কিরগিজ মডেল বেলারুশিয়াতেও!

আবদুর রহমান খান | Oct 11, 2020 02:12 pm
সভেতলানা তিখানোভস্কায়া ও আলেক্সজান্ডার লুকাশেঙ্কো

সভেতলানা তিখানোভস্কায়া ও আলেক্সজান্ডার লুকাশেঙ্কো - ছবি সংগৃহীত

 

ইউরোপের “শেষ স্বৈরাচার” বলে চিহ্নিত বেলারুশিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সজান্ডার লুকাশেঙ্কো ব্যাপক সহিংস গণ-আন্দোলনের মধ্যে ষষ্ঠবারের মতো দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনেকটা লুকোচুরি করে, কোনোরকম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই, শপথ নিয়ে ফেলেছেন গত ২৩ সেপ্টেম্বর। তবে রাজধানী মিনসক-এর দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে; লুকোশেঙ্কোর বেলা শেষ।

টানা ২৬ বছরেরর একনায়কত্ব অবসানের জন্য এবার রাস্তায় নেমেছে বেলারুশের মানুষ। রাজপথের আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে সরকারি বাহিনী লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, সাজোয়া যান, জলকামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর। রাজধানী মিনসক থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সব শহরে। ক্রমশ সহিংস হয়ে উঠেছে দিনে-রাতের বিক্ষোভ। ব্যাপক গ্রেফতার আর লাঠিপেটা করে আহত করা ছাড়াও আটক করা হয়েছে কয়েক শ' নাগরিককে। আটক অনেকেই সংক্ষিপ্ত বিচারের নামে স্বল্প মেয়াদের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

ওদিকে আটক করে পুলিশের ভ্যানের মধ্যেই ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন বিক্ষোভে আংশ নেয়া অনেক নারী। এরকম যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সংস্থা।

বেলারুশের মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহেই অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো সাতজন। ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীদের আরো কয়েকজনের কারাগারে আটক অবস্থায় মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আন্দোলন সংগঠনকারীদের কয়েকজনকে গুম করা হয়েছে। পরে দু’জনের লাশ পাওয়া গেছে। একজনের লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলে আর একজনের নদীতে।

ইতোমধ্যে বিরোধী নেত্রী সভেতলানা তিখানোভস্কায়াকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। পাশের দেশ লিথুনিয়ায় দু’সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সভেতলানা। শপথ অনুষ্ঠানে লুকাশেঙ্কো বলেছেন, বিরোধীরা সভেতলানাকে খুন করে আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তাই তার নিরাপত্তার জন্য সরকারি বাহিনী তাকে পাহারা দিয়ে সীমান্ত পার করে দিয়েছে। এদিকে তার স্বামী সেরগেইকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে।

তবে লুকাশেঙ্কোর একমাত্র সমর্থক প্রতিবেশী দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আশ্বস্ত করে জানিয়েছে, বেলারুশের অন্দোলন থেকে লুকাশেঙ্কোকে রক্ষার জন্য রুশ সরকার একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত রেখেছেন। পরিস্থিতি লুকাশেঙ্কোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রাশিয়া সরাসরি সেনাবাহিনী পাঠাতে পারে বলে এরই মধ্যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। ইতোমধ্যে ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশ জানিয়ে দিয়েছে, তারা লুকাশেঙ্কোকে এখন আর বৈধ প্রেসিডেন্ট বলে স্বীকার করে না। তারা তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে।ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

বেলারুশের এবারের গণবিস্ফোরণের সূত্রপাত আগষ্টের বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। যেমনটি সাজানো হয়েছিল সেভাবেই বেলারুশিয়ায় আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একনায়ক আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে শতকরা ৮০ ভাগ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ব্যাপক জালিয়াতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে বিরোধীরা। আগষ্টের মাঝামাঝি শুরু হয়ে দিনে-রাতে চলছে বিক্ষোভ।

প্রায় এক কোটি মানুষের দেশ বেলারুশিয়াতেও হানা দিয়েছে বিশ্ব মরণব্যাধি কোভিড-১৯। এ ভাইরাস সংক্রমণে ইতোমধ্যে সাত শতাধিক মারা মারা গেছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন ৮০ হাজারের বেশি। এ অবস্থায় নির্বাচনে অনেকটা আকস্মিকভাবেই আবির্ভূত হন সভেতলানা তিখানোভস্কায়া নামের ৩৭ বছর বয়সের হাইস্কুল শিক্ষিকা। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচনে অংশ নেবেন এমন কিছু চিন্তা করেননি তিনি নিজেও । প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো যাকে “পুওর লিটল গার্ল” বলে উল্লেখ করেছেন, তিনি তিখানোভস্কায়া মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হয়ে উঠলেন তার ঘুম হারাম করে দেয়া জনপ্রিয় বিরোধী নেত্রী।

সভেতলানার স্বামী সেরগেই জনপ্রিয় ব্লগার। লুকাশেনকো সরকার সেরগেইকে জেলে পুরে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য বানিয়ে দেয়। আরো দু’জন সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ অবস্থায় সব বিরোধীরা মিলে তিকানোভস্কায়াকে নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামে। জেলে আটক দুই প্রার্থীর দু’জন স্ত্রীও যোগ দেয় তিকানোভস্কায়ার প্রচার অভিযানে। তাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বিপুল জনসমর্থন দেখে ভোটের আগেই বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদের উপর নেমে আসে পুলিশি দমন অভিযান।

তিখানোভস্কায়া নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নিজেকে বেলারুশের জাতিয়তাবাদী শক্তি হিসেবে আর লুকাশেঙ্কো সরকারকে রাশিয়ার দালাল হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরেন। লুকাশেঙ্কো তার দেশকে পুনরায় রাশিয়ার সাথে মিলিয়ে দেবার চেষ্টা করছে বলে পশ্চিমা শত্তিও প্রচার চালাতে থাকে।

এ অবস্থায় নির্বাচনে জয়ের নানা অপকৌশল ঠিক করে নেয় লুকাশেনকোর সরকার। নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলেছেন, শতকরা চল্লিশভাগ ভোট আগেই বাক্সে ভরে দেয়া হয়েছিল। ভোটাররা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেন; আর ভেতর থেকে বলা হলো ব্যালট ফুরিয়ে গেছে। ভোট কেন্দ্রের দোতলার জানালা থেকে বস্তাভর্তি ব্যালটপেপার নিয়ে পেছনের মই বেয়ে লোক নিচে নামছে- এমন ছবিও ছাপা হলো পত্রিকায়। আর এ সব কীর্তি আড়াল করতে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের আসতে দেয়া হয়নি। দেশীয় পর্যবেক্ষকদের কেন্দ্রের ভেতরে যেতে দেয়া হয়নি। ফলাফল- তিখানোভস্কায়ার ভাগে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ ভোট।
বিরোধীরা এমন ফলাফলকে মানলেন না। রাস্তায় নামলো বিক্ষুব্ধ মানুষ।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয়া বেলারুশিয়া। বেলারুশিয়ার পূর্ব সীমান্ত জুড়ে রয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমের সীমানায় পোলান্ড আর উত্তরে লাটভিয়া লিথুনিয়া। এ তিনটি দেশই ইউরোপীয় সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেন। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশিদের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দিলেও সংঘাতের মুখে মধ্যে পালিয়ে আসা বেলারুশিয়ানদের ইউক্রেনে তাদের নিকট আত্মীয়দের কাছে সাময়িক আশ্রয় নেবার সুযোগ করে দিয়েছে ইউক্রেন সরকার। ইতোমধ্যে বেলারুশের আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইউক্রেনের নাগরিকদের পক্ষ থেকে সমাবেশ বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে ওই দেশের রাজপথেও। এ ছাড়া ইউক্রেন নিজেও তার দেশের পূর্বাঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্কট মোকাবেলায় বেশ কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে।

আন্দোলনের কিরগিজ মডেল

এদিকে বেলারুশিয়ার আন্দোলনকারীরা এবার কিরগিস্তানের “এক দিনের বিপ্লব” মডেলটি অনুসরণ করে দ্রুত, সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর গণ-অভ্যূত্থানের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

সাবেক সোভিয়েট প্রজাতন্ত্র থেকে স্বাধীন হওয়া কিরগিস্তানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেই তাদের পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য গত ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় একটি কারচুপির ভোট। সরকার সমর্থক দু’টি দলকেই ভোট কেনা-বেচার মাধ্যমে জিতিয়ে দেবার প্রতিবাদের বিক্ষুব্ধ কিরগিজ নাগরিকগন রাজধানীতে পার্লামেন্ট ভবনে চড়াও হয় এবং প্রেসিডেন্টের অফিস ভাংচুর করে। দেশটির অন্যান্য শহরেও একই সাথে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ বিক্ষোভ ।এ ছাড়া কিরগিজস্থানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার হাতে আটক থাকা দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আলমাজবেক আতামবায়েভকেও বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে বিক্ষোভকারীরা।

এক রাতের বিক্ষোভে আতঙ্কিত হয়ে সেন্ট্রাল ইলেকশন কমিশন ৫ অক্টোবের ভোট বাতিল করে দিয়েছে এবং নতুন নির্বাচন গ্রহণের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। একইসাথে কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সোরোনবাই জেনবেকভ পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে ৯ অক্টোবর রাজধানী বিসকেক-এ জরুরি আবস্থা জারি করে রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়ে দিয়েছে।

আন্দোলনকারী নেতাদের প্রতি আহবান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনবেকভ বলেছেন, দেশটিতে শান্তি বজায় রাখারস্বার্থে তারা যেন আন্দোলনকারীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে নেন।

এখন দেখার বিষয় জনগণের ন্যায্য আন্দোলন কিভাবে রূপ নেয় সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র- বেলারুশিয়া, কিরগিস্তান আর ইউক্রেনে। এছাড়া, রাশিয়া তার সামরিক শক্তি নিয়ে এসব প্রতিবেশী দেশে তার বন্ধুদের ক্ষমতায় রাখতে বা ক্ষমতায় বসাতে কিভাবে এগিয়ে আসে তাও এ অঞ্চলের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আর রাশিয়ার সামরিক প্রতিপক্ষ ইউরোপীয় বা মার্কিন শক্তি কতটা কার পক্ষে বা কার বিপক্ষে সক্রিয় হবে ওইসব তামাসা স্পষ্ট হতেও আরো একটু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

তবে, বেলারুশিয়ার প্রবাসীনেত্রী সভেতলানা তিখানোভস্কায়া বলেছেন, আমাদের এখন মনোযোগ কেবলমাত্র দেশের জনগণের অধিকার আদায় করা এবং জনগণের ভোটে একটি সরকার নির্বাচন করা যারা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে নিবেদিত হবে; দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us