১৭৬৪-এর পর ১৯৩৭ : মুসলিমরা আবার যেভাবে বাংলার ক্ষমতায় ফিরল
১৭৬৪-এর পর ১৯৩৭ : মুসলিমরা আবার যেভাবে বাংলার ক্ষমতায় ফিরল - ছবি : সংগৃহীত
১৮৬১ সালে ব্রিটিশ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত ভারতীয় কাউন্সিল আইনানুযায়ী, ১৮৬২ সালে সর্বপ্রথম ভারতীয়রা আইনসভায় প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। শুধু তদানীন্তন গভর্নর জেনারেলের মনোনীত ব্যক্তিরাই আইনপ্রণেতা হওয়ায় অভিজাত শ্রেণী সন্তুষ্ট হলেও ভারতবাসীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থা ও নির্বাচনী নীতি স্বীকৃতিসহ ১৮৯২ সালে নতুন করে প্রণীত হয় ভারতীয় কাউন্সিল আইন। ১৮৮৫ সালে প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে সর্বভারতীয় কংগ্রেস যাত্রা শুরু করলেও ‘হিন্দুপ্রীতি’ নীতির কারণে দলটি সর্বজনগ্রহণযাগ্যতা হারায়। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক ও অন্যান্য সুবিধার্থে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উন্নতিকল্পে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে কংগ্রেস ঢাকাকে রাজধানী করে নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধিতা করে কংগ্রেস রাজপথে নামে। এতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বজাতির স্বার্থ রক্ষার্থে এবং নতুন প্রদেশটিকে টিকিয়ে রাখতে একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন অনুভূত হলে সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ নবাব সলিমুল্লাহর আহ্বানে ঢাকার শাহবাগে মিলিত হয়ে গঠন করে মুসলিম বিশ্বের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। কিন্তু ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশটিকে ভেঙে দিলে মুসলমান সম্প্রদায় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নিজেদের স্বার্থরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘একলা চলো’ নীতি গ্রহণ করে। ১৯০৯ সালে ‘মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন’ শুধু মুসলমানদের জন্য এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের সব সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনপদ্ধতি স্বীকৃত দেয় সব প্রদেশের আইনসভাতেই সংরক্ষিত আসনের সৃষ্টি হয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান করা হলে ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের ১১টি প্রদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রদেশ বাংলার জনগণও প্রথমবারের মতো তাদের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে আইনসভায় পাঠানোর সুযোগ লাভ করেছিল। বাংলার সর্বত্র সব রাজনৈতিক দল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নির্বাচনী অভিযানে নেমে পড়ে। বঙ্গীয় আইনসভার ২৫০টি আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৯টি আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন ‘সর্বভারতীয় মুসলিম সংহতি’র দাবিদার ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ এবং এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’ করতে বদ্ধপরিকর আঞ্চলিক দল ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’ এর মধ্যে। কৃষক-প্রজা পার্টির সভাপতি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মুসলিম লীগের অন্যতম শীর্ষনেতা ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দীন পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় শুধু বাংলা নয় সারা ভারতের দৃষ্টি নিবন্ধ হয় পটুয়াখালীর নির্বাচনী আসনের দিকে। নিজ জমিদারি এলাকা ও এই আসনের প্রাক্তন এমপি হওয়া সত্ত্বেও খাজা নাজিমুদ্দীন প্রায় ৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন ফজলুল হকের কৌশলী নির্বাচনী প্রচার ও আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্বের কাছে। উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ১১৯টি সংরক্ষিত আসনে মুসলিম লীগ লাভ করে ৪০টি এবং কৃষক-প্রজা পার্টি লাভ করে ৩৫টি আসন।
অপর দিকে সাধারণ আসনে কংগ্রেস ৫৪টি আসন লাভ করলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় তারা কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি পরিত্যাগ করে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়ায় কৃষক-প্রজা পার্টির হক সাহেব অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রীসহ তিনজন বর্ণহিন্দু ও দু’জন তফসিলি হিন্দু মন্ত্রীর সমন্বয়ে মোট ১১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাসিমের পতন ও বাংলার সর্বশেষ নবাব নাজিম-উদদৌলার পরে এই প্রথম বাংলার ক্ষমতার মসনদের শীর্ষপদে মুসলমানরা আরোহণ করেন। ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’ করতে না পারলেও এ কে ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রিসভা সে লক্ষ্যে অনেক দূর এগিয়ে যায়। (ক) বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৩৮ (খ) কৃষি খাতক আইন, ১৯৩৮ (গ) মহাজনী আইন, ১৯৪০ (ঘ) বঙ্গীয় চাকরি বিধি বণ্টন আইন, ১৯৩৯ (ঙ) দোকান কর্মচারী আইনসহ বাংলার কৃষক ও বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে যার ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গের আইনসভায় ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজস্বত্ব আইন’ পাস হয়। ফলে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বিলুপ্ত হয়ে বাংলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকপ্রজাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ‘লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার’ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সাথে কোয়ালিশন সরকারের আরো বড় কৃতিত্ব হলো নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নামে কলঙ্ক স্থাপনকারী ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণ করা এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে তদন্তের জন্য ‘ফ্লাউড কমিশন’ গঠন করা। ১৯৪১ সালে জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে যোগদান সংক্রান্ত বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে এ কে ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করা হলে বাংলার কোয়ালিশন সরকার ভেঙে যায়। তখন এ কে ফজলুল হক ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু মহাসভা এবং ফরোয়ার্ড ব্লকের সাথে মিলে ১৯৪১ সালের ১১ ডিসেম্বর আবার কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন, যা ইতিহাসে ‘হক-শ্যামা মন্ত্রিসভা’ নামে খ্যাত। মাত্র ৪৭৫ দিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পরে ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ গভর্নরের আদেশে পদত্যাগ করলে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে শেরেবাংলা ও তার দল কৃষক-প্রজা পার্টি গুরুত্ব হারায়।
ফজলুল হকের পদত্যাগের পরে ১৯৪৩ সালের ২ এপ্রিল মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেসামরিক সরবরাহমন্ত্রীসহ ১৩ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার দুর্ভাগ্য এই যে, প্রদেশের প্রশাসনিক বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার আগেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ শুরু হয়, যাতে বাংলার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ না খেতে পেরে জীবন হারায়। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৫ সালের ২৮ মার্চ নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৯৪৫ সালের কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচন ও ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনকে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ওপর ‘গণভোট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং সারা ভারতব্যাপী সংরক্ষিত মুসলিম আসনে ভূমিধস বিজয় লাভ করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের একক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলায় কেন্দ্রীয় আইনসভার সব কয়টি আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিজয় লাভের ফলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে।
অন্য দিকে ব্যক্তিগতভাবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বরিশালের দু’টি আসন থেকে নির্বাচিত হলেও ’৪৬-এর নির্বাচনে তার দল মাত্র ছয়টি আসন লাভ করেছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ৭৭,৪৪২ বর্গমাইলব্যাপী অখণ্ড ও অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলনে জিন্নাহর বিশ্বস্ত সহচর ও বঙ্গীয় সিপাহসালার সোহরাওয়ার্দী।
syfulislam01799@gmail.com