আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে বিপদে ইরান!

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Oct 08, 2020 10:19 pm
হাসান রুহানি

হাসান রুহানি - ছবি : সংগৃহীত

 

আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে এই দুই দেশ ছাড়া তৃতীয় যে দেশটিকে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করেছে এই যুদ্ধ তা হলো ইরান।

প্রায় দুই সপ্তাহ পরও প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে লড়াই প্রশমনের কোনো লক্ষণ দেখা না দেয়ায়, উদ্বিগ্ন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সতর্ক করেছেন, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া লড়াই একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।

প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, “আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ যেন কোনোভাবেই আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ না নেয় সেদিকে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে।“

ইরানের ভেতর থেকে গত কদিন ধরে বলা হচ্ছে, সীমান্তে তাদের কয়েকটি গ্রামে রকেট এবং কামানের গোলা এসে পড়ছে। ইরানের সীমান্ত-রক্ষী বাহিনীর প্রধান কাসেম রাজেই বলেছেন সংঘাত শুরুর পর কিছু গোলা তাদের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে, এবং সেজন্য উত্তর সীমান্তে সৈন্যদের বিশেষভাবে সজাগ করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট রুহানিও বুধবার বলেছেন, ইরানের ভূমিতে অন্য কোনো দেশের গোলা বা ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। “আমাদের শহরের ও গ্রামের নিরাপত্তা আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার।''

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই প্রতিবেশীর সংঘাত যাতে আয়ত্তের বাইরে না চলে যায় তা নিয়ে ইরান উদ্বিগ্ন।

দুটি দেশের সাথে তাদের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং জাতিগত যে সম্পর্ক, তাতে ইরান কঠিন একটি ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে। যদিও নাগোর্নো-কারাবাখের ওপর আজারবাইজানের সার্বভৌমত্ব ইরান গোড়া থেকে সমর্থন করে আসছে, কিন্তু অতীতের মতো এবারও ইরান বারবার বলার চেষ্টা করছে এই বিরোধে তারা কোনো পক্ষ নিচ্ছে না।

মীমাংসার মাধ্যমে সংঘাত মিটিয়ে ফেলতে দুই দেশের সরকার প্রধানের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন স্বয়ং ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি। এমনকী মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে তেহরান।

ইরান কেন উদ্বিগ্ন

অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, লক্ষ্যচ্যুত কিছু কামানের গোলা ইরানের প্রধান উদ্বেগ নয়, বরঞ্চ দোরগোড়ায় এই সংঘাতে এমন এমন দেশ জড়িয়ে পড়ছে যাদের উদ্দেশ্য নিয়ে ইরানের গভীর সন্দেহ রয়েছে।

তেহরান সরকারের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইরানকেও নিশানা করার চেষ্টা হতে পারে। ইসরাইলের সাথে হালে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠতা এবং তাদের ইসরাইলি ড্রোন এবং অন্যান্য অস্ত্র কেনার বিষয়টি নিয়ে ইরান উদ্বিগ্ন। মুসলিম আজারবাইজানকে ইসরাইলি এই অস্ত্র সাহায্য এতটাই প্রকাশ্য যে প্রতিবাদে আর্মেনিয়া ইসরাইল থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনেছে।

তেহরান সরকারের ঘনিষ্ঠ ইরানের রাজনীতিক এবং ইরান পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ জাভেদ জামালিকে উদ্ধৃত আল জাজিরা লিখেছে “যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এই বিরোধ জিইয়ে রাখতে চাইবে।'' বোঝাই যায়, আজারবাইজান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও চিরশত্রু ইসরাইলের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ইরান ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন ও নাখোশ।

এমন অভিযোগও উঠেছে, ইরান তলে তলে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করছে। সম্প্রতি অনলাইনে বেশ কিছু ভিডিও শেয়ার হয়েছে যেখানে দেখা গেছে ইরানের একটি সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আর্মেনিয়াতে ট্রাক ঢুকছে।

তবে ইরান সরকার সাথে সাথে একে “ভিত্তিহীন অপপ্রচার'' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেখানো হয়েছে আর্মেনিয়ার সাথে নেরাদুজ সীমান্তে যেসব রুশ নির্মিত ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে তা সংঘাত শুরুর আগে আর্মেনিয়া রাশিয়া থেকে কিনেছিল, যেগুলো ইরানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আর ওসব ট্রাকে অস্ত্র নয়, বরঞ্চ গাড়ির যন্ত্রপাতি রয়েছে।

ইরানের জাতিগোষ্ঠীর নাজুক সমীকরণ

এছাড়া আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংঘাতে তাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়তে পারে বলে ইরানের ভেতর আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কার মূল কারণ ঐতিহাসিক সূত্রে ইরানের ভেতর প্রচুর সংখ্যায় জাতিগত আজেরি ও আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস।

আধুনিক আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া (প্রাচীন নাম আরান) ১৯ শ' শতক পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, যা পরে তারা যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে হারায়। ফলে, এই দুই জাতিগোষ্ঠীর বহু মানুষ ইরানের নাগরিক।

আজেরিরা ইরানের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। প্রায় দুই কোটি আজেরির বসবাস ইরানে। বিশেষ করে আজারবাইজান সীমান্তবর্তী আরদাবিল ও পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে আজেরিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ইরানের নাগরিক হলেও তারা সীমান্তের ওপারে আজারবাইজানের আজেরিদের সাথে আত্মিক ঘনিষ্ঠতা বোধ করে।

সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে আজারবাইজানের সমর্থনে তেহরান ও তাবরিজসহ বেশ কটি শহরে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। আজেরি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এমন কয়েকটি জায়গায় মসজিদের ইমামরা গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর আজারবাইজানের সমর্থনে যৌথ বিবৃতি জারি করেছেন।

অন্যদিকে, প্রায় এক লাখের মতো আর্মেনীয় ইরানের নাগরিক যারা দেশের ব্যবসা ও সমাজ-অর্থনীতির অন্যান্য কাঠামোতে সুপ্রতিষ্ঠিত। এসব ইরানি-আর্মেনীয়দের সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের, বিশেষ যুক্তরাষ্ট্রের, প্রভাবশালী আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে ইরান সরকারের কাছে তাদের গুরুত্ব অনেক।

ব্রিটেনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইরান বিশেষজ্ঞ মারজিয়ে কোহি-ইসফাহানি ‘দি কনভারসেশন' নামে গবেষণা-ভিত্তিক একটি অনলাইন পোর্টালে এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, এই দুই জাতিগোষ্ঠীর স্পর্শকাতরতার কথা ভেবেই ইরান মধ্যস্থতা করার কথা বলছে।

“ইরানকে দেখাতে হবে যে এই সংঘাতে তারা নিরপেক্ষ। অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য এটা তাদের জন্য জরুরি। প্রকাশ্যে কোনো একটি পক্ষকে সমর্থন করলে ইরানের ভেতর জাতিগত বিভেদ তৈরি হয়ে তা সংঘাতেও রূপ নিতে পারে।।''

মারজিয়ে কোহি-ইসফাহানির মতে, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংঘাতে নিরপেক্ষ অবস্থান ও সেইসাথে সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় সমর্থন জুগিয়ে যাওয়াই এখন ইরানের কাছে সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

সূত্র : বিবিসি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us