মিয়ানমারে ফেসবুকে লড়াই
সু চি - ছবি : সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দৈহিক নির্বাচনী প্রচারণা নিষিদ্ধ হলেও মিয়ানমারের প্রার্থীরা ৮ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগ দিয়ে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা ও ভুল তথ্যের শিকার হচ্ছেন।
মিয়ানমারের যেসব এলাকায় কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ খুব বেশি ওইসব এলাকায় নির্বাচন কমিশন সশরীরে নির্বাচনী প্রচারণা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বৃহস্পতিবার দেশটিকে নতুন করে ১৪ শ’ লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর ফলে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
২০১৫ সালের নির্বাচনী প্রচারণা সারা দেশে চলেছিল। কিন্তু চলতি বছরের প্রচারণা মূলত হচ্ছে ফেসবুকে। এর মাধ্যমেই রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদেরা তাদের সমর্থক ও এলাকায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, নির্বাচনে ভুল তথ্য ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ব্যাপক হতে পারে।
বস্তুত, অনেক ভোটার জানিয়েছেন, তারা তাদের সামনে আসা বক্তব্যগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। প্রথমবারের মতো ভোটার হওয়া ১৮ বছর বয়স্ক হনিন আইন বলেন, আমাদের এলাকায় কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা না থাকায় আমাকে তথ্যের জন্য প্রধানত ফেসবুকে তথ্য পরীক্ষা ও প্রার্থীদের কার্যক্রম জানতে হচ্ছে।
তবে তিনি ফেসবুকে ভেরিফাইয়েড মিডিয়া পেইজের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, মিথ্যা তথ্যের ব্যাপারে আমাদেরকেই সতর্ক থাকতে হবে। এ কারণে আমি নীল-টিক দেয়া মিডিয়া পেইজগুলোর দিকেই কেবল তাকাই।
সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় ও যৌন সংখ্যালগুদের টার্গেট করে করা পোস্টগুলোতে সয়লাপ হয়ে গেছে।
মান্দালয়ের পিপলস পাইওনিয়ার পার্টির এক সমকামী প্রার্থী মাইও মিন তুন ফোনে বলেন, আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি বলে ফেসবুকে অনেক মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়ায় বলা হচ্ছে, আমাদের দল এই দেশকে এলজিবিটি দেশে পরিণত করতে চাইছে।
তিনি বলেন, আমি সামাজিক মাধ্যমে এসব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হতে চাই না। আমি কেবল এলবিজিটি প্রার্থী হিসেবে রাজনীতিতে আমি কী করতে পারি, তাই বলছি।
ফেসবুক ২০১৮ সালে স্বীকার করেছিল যে তারা রোহিঙ্গা সঙ্কটকে উস্কে দিতে ও বিভাজন বাড়াতে প্লাটফর্মটির ব্যবহার ঠেকাতে তেমন কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলিম গ্রুপগুলো বৌদ্ধদের ওপর হামলা করছে বলে ফেসবুকে অনেক পোস্ট দেয়া হয়েছিল।
নভেম্বরের নির্বাচনের আগ দিয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচার বন্ধ করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন তথ্য সরিয়ে দেয়ার কথা আগস্ট মাসে জানিয়েছিল ফেসবুক। তারা মিয়ানমারের সাথে তিনটি ফ্যাক্ট-চেকিং পার্টনারের সাথে কাজ করার কথাও জানায়।
তিনি বলেন, ফেসবুকে রাজনৈতিক দলগুলোকে লক্ষ্য করে দেয়া বেশির ভাগ বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হয় ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তারা দল ও প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ চালায়।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা বুম মিয়ানমারের থান জাওহতুন নিক্কিই এশিয়াকে বলেন, বৌদ্ধ না হওয়ায় এনএলডির দুই প্রার্থীকে টার্গেট করা হয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে অবগত এক ব্যক্তি বলেন, ফেসবুকে যত পোস্ট দেয়া হয়, তার তুলনায় ফ্যাক্ট চেক সংস্থারগুলো খুবই কম। তিনি বলেন, তারা যদি এ সময় অন্তত আরো বেশি লোক নিয়োগ করত, তবে ভালো করত।
বৃহস্পতিবার ফেসবুক এক বিবৃতিতে জানায়, তারা নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে ফেসবুকের ৫০টি ও ইনস্টাগ্রামের ছয়টি অ্যাকাউন্ট বাদ দিয়েছে। কোম্পানিটি জানায়, এসব অ্যাকাউন্ট যারা চালায়, তারা তাদের পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্য।
মান্দালয়ের এনএলডি থেকে মুসলিম প্রার্থী উইন মায়া মায়া এ ধরনের বিদ্বেষমূলক প্রচারকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তিনি বরেন, এই এলাকায় অনেক লোক আমাকে চেনে। ফলে অনলাইনে যত লোক আমার বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি লোক আমার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলছে।
উইন মায়া মায়া সামরিক শাসনামলে রাজবন্দি ছিলেন। তিনি এখন মান্দালয় অঞ্চলের এনএলডি শাখার ভাইস চেয়ারম্যান। জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্বেষমূলক বৈষম্য করার কারণে ২০১৫ সালে তার দল তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিষিদ্ধ করেছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ধরনের মিথ্যা তথ্য ও বিদ্বেষমূলক প্রচার অব্যাহত থাকলে মিয়ানমার বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।
মানবাধিকার সংস্থা আথানের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ে উইফি আং নিক্কিইকে বলেন, স্বাধীনভাবে কথা বলাকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে। তবে তা যদি বৈষম্যমূলক বা অসত্য হয়, তবে তা প্রচার করতে দেয়া ঠিক হবে না।
মিয়ানমারের এনজিও আইসিটি নিক্কিইকে জানায়, সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০১৫ সালে এই সংস্থা মাসে ভুয়া খবর ও বিদ্বেষমূলক প্রচার দেখেছিল ১০০টির মতো। চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ৪০০।
মিয়ানমারের কার্যত নেতা আং সান সু চির ফেসবুক পেজে ফলোয়ার আছে আট লাখ। তার দল এনএলডি বৃহত্তম ফলোয়িং অনলাইন। এনএলডির ফেসবুক পেজের ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ২.৯ মিলিয়ন। আর সামরিক-সমর্থিক ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির রয়েছে মাত্র চার লাখ, পিপলস পাইওয়ানিয়ার পার্টির তিন লাখ।
সূত্র : নিক্কিই এশিয়া রিভিউ