করোনা মহামারী : কিছু পরামর্শ
করোনা মহামারী - ছবি সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় থমকে গেছে সারা বিশ্ব। নিরাপত্তার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী ছুটিতে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে এমন দীর্ঘ অবকাশে মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে, তারা একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতায় ভুগতে পারে। করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছেন। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
সবার করণীয়
১. ধৈর্য ধারণ করা : পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন : ইন্নাল্লাহা মা’আস সাবেরিন, অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ পৃথিবিতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই করোনা মহামারী, লকডাউন, বন্দিদশা সবকিছুই সাময়িক। একদিন পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে। এই মহামারী দুর্যোগের প্রকোপ একদিন দূর হয়ে যাবে, সেদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্ব এই মহামারীর কবল থেকে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অস্থির হওয়া যাবে না।
২.স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা : আধুনিক বিজ্ঞানের মতে,এই ভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সবাইকে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, ঘরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না।
৩. আত্মসমালোচনা ও আত্মপর্যালোচনা : আমাদের হাতে এখন সময় আছে, সুযোগ আছে। এই সময়ে নিজেদের নিয়ে ভাবতে হবে। দোষ কিভাবে শুধরানো যায়, কিভাবে নিজেকে যোগ্য থেকে যোগ্যতম করে তোলা যায়, এসব নিয়ে ভাবার এখনই সুযোগ।
শিক্ষার্থীদের করণীয়
১. রুটিন করে কাজ করা : ঘরে থাকাকালে, এই লম্বা ছুটিতে প্রয়োজনীয় কাজগুলোর একটা রুটিন তৈরি করে নিতে হবে। খাওয়া, ঘুম, গোসলের মতো দৈনন্দিন কাজগুলো নির্দিষ্ট সময়ে করতে হবে। সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে হবে, ছাত্রজীবনে অলসতার স্থান নেই।
২. একাডেমিক পড়াশুনা : বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন বন্ধ আছে। তাই বলে লেখাপড়া থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যাবে না। অনলাইনে এবং টেলিভিশনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে; সেগুলো অনুসরণ করতে হবে। ক্লাসের পড়ার সময় অনেক শিক্ষার্থীর অনেক টপিক ভালো লাগে কিন্তু সময়ের অভাবে, রেজাল্ট ভালো করার টেনশনে পছন্দের ওই টপিকগুলো বিস্তারিত পড়ার সুযোগ হয় না। এই সময়টা একটা সুবর্ণ সুযোগ টপিকগুলো বিস্তারিত পড়ার। শিক্ষার্থীরা ওসব বিষয়ে কয়েকটি বই এবং ইন্টারনেট থেকে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তারা পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে। মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীরা জীববিজ্ঞান পড়তে পারে, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীরা গণিত চর্চা করতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীরা সাধারণ জ্ঞান চর্চা করতে পারে। ইন্টারনেটে বিভিন্ন টপিকের সুন্দর সুন্দর লেকচার পাওয়া যায়, সেগুলো দেখতে পারে। পেছনের পড়া থেকে পছন্দের টপিকগুলো বিস্তারিত জানতে পারে।
৩. ধর্মীয় জ্ঞান চর্চা : এ সময়ে শিক্ষার্থীরা ধর্মগ্রন্থ পড়তে ও চর্চা করতে পারে। বিভিন্ন ধর্মীয় বই পড়তে পারে।
৪.সাহিত্যচর্চা : শিক্ষার্থীরা পছন্দের লেখকের গল্প, কবিতা পড়তে পারে। নিজেরা গল্প-কবিতা লিখতে পারে। ছবি আঁকা চর্চা করতে পারে।
৫. সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করা : হাদিসে আছে : ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপী, পাপীদের মধ্যে তওবাকারীরা উত্তম।’
মহামারী থেকে মুক্তি পেতে বেশি বেশি তওবা করতে হবে এবং মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
৬. মোবাইল ব্যবহারে সংযত হওয়া : মোবাইল ফোন এখন আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে; সবার কাছেই স্মার্টফোন আছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। চরিত্র সুন্দর রাখতে হবে; রাত জেগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সারা দিন ঘুমানো যাবে না। কুরআন, হাদিস, সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে সরে গিয়ে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার করতে করতে নিশাচর ভূত হওয়া যাবে না। মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহারে সচেতন ও সংযত হতে হবে।
শিক্ষকদের করণীয় : গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় যতগুলো উপাদান রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষকের স্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য উপাদানে সামান্য ত্রুটি থাকলেও যোগ্য শিক্ষকরা এই ক্ষতির অনেকাংশ পূরণ করতে সক্ষম। এরকম যোগ্য শিক্ষক হতে হলে শিক্ষকগণকেই সুপরিকল্পিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই অবসর সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে, নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে জ্ঞানচর্চা করতে হবে। একজন শিক্ষক হতে হবে জ্ঞানের আধার। কিভাবে পড়ানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা যায়, এসব নিয়ে ভাবতে হবে। তারা তথ্যসম্বৃদ্ধ কন্টেন্ট/প্রেজেন্টেশন তৈরি করে রাখতে পারেন যেগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।
অভিভাবকদের করণীয় : শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেন অভিভাবকরা যাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে অধিকাংশ অভিভাবক তাদের পোষ্যদের পড়ালেখা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। লকডাউনে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও মানসিক কল্যাণ সাধনে নিঃসন্দেহে অভিভাবকরা দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করতে পারেন। ১. সন্তানদের সময় দিতে হবে। লকডাউনে সন্তানরা কী করছে সেদিকে নজর দিতে হবে। ২. সন্তানদের পছন্দের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ৩. প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় হতে হবে। আপনার সন্তান আপনাকে দেখেই শিখবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীর বুকে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, রোকনউদ্দিন মোল্লা গালর্স ডিগ্রি কলেজ, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।