স্বৈরতন্ত্রের পথে শ্রীলঙ্কা!
গোতাবায়া রাজাপাকসা - ছবি সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে সংবিধানের যে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে করে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।সংখ্যালঘুরা আশঙ্কা করছে, এই পরিবর্তনের ফলে জাতীয়তাবাদী সিংহলা বৌদ্ধদের পার্লামেন্টারি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তাদের অধিকার খর্ব হবে।
প্রস্তাবটি পাস হলে পার্লামেন্ট চলে যাবে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসার নিয়ন্ত্রণে। তার হাতে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া, শীর্ষ বিচারপতি নিয়োগ করা, যেকোনো বিচার থেকে দায়মুক্তি এবং কোনো নিয়ন্ত্রণ ছঅড়াই সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকবে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত আদালত প্রশ্ন করতে পারে, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগের ক্ষমতা রাখেন, প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা নিয়োগে স্বাধীন কমিশন নিয়োগ করা যায় এবং রাজনৈতিক পদগুলোতে দ্বৈত নাগরিকদের নিয়োগে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
গত বছর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের আগে রাজাপাকসা তার মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। নতুন প্রস্তাবের ফল দ্বৈত নাগরিকেরা রাজনৈতিক পদ গ্রহণ করতে পারবেন। এর ফলে রাজাপাকসা পরিবারের যেসব সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক হয়ে আছেন, তারা পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের পরিবারের শক্তি আরো বাড়াতে পারবেন।
রাজাপাকসার বড় ভাই, সাবেক প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসা এখন প্রধানমন্ত্রী। আরেক বড় ভাই ও তিন ভাতিজাও আইন প্রণেতা। তাদের তিনজন মন্ত্রী।
গত নভেম্বরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ-সিংহলিদের অভিভাবক হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন রাজাপাকসা। প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস করতে তার সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন। অবশ্য সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা এক আবেদনে বলা হয়েছে, এই সংশোধনী যাতে গণভোটে পাস হয়, তা নিশ্চিত করতে।
সংবিধানে বলা হয়েছে, কিছু কিছু ধারা গণভোটের মাধ্যমে পাস করতে হবে।
আইনবিদ ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক কলামিস্ট সুব্রামানিয়াম জথিলিঙ্গম বলেন, সরকার ভারসাম্যব্যবস্থা দুর্বল করার মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে।
সংশোধনীর ফলে রাজাপাকসা যত ইচ্ছা মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন, মন্ত্রীদের বরখাস্ত করতে পারবেন, পুলিশপ্রধান, নির্বাচন কমিশনের সদস্য, পাবলিক সার্ভিস, দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্যদেরও নিয়োগ করতে পারবেন।
নিরপেক্ষ ন্যাশনাল পিস কাউন্সিল থিঙ্ক ট্যাঙ্কের জেহান পেরেরা বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এর ফলে রাজনীতির শিকারে পরিণত হতে পারে, তারা এক ব্যক্তির কর্তৃত্বের আওতায় থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ-সিংহলি সম্প্রদায়ের স্বার্থই সিদ্ধি করতে পারে।
রাজাপাকসার নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘এক দেশ, এক আইন’। একে শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ করার নীতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। আর সংখ্যালঘু তামিলা দীর্ঘ দিন ধরে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা প্রদান করার যে দাবি জানাচ্ছিল, তা প্রত্যাখ্যান করার সামিল।
দেশটির উত্তর ও পূর্ব দিকে কেন্দ্রীভূত শ্রীলঙ্কার তামিল সম্প্রদায় মনে করে, তারা আলাদা জাতি। তারা তাদের নিজেদের মতো শাসনের দাবি জানাচ্ছে। তামিল বিদ্রোহীরা সংহলি নিয়ন্ত্রণে নিজেদের কোণঠাসা অবস্থার থেকে রেহাই পেতে তিন দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ চালিয়েছিল।
সরকারি বাহিনী ২০০৯ সালে বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দেয়। এই গৃহযুদ্ধে অন্তত এক লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে।
চলতি বছরের প্রথম দিকে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের একটি প্রস্তাব থেকে শ্রীলঙ্কাকে প্রত্যহার করে নেন রাজাপাকসা। ওই প্রস্তাবে সরকারি বাহিনী ও তামিল বিদ্রোহী উভয়ের যুদ্ধাপরাধের তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
জাতিগত তামিল আইনপ্রণেতা এম এস সুমানথিরন বলেন, পার্লামেন্ট দুর্বল হয়ে গেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের কথা বলার অধিকার হারাবে।
সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলিমদের অনেকে বলছেন, এই পরিবর্তন নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর সরকার ঘোষণা করে যে তারা গরু জবাই নিষিদ্ধ করবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের খুশি করার জন্য এই আইন করা হচ্ছে। অনেকে মনে করছে, মুসলিমদের ক্ষতি হবে এই আইনে। কারণ বেশির ভাগ কসাইখানা ও গরুর গোশতের দোকানের মালিক তারাই।
ইসলামি বক্তা ফজল সামসুদ্দিন বলেন, তিনি আশঙ্কা করছেন, সরকার অভিন্ন জাতীয় আইন প্রণয়নের নামে ইসলামি আদালত, ব্যাংকসহ ধর্মীয় আইনে হস্তক্ষেপ করছে।
জথিলিঙ্গম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এসবের ফলে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো অনেক দেশে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি বলেন, সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে। আপনি যখন তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে চাইবেন, তখন তারা তাদের দাবি বাড়াতে থাকবে। আর এক সময় সরকার শক্তিশালী দেশগুলোতে শত্রুতে পরিণত করা ছাড়া তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
তিনি বলেন, কোনো ছোট দেশ যদি বিশ্বসম্প্রদায়ের দ্বারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, তবে সে টিকে থাকতে পারে না।
সূত্র : এপি