চীন না তাইওয়ান : কী করবে ভারত!
চীন না তাইওয়ান : কী করবে ভারত! - ছবি : সংগৃহীত
ভারতে এই প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের জাতীয় দিবস বেশ ধূমধামের সঙ্গে পালিত হওয়ার পর এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে ভারত তাদের 'এক চীন' নীতি পুনর্বিবেচনা করবে কি না।
তাইওয়ানকে এর আগে আলাদা দেশ হিসেবে উল্লেখ না করতে চীনা দূতাবাস ভারতীয় মিডিয়াকে যে পরামর্শ দিয়েছিল সেটাও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমেধ্যেই খারিজ করে দিয়েছে।
এরপর তাইওয়ানের জাতীয় দিবসে দিল্লিতে চীনা দূতাবাসের সামনে তাইওয়ানের সমর্থনে পোস্টার ও তাদের পতাকাও লাগিয়েছেন শাসক দল বিজেপির কর্মীরা।
তবে দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন 'এক চীন' নীতির সঙ্গে বেইজিং কোনো আপস করে না - ফলে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিতে গেলে ভারতকে কিন্তু চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শেষ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বস্তুত প্রতি বছরের ১০ অক্টোবর তাইওয়ান তাদের জাতীয় দিবস পালন করে এলেও ভারতে কিন্তু তার কোনো উদযাপন হয় না বললেই চলে।
এবারে কিন্তু এই দিনটিতে দিল্লির 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকায় তাইওয়ানের দেয়া বিশাল বিজ্ঞাপনী ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে।
দিল্লির বিজেপি কর্মীরা শহরের চাণক্যপুরীতে চীনা দূতাবাসের সামনে তাইওয়ানের পতাকা ও তাদের প্রতি সমর্থনসূচক পোস্টার লটকে দিয়ে এসেছেন।
সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় দিবসের উৎসবে সামিল হওয়ার জন্য তাইওয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও আলাদা করে ভারতকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন পর্যন্ত তার জাতীয় দিবসের ভাষণে ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
তাইওয়ানের এই নেত্রীকেই যাতে 'প্রেসিডেন্ট' বলে অভিহিত করা না হয় এবং তাইওয়ানকে আলাদা 'দেশ' বলে উল্লেখ না করা হয়, সে ব্যাপারে মাত্র কদিন আগেই ভারতীয় সাংবাদিকদের চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল দিল্লির চীনা দূতাবাস।
গত জুন মাসে লাদাখে ভারতীয় ও চীনা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর থেকেই ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ তাইওয়ানের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে - ওই চিঠি ছিল সেই পটভূমিতেই।
তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব ওই পরামর্শ নস্যাৎ করে জানিয়ে দিয়েছেন, "ভারতের সংবাদমাধ্যমের যেটা উচিত মনে হয় সেটা রিপোর্ট করার স্বাধীনতা আছে।"
তাইওয়ানের জাতীয় দিবসের খবরও এদেশের বহু সংবাদপত্র ও চ্যানেলে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।
দিল্লিতে ইনস্টিটিউট অব চায়না স্টাডিজের ফেলো অধ্যাপক শ্রীমতী চক্রবর্তী অবশ্য এর পরেও মনে করেন ঐতিহাসিক কারণেই ভারতের জন্য 'এক চীন' নীতি থেকে সরে আসা মোটেই সহজ হবে না।
শ্রীমতী চক্রবর্তী বলছিলেন, "যদি ভারত ওয়ান চায়না নীতি কোনো কারণে ত্যাগ করে, সঙ্গে সঙ্গেই পিআরসি (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) ভারতের সঙ্গে সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। কারণ সেটাই ওদের নীতি।"
"পিআরসি আর তাইওয়ান যখন আলাদা হয়েছিল, তখন কিন্তু ভারত অনেক ভেবেচিন্তে একটা সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পিআরসিকেই আসল চীন বলে তারা স্বীকৃতি দেবে।"
"কারণ তখন বাকি দুনিয়ার মতো ভারতেরও ধারণা ছিল কিছুদিনের মধ্যেই লাল ফৌজ পাঠিয়ে চীন তাইওয়ানকে কব্জা করে নেবে। তবে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি ও আরো নানা কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।"
তবে তাইওয়ানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক না-থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের ঘনিষ্ঠতা যে অনেক বেড়েছে তাতে কোনো ভুল নেই - আর সেটার অন্যতম লক্ষ্য চীনকে চাপে রাখা।
শ্রীমতি চক্রবর্তীর কথায়, "ইদানীং ভারত ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে অনেক নিবিড় হয়েছে। দুদেশের ট্রেড অফিস তো কার্যত পরস্পরের দূতাবাস হিসেবেই কাজ করছে।"
"তবে লাদাখের সংঘর্ষর পর থেকেই এখন নানা স্তরে কথাবার্তা হচ্ছে যে তাইওয়ানকে পুরো স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, এক চীন নীতি রিভিউ করা উচিত।"
"আমার ধারণা এটা চীনকে একরকম চাপে রাখার জন্যই। তাদের এই বার্তাই দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে পথে এসো, নইলে আমাদের হাতে কিন্তু এই তাইওয়ান কার্ডটাও আছে।"
"আসলে ভারত বরাবরই চীনের বিরুদ্ধে তিব্বত তাসটাই খেলে এসেছে। চীনও সম্ভবত কোনওদিন ভাবেনি যে দিল্লি তাদের বিরুদ্ধে তাইওয়ান কার্ড নিয়েও খেলতে পারে।"
"এখানে মনে রাখতে হবে, তিব্বতের চেয়েও তাইওয়ান কিন্তু চীনাদের কোছে অনেক বেশি ইমোটিভ বা আবেগের ইস্যু।"
"আমার প্রতিটা চীন সফরে আমি সেদেশের সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারা প্রায় প্রত্যেকে মনে করেন তাইওয়ানকে ছাড়া চীনের স্বাধীনতাই অসম্পূর্ণ", বলছিলেন শ্রীমতি চক্রবর্তী।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পরও ভারত কিন্তু 'এক চীন' নীতি থেকে সরে আসেনি।
সেই যুদ্ধের ছয় দশক পর গালওয়ান উপত্যকায় কুড়ি জন সেনার মৃত্যু কিংবা প্যাংগং লেকে সামরিক উত্তেজনার জেরে ভারত এবার অন্য রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেবে, সেই সম্ভাবনা তাই এখনো ক্ষীণ।
সূত্র : বিবিসি