও করেছে। নামিবিয়ার লেপার্ড ভ্যালিতে একটি পরিত্যক্ত তামার খনিতে একটি গোলাবারুদ তৈরির কারখানা বানিয়েছিল উত্তর কোরিয়ার শাসকচক্র ।

কোরিয়া মাইনিং ডেভেলপমেন্ট ট্রেডিং কর্পোরেশন বা কোমিড নামে সংস্থাটির কার্যকলাপ তদন্ত করেছিল জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞরা ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত।

পরে নামিবিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করে জাতিসংঘ, এবং হয়ত সে কারণেই উত্তর কোরিয়ানরা উগান্ডার দিকে দৃষ্টি ফেরায়, বলেন গ্রিফিথ।

এই কর্মকর্তা বলছেন, "নামিবিয়ায় উত্তর কোরিয়ার প্রকল্পগুলো কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, এবং ২০১৮ সাল নাগাদ উগান্ডা ছিল হাতেগোনা কয়েকটি আফ্রিকান দেশের একটি - যেখানে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রের দালালেরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারতো।"

'দূতাবাস কিছু জানে না'
ডকুমেন্টারিটিতে আরেকটি জিনিস উঠে এসেছে। তাহলো, নর্থ কোরিয়ান কূটনীতিকরা দৃশ্যত বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে বসে জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের প্রয়াসে সহযোগিতা করছেন।

একটি দৃশ্যে দেখা যায়, উলরিখ লারসেন স্টকহোমে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসে গিয়েছেন। সেখানে মি. রি নামে একজন কূটনীতিকের কাছ থেকে একটি খাম পান, যাতে উগান্ডা প্রকল্পের পরিকল্পনার কাগজপত্র আছে।

লারসেন গোপনে এই সাক্ষাতের চিত্র ধারণ করেন।

তিনি যখন দূতাবাস থেকে বিদায় নিচ্ছেন তখন রি তাকে গোপনীয়তার ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন।

"যদি কিছু ঘটে যায়, তাহলে কিন্তু দূতাবাস বলবে আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। ঠিক আছে?"

গ্রিফিথস বলছেন, এ দৃশ্যটিও বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

তিনি বলেন, "জাতিসংঘের প্যানেলের তদন্তে দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করা বা ভাঙার চেষ্টার সথে জড়িত আছে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক অফিসগুলো বা সে দেশের পাসপোর্টধারীরা।"

যেসব চুক্তি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটিতে আলোচনা হয়, তার কোনোটিই বাস্তবে রূপ পায়নি।

চুক্তির অংশীদারেরা এক পর্যায়ে অর্থ দাবি করতে শুরু করলে জেমসকে 'উধাও' করে দেন পরিচালক ব্রুগার।

চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, তাদের সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো স্টকহোমের উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসে উপস্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু কোন জবাব আসেনি।

কেএফএ-র প্রতিষ্ঠাতা কাও দে বেনোস বলেছেন যে তিনি ভান করছিলেন, এবং চলচ্চিত্রটি পক্ষপাতদুষ্ট, সাজানো এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা।

সূত্র : বিবিসি

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us