‘সৌদি ক্ষমতা এখন পতনমুখী; এমনকি ইসরাইলও তা ঠেখাতে পারবে না’
প্রিন্স মোহাম্মদ ও বাদশাহ সালমান - ছবি : সংগৃহীত
মারওয়ান বিশারা। আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এর আগে ছিলেন প্যারিসের অ্যামেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক। বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে হাত খুলে লেখালেখি করেন। তবে সুপরিচিত মধ্যপ্রাচ্যবিশ্লেষক হিসেবে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে এক বিশ্লেষণে মন্তব্য করেছেন- ‘সৌদি ক্ষমতা এখন পতনমুখী; এমনকি ইসরাইলও তা ঠেখাতে পারবে না’।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য বিভিন্ন মহল থেকে আসছে। এসব মন্তব্য একেবারে অমূলক তা বলা যাবে না। কারণ, সৌদি কিংডম প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্ধ শতাব্দীর ধরে যে সৌদি আরবকে ওপেক ও ওআইসির নেতৃস্থানীয় হিসেবে দেখে আসছি আমরা, তা যেন এখন ক্রমেই ম্লান ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মহলে সৌদি আরবের দীর্ঘকালের পরিচয় ‘হোম অব ইসলাম’ নামে। দেশটিতে রয়েছে ইসলামের পরিত্র স্থান আল্লাহর ঘর মসজিদুল হারাম । অন্যদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলের মজুদ রয়েছে দেশটিতে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় ভ্রান্তনীতি রিয়াদকে ক্রমেই হীনবল করছে। দেশটির প্রভাব প্রতিপত্তি উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যে পরতির দিকে। প্রশ্ন উঠছে, মসজিদুল হারাম নিয়ন্ত্রণে সৌদি আরবের কর্তৃত্বপরায়ন ভূমিকা নিয়েও।
বিশেষ করে বিগত পাঁচটি বছর ছিল সৌদি আরবের জন্য বেদনাদায়ক ও ধ্বংসাত্মক। মোহাম্মদ বিন সালমান যেসব প্রতিশ্রুতিশীল ও উচ্চাভিলাসী উদ্যোগের সূচনা করেন, অল্প সময়েই তা রূপ নিয়েছে বেপরোয়া, অসংযত ও অপরিণামদর্শী হিসেবে। তিনি প্রাথমিকভাবে চলেছেন তার মেন্টর ইউনাইটেড আরব আমিরাতের প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের দেখানো পথে। আসলে মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি কিংডমকে দুর্বল করার কাজটিই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হয়। লিবিয়া ও তিউনিশিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং মিসরের আবদেল ফাতেহ সিসি ও সিরিয়ার বাশার আল আসাদের মতো স্বৈরশাসককে সমর্থন করা ছিল সৌদি আরবের বড় ভুল।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় মিসরের প্যান-আরব প্রজেক্টের পতন ও ১৯৭০ সালে এর নেতা জামাল আবদুুন নাসেরের ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের উত্থান পরিলক্ষিত হয়। ওপেকের নেতৃস্থানীয় সদস্য দেশ হিসেবে সৌদি আরব ১৯৭০ সালে আয়োজন করে ওআইসির প্রথম সভা; আরব লিগের বাইরেও এর ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করে তোলার মানসে। তখন আরব লিগে প্রভাবশালী ছিল সোভিয়েতবান্ধব সেক্যুলার সরকারগুলো- বিশেষত মিসর, ইরাক ও সিরিয়া। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে ওপেকের বয়কটের পর সৌদি আরব তেল ব্যবসায়ের বিস্ফোরণসূত্রে আরো ধনী হয়ে ওঠে। তখন সৌদি আরব পেট্রোডলার কূটনীতি ও প্রভাব বিস্তারের পেছনে অর্থব্যয় করতে শুরু করে। এই দশকের শেষ দিকে ইসরাইলের সাথে মিসরের শান্তিচুক্তির সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে সৌদি আরবের উত্থান নিশ্চিত করে।
১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং একই বছরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ রিয়াদকে তুলে আনে মুসলিম জাহানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত মিত্র হিসেবে। সৌদি আরবের আঞ্চলিক অবস্থান আরো জোরদার হয়ে ওঠে গত শতকের আশির দশকে যখন ইরাক-ইরান আট বছরব্যাপী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সৌদি-ইউএস মিত্রতা নতুন উচ্চতায় ওঠে আশির দশকেই। তখন রিয়াদ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর মিত্রদের বিরুদ্ধে গিয়ে সমর্থন জানায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি। বিশেষ করে সৌদি আরব তখন গোপনে সফলভাবে সহায়তা করে আফগান মুজাহিদদের। এর অবসান ঘটে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে।
অবশ্য সাদ্দাম হোসেন একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরাককে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু ওই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। ইস্টার্ন ব্লক ভেঙে পড়ার পর ¯œায়ুযুদ্ধে আমেরিকার সিদ্ধান্তসূচক বিজয় ঘটে এবং কুয়েতে ইরাকের অনুপ্রবেশের পর ইরান ও ইরাকবিরোধী সৌদি আরব কন্টেইনমেন্ট ডিপ্লোম্যাসিতে সফল হয়। এতে রিয়াদের আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়।
১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র মাদ্রিদে আয়োজন করে প্রথম আন্তর্জাতিক আরব-ইসরাইল ‘শান্তি সম্মেলন’। সেখানে সৌদি আরবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পিএলওকে এর বাইরে রাখা হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে আরব দুনিয়ার ব্যর্থতাই তখন কোনো না কোনোভাবে সৌদি আরবের জন্য সফলতা এনে দেয়, তা আপনাআপনিই আসুক কিংবা পরিকল্পনা করেই তা আনা হোক।
সৌদি-মার্কিন হানিমুনের অবসান ঘটে ২০০১ সালে আল কায়েদার কথিত নাইন-ইলেভেনের নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলার সাথে সাথে। এর এক দশক আগে আল কায়েদার সৌদি নেতা ওসামা বিন লাদেনকে সৌদ আরব দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিল সত্য, তবে এই হামলায় অভিযুক্ত ১৫ থেকে ১৯ জন হাইজ্যাকারই ছিল সৌদির লোক। তবে রিয়াদ ঘটনাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফের সম্পর্ক ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বুশ প্রশাসন যখন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ আফগানিস্তানে সম্প্রসারণের সিন্ধান্ত নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে আবারো অপরিহার্য মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে। ২০০২ সালে মার্কিন প্রেসিডেট জুনিয়র বুশ টেক্সাসে নিজের ব্যক্তিগত খামারবাড়িতে সাদর অভ্যর্থনা জানান ডি ফ্যাক্টো সৌদি লিডার ক্রাউন প্রিন্স আবদুল্লাহকে। এটি যেকোনো বিদেশী নেতার জন্য একটি অগ্রাধিকারমূলক সুযোগ। এর এক মাস আগে আবদুল্লøাহ ছিলেন আরব লিগকে বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে তারই বানানো ‘পিস ইনিশিয়েটিভ’ গ্রহণের পেছনের নিয়ামক। এ উদ্যোগে মূলত ছিল ইসরাইলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘ল্যান্ড ফর পিস ফরমুলা’র প্রতিশ্রুতি। এর এক বছর পর দুষ্কর্মের সহায়ক সৌদি আরব দেখল বাগদাদের কাছে বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে অনুপ্রবেশ করে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এর পর থেকে সৌদি আরবের ভাগ্যবিড়ম্বনার শুরু। সৌদি আরবের ক্ষমতার পতনের সূচনা সেখান থেকেই।
সৌদি আরব ক্রমেই ভঙ্গুর হতে থাকে। কারণ এর এতদিনের পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ সালে এ অঞ্চল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন শিলাতেলের বিপ্লবের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তেল উৎপাদনকারী দেশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ হারায় সৌদি আরব ও উপসাগলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে। এ অঞ্চলের ধনী দেশগুলোতে সামরিক হস্তক্ষেপেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র, এমনটি ঘটল যখন ইরান এ অঞ্চলে প্রভাব বাড়তে শুরু করে। যখন তাও পর্যাপ্ত মনে হলো না, তখন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে সম্পাদন করে পারমাণবিক চুক্তি। ফলে ইরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দুয়ার খুলে যায়। এতে করে তেহেরান আরো সাহসী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সৌদি আরবের হতাশা বেড়ে যায়।
এদিকে ২০১১ সালের দিকে গোটা অঞ্চলজুড়ে ‘আরব আপরাইজিং’ শুরু হলে সৗদি আরব ও এর স্যাটেলাইট অথোরিটারিয়ান দেশগুলো শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ওবামা প্রশাসনের গণতান্ত্রিক সংস্কার ও সরকার পাল্টানোর প্রতি প্রাথমিক সমর্থন সৌদি সরকারের বিষয়াবলিকে আরো জটিল করে তোলে। বাদশা আবদুল্লøাহর ইন্তেকালের পর বাদশা সালমান ও তার উচ্চাভিলাসী পুত্র মোহাম্মদের নেতৃত্বে সৌদি মনার্কি আগ্রাসী হয়ে ওঠে। নয়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হয় যুবরাজকে।
সৌদি আরব আবারো বড়ত্ব জাহিরের প্রয়াসে আমিরাতি মেন্টর বিন জায়েদের পরামর্শে প্রণোদিত হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান কালক্ষেপণ না করেই ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু করেন হুতিদের দমনে। কারণ, সৌদি আরব মনে করে হুতিরা ইরানের মিত্র। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এ যুদ্ধে বিজয়ী হবেন তারা। কিন্তু সে যুদ্ধ কয়েক বছরেও শেষ হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ২০১৭ সালের জুনে মোহাম্মদ বিন সালমান ও মোহাম্মদ বিন জায়েদ সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতার মিথ্যা অজুহাতে প্রতিবেশী কাতারের সাথে সৃষ্টি করে আরেক সঙ্কটের। সেখানে সৌদি আরব হস্তক্ষেপ করে এমন একটি সরকার গঠনের; যা রিয়াদের নির্দেশে চলবে। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের ব্যাপারে এর প্রাথমিক সমর্থন পাল্টে দেয়। আর আগে থেকে ভাবা দ্রুত বিজয়ের এই পরিকল্পনা উপসাগরীয় ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে, এই ঐক্য ফিরিয়ে আনা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
২০১৭ সালের নভেম্বরে মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরব ও লেবাননি দ্বৈত নাগরিক ও লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে প্রলুব্ধ করে তাকে বাধ্য করেন তার কোয়ালিশন পার্টনার ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহকে নিন্দা জানাতে এবং সৌদি টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পদত্যাগ করতে। এ উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের বিরুদ্ধেই যায়; বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যাবতীয় ব্যর্থতা কাঁধে নিয়েই ২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমান হন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স। এর পর পরই তিনি দেশটিতে হয়ে ওঠেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার পরিবারের অনেক ‘সন্দেহভাজন’ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাকে শুদ্ধি অভিযানের নামে কারাগারে পাঠানো হয়। অনেকে হন নিপীড়নের শিকার।
এর পর থেকে সেখানে সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। এদের মধ্যে আছেন- সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যা ও লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলার ভয়াবহ ঘটনার অভিযোগ। এভাবে বাদশাহ সালমান ক্ষমতার আসা ও তার পুত্রকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা করার কয় বছরের মধ্যেই বিশ্বজনমত চলে যেতে থাকে সৌদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের দুর্র্বিনীত অভিযান তার ক্ষমতাকে সুসংহত করার পরিবর্তে সৌদি কিংডমকে আরো দুর্বল করে তোলে। ইয়েমেনের পাঁচ বছরের যুদ্ধের প্রয়োজনে সৌদি আরবকে বিপুল অস্ত্র ক্রয় করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে অবাধে। আরো খারাপ দিক হচ্ছে, যুদ্ধের অভিঘাত সৌদি আরব এখন নিজে উপলব্ধি করছে। ইয়েমেনি হুতিরা এখন সৌদি আরবে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত বাড়িয়েছে। এক সময়ের সৌদি আরবের অর্জন হিসেবে পরিচিত ‘গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’ (জিসিসি) মোহাম্মদ বিন সালমানের অদূরদর্শী নীতি-অবস্থানের কারণে এখন ভঙ্গুর। সৌদি আরব একসময় নিজেকে গর্বের সাথে ভাবত আঞ্চলিক প্র্যাগমেটিজম ও স্ট্যাবিলিটির একটি স্তম্ভ হিসেবে, আজ তা পরিণত হয়েছে একটি যুদ্ধবাজ অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে।
অর্থনৈতিক রূপান্তরের লক্ষ্যে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কারের পথ উন্মুক্ত করার পরিবর্তে তরুণ যুবরাজ আরব আমিরাতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কোনো ধরনের কৌশল অবলম্বন না করেই দেশটিকে পরিণত করেন নিপীড়নমূলক পুলিশি রাষ্ট্রে। বন্ধ হয়ে পড়ে দেশটিতে সামাজিক উদারবাদের চর্চা। উল্টো পরিণত হয় ঘাটতি বাজেটের দেশে, যা অভ্যন্তরিন জনঅসন্তোষের কারণ। প্রথম দিকে সামাজিক গতিময়তা ও নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নিয়ে এক ধরনের প্রত্যাশা জন্মালেও, অল্প সময়েই রূপ নেয় নৈরাশ্যে। কারণ, সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সংস্কার ও বহু- শতকোটি ডলারের প্রকল্পগুলো থেমে যায়, যুবসমাজে বেকারত্ব থেকে যায় ২৯ শতাংশে। সবচেয়ে বড় কথা, পুরো অঞ্চলজুড়ে সৌদি আরবের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়।
এসব ব্যর্থতার মধ্যে যোগ হয়েছে ইরান-তুরস্ক নিয়ে অস্বস্তি। তারপরও মোহাম্মদ বিন সালমান বেপরোয়া। তিনি আবার আঞ্চলিক ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারেন আগামী জি-২০ শীর্র্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। সৌদি আরব আয়োজন করতে যাচ্ছে এ সম্মেলন। কিন্তু তাতেও কিছু হবে বলে মনে হয় না। কারণ, সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষক ট্রাম্প নির্বাচনে হারতে যাচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা। তা হলে কি ইসরাইলই শেষ আশ্রয়?
ধ্বংসাত্মক নীতি অবলম্বন পাল্টানো, ইয়েমেনের যুদ্ধের অবসান ঘটানো, কাতারের সাথে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ও ইরানকে শান্ত করতে আরব ও উপসাগরীয় ঐক্য জোরদারের বদলে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এখন গোপনে মিত্রতা গড়ে তোলায় ব্যস্ত আরব ভূমি দখলদার ইসরাইলের সাথে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন মতে, মোহাম্মদ বিন সালমান ইউএই ও বাহরাইনকে উৎসাহিত করছে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তুলতে। কিন্তু তার বাবা বাদশা সালমানের সম্মতি ছাড়া এ কাজ করছেন তিনি। খবরে প্রকাশ, বাদশাহ সালমান ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা ছাড়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্পূর্ণ বিরোধী। ফিলিস্তিন সম্পর্কে এ কথা সত্য না মিথ্যা, কিংবা এটি বাপ-বেটার কোনো ‘গুড কপ, ব্যাড কপ’ খেলা কি না, তা বিবেচনায় না নিয়েই বলা যায়- উপসাগীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় ইসরাইল এগিয়ে আসবে- সে আশা সুদূর পরাহত। কারণ, ইসরাইল ভালো করেই জানে, এ অঞ্চলে আমেরিকান, ফ্রান্স ও অন্য বৈশ্বিক ক্ষমতাধরদের সংশ্লিষ্টতা এরই মধ্যে অতিসিঞ্চিত তথা সেচ্যুরেটেড পর্যায়ে। তা ছাড়া এ অঞ্চলের মনার্কি রক্ষায় ইহুদি ইসরাইলি সেনারা আত্মোৎসর্গ করতে আসবে কোন দুঃখে। প্রসঙ্গত, ‘গুড কপ, ব্যাড কপ’ হচ্ছে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের একটি কৌশল, যাতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় কিছু কর্মকর্তা আসামির সাথে সহমর্মী ও কিছু কর্মকর্তা আগ্রাসী নিষ্ঠুর আচরণ করে সত্য বের করে আনার চেষ্টা চালায়।
সে যা-ই হোক, বেশি হলে ইসরাইল সৌদি আরবকে প্রযুক্তিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র কেনার প্রস্তাব দিতে পারে। বিশ্বমোড়ল দেশগুলো ছাড়মূল্যে এসব দেয়ার প্রস্তাব দিয়েই রেখেছে। তার পরও ইসরাইল সুখবোধ করতে পারে সৌদি-আমিরাতি ‘গণতন্ত্রবিরোধী লিগে’ যোগ দিয়ে। তাতেও কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না সৌদি আরবের জন্য। দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনে দখল কায়েম রাখা ও ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন জারি রাখার জন্য দায়ী এ অঞ্চলের কিছু লোক। সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব মনে করে ইসরাইল এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের শত্রু, ইসরাইল এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় চরম হুমকি। মোহাম্মদ বিন সালমানকে এসব সত্য জেনেই আমূল বদলে যেতে হবে। নইলে তার হাতেই হবে সৌদি মনার্কির পতন। যুক্তরাষ্ট্র, ট্রাম্প কিংবা ইসরাইল কেউই এ পতন ঠেকাতে পারবে না।