গরু এবং ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়

আমজেদ জাভেদ | Oct 07, 2020 08:03 pm
গরু এবং ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়

গরু এবং ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় - ছবি : সংগৃহীত

 

উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অযোধ্যাকে ভ্যাটিকান, মক্কায় পরিণত করতে চান। তিনি আগ্রার মোগল জাদুঘরের নতুন নামকরণ করেছেন মারাঠা রাজা ছত্রপতি শিবাজির নামে। তিনি এ ব্যাপারে বিরোধী ও জাটদের প্রতিবাদ উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি অযোধ্যায় মুসলিমদের জন্য একটি মসজিদ ও হিন্দুদের জন্য একটি মন্দির বানানোরর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিধ্বস্ত বাবরি মসজিদের বদলে অযোধ্যা থেকে দূরে যে মসজিদটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করেন।

হিন্দু সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে বৈধতা দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রঞ্জন গগৈ অবসরগ্রহণের আগ দিয়ে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলসহ সরকারপন্থী রায় দিয়ে রাজ্যসভায় তার আসনটি নিশ্চিত করেছেন।

ভারতে হিন্দু চরমপন্থার বৃদ্ধি
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো খুন, মুসলিমদের জীবন্ত পোড়ানো, গরু-সংক্রান্ত পিটিয়ে মারা, ধর্মীয় কারণে প্রহার করা, ধর্মীয় কারণে হত্যার মতো ঘটনা রেকর্ড করে না বলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
অবাক করা বিষয় হলো, ভারতের নির্বাচনে গরুর মর্যাদার বিষয়টি অন্য সব ইস্যুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। এই বিষয়টি নিয়ে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। আরো ভয়াবহখবর হলো, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গরুকে মানুষের সমান বলে ঘোষণা করেন।
এদিকে রাজস্থানের হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশ চন্দ্র শর্মা এক মামলার ১৯৩ পৃষ্ঠার রায়ে তিনি বলেন, ‘ময়ূর সেক্স করে না,’ ‘গরু হলো সার্জন,’ ও ‘গরু হলো জাতীয় প্রাণী।
পরে ওই বিচারপতি সিএনএন-নিউজ১৮-এ বলেন, ময়ুর সারা জীবন ব্রহ্মচারী থাকে। সে ময়ুরীর সাথে সেক্স করে না। ময়ুরের চোখের কান্না থেকে ময়ুরী গর্ভধারণ করে। আর এ কারণেই দেবতা কৃষ্ণ ময়ুর পালক পরিধান করতেন।সাধুরাও একই কারণে ময়ুরের পালক পরে। তিনি বলেন, দেবতা কৃষ্ণ পৃথিবীতে অবতরণের সময় সাথে করে গরু নিয়ে এসেছিলেন। তিনি জানতেন, গরু চিকিৎসকের কাজ করে। কারণ গরুর দুধ ওষুধী গুণসম্পন্ন। দুধে পাগলামি ছাড়া সব রোগ নিরাময় হয়।

মুসলিমরা গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করলেও পিটিয়ে হত্যা বন্ধ হবে না
গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করলে কি পিটিয়ে হত্যা বন্ধ হবে? মুসলিমরা যদি গরুর খামার ও গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করেও দেয়, তবুও এক কোটি ২৫ লাখ হিন্দু তা করতে থাকবে। চরমপন্থীরা তখনো পিটিয়ে মারা অব্যাহত রাখবে। কোনো হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করলে কিংবা হিন্দু মেয়ের দিকে তাকালে পর্যন্ত তারা পিটিয়ে হত্যার কাজটি করতে থাকবে।

আসল কথা হলো, আসল ইস্যুগুলোর ওপর নজর দেয়া হচ্ছে না। ভারত হলো বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ। এখানে ১৪ লাখ শিশু মারা যায় তাদের ৫ম জন্মদিনের আগেই। প্রতি ১০টি পরিবারের সাতটির আয় দিনে ২০০ রুপির চেয়ে কম।

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের তথ্যানুযায়ী, ৮০ মিলিয়নেরও বেশি ভারতীয় গরুর গোশত খঅয়। এর মধ্যে ১.৫ মিলিয়ন হলো হিন্দু। বাকিরা মুসলিম ও খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের।
তাছাড়া ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভারত হলো বিশ্বের বৃহত্তম গরুর গোশতের রফতানিকারক।তারা এই খাতে ব্রাজিলকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের আল-দোয়া হলো আরব দেশগুলোতে হালাল/কোশার গোশত রফতানির শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। দুঃখের বিষয় হলো, অনেক ধনী হিন্দুর দুই চেহারা দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রেজিস্ট্রারার অব কোম্পানির তথ্যানুযায়ী, সঙ্গীত সোম হলেন ভারতের সবচেয়ে বড় গরুর গোশত রফতানিকারক। অথচ উত্তর প্রদেশে তিনি একইসাথে গরুর গোশতবিরোধী ক্রুসেডার। মোজাফফরনগরে গরুর গোশতবিরোধী দাঙ্গার জন্য তিনি অভিযুক্ত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, পরে তিনি আইন পরিষদের সদস্য হন বিজেপির টিকেটে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো গোয়াও গরুর গোশত খাওয়া অনুমোদিত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু ও অরুনাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্দু উভয়ে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তারা গরুর গোশত খান। অথচ তাদের এলাকায় গরুর গোশত খাওয়ার জন্য গো-রক্ষকেরা তাদের কিছু বলেন না।
গোরক্ষকদের আক্রোশ থেকে রক্ষা পেতে সমাজবাদী দলের নেতা আজম খান তার গরুর খামার পরিত্যাগ করে মহিষের খামার গড়েছেন। তিনি তার অনুসারীদেরকে পিটিয়ে হত্যা থেকে রেহাই পেতে দুগ্ধ খামার ছেড়ে দিতে বলেছেন।

দেশে ও বিদেশে নানা গরু থিঙ্ক ট্যাঙ্ক
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যখন গরুকে মানুষের সাথে তুলনা করেন, তখন উদারপন্থীরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। তবে এখানেই শেষ নয়, উত্তরা খন্ডের রাজ্য বিধান সভায় গরুকে রাষ্ট্র মাতা হিসেবে ঘোষণা করে।

রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশ চন্দ্র শর্মা সাংবাদিকদের আশ্চর্য করে ঘোষণা করেছেন যে সব চিকিৎসক ভুয়া। গরুর দুধের চেয়ে ভালো কোনো ওষুধ নেই। তিনি গরুকে জাতীয় প্রাণী ঘোষণা করে গরু হত্যাকারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সুপারিশ করেন। তিনি যখন বলেন যে গরু প্রশ্বাসে অক্সিজেন ত্যাগ করে, দেবতা কৃষ্ণের মতোই ময়ুর চিরকুমার, তখন বিজ্ঞানীরা নিশ্চয় হেসেছিলেন।

গরু জবাই ও সংবিধান
প্রাণীর প্রতি নির্দয়তা প্রতিরোধ আইনের ছদ্মাবরণে ভারত সরকার নতুন নতুন আইনপ্রণয়ন করছে। এসব আইনে পশু বাজারে গরু ও মহিষ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।এগুলো গরুর গোশতের ওপর নিষেধাজ্ঞার সমতুল্য। এর ফলে কেরালা, তামিল নাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ হয়েছে। ব্যাপক গণবিক্ষোভ প্রতিরোধ করতে মাদ্রাজ হাইকোর্ট ওই আইন বাস্তবায়ন স্থগিত রেখেছে।

হীরার চেয়েও দামি গোবর
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে গুজরাট বিধান সভায় পাস হওয়া গরু জবাই আইন বহাল রাখে। ওই সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০০৫ সালের রায়ে সব গবাদি পশুর জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাতে এমন কথাও বলা হয়েছিল যে একটি গরুর গোবর বিখ্যাত কোহিনূরের চেয়েও মূল্যবান।

শেষ কথা
গরু জবাই করা বা গরুর গোশত খাওয়া থেকে বিরত রাখাটা অর্থনৈতিক বা সাংবিধানিক কোনোভাবেই সমর্থিত নয়। আসলে আধা ধর্মীয় দাবির কারণে গরুর গোশতের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। গরুর গোশত খাওয়ার জন্য এক মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যার পর এক আরএসএস নেতা গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করা হলে গরু রক্ষার নামে পিটিয়ে হত্যাও বন্ধ হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। কিন্তু এখন বিষয়টি গরু রক্ষার ঊর্ধ্বে ওঠে গেছে। এটি আসলে হিন্দুদের মেরুকরণ ও ভোট সংগ্রহে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সূত্র : গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us