নাগোরনো-কারাবাখ বিরোধের নেপথ্যে

নাগোরনো-কারাবাখ বিরোধের নেপথ্যে - ছবি সংগৃহীত
নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিরোধ চলছে। এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থা, মাঝে মধ্যে উত্তেজনা তৈরির পাশাপাশি সামরিক সংঘর্ষও হয়েছে।
এই বিরোধ মেটাতে ‘মিনস্ক গ্রুপ’ নামে একটি মধ্যস্থতাকারী দল কয়েক বছর ধরে আলোচনা চালিয়ে আসছে, যাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে নিরাপত্তা ও সহযোগিতাবিষয়ক সংস্থা ওএসসিই। কিন্তু সঙ্কট যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
তুরস্কের বক্তব্য হচ্ছে, এত বছরের কূটনৈতিক চেষ্টা ও রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার পরেও এই সঙ্কটের কোনো সমাধান হয়নি। জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব অনুসারে নাগোরনো-কারাবাখ থেকে আর্মেনীয় বাহিনীকে বিদায় করে আজারবাইজান ওই অঞ্চলের পুনর্দখল করার মাধ্যমে সেখানে স্থিতি ও শান্তি ফিরে আসবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরো সময়ে এই অঞ্চল ছিল আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর এই অঞ্চল আজারবাইজানের অংশ হিসাবেই স্বীকৃত হয়। আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনী ১৯৯২ সালে জাতিগত আর্মেনীয়দের সহায়তায় আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণ থেকে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল দখল করে নেয়। এটি দখলের পর জাতিগত আর্মেনীয়রা এটিকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আজারবাইজান এটি মেনে নেয়নি। আর্মেনিয়াও এলাকাটিকে তাদের দেশের অংশ বলে দাবি করে।
সঙ্ঘাতের ইতিহাস
৪,৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নাগোরনো-কারাবাখের মোট জনসংখ্যা দেড় লাখের মতো। এটি দক্ষিণ ককেশাসের একটি স্থলবেষ্টিত অঞ্চল, কারবাক পাহাড়ি পরিসীমার মধ্যে, নিম্ন কারবাখ এবং জংজুরের মধ্যে অবস্থিত এবং ক্ষুদ্রতর ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পরিসীমাকে আচ্ছাদন করে রেখেছে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগই পাহাড় এবং বনভূমি। নাগোরনো-কারাবাখের পরিবেশ ওক, হর্নিম, এবং বীচবৃক্ষের ঘন বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে কুরার নিম্নভূমির প্রান্তর থেকে আলাদা হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রচুর খনিজ ঝরনা এবং দস্তা, কয়লা, সিসা, সোনা, মার্বেল এবং চুনাপাথরের মজুদ রয়েছে। আঙ্গুর-খেত, বাগান এবং রেশম পোকার জন্য তুঁত গাছগুলো উপত্যকায় গজিয়ে উঠেছে।
নাগোরনো-কারাবাখ আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮৮ সালে কারাবাখ আন্দোলনের সূচনা হওয়ার পর থেকে আজারবাইজান এই অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারেনি। ১৯৯৪ সালে নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান সরকারের প্রতিনিধিরা এই অঞ্চলের বিতর্কিত অবস্থান সম্পর্কে ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা করছে।
সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে, পারস্যে মুসলিম বিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলটি মুসলিম আরবদের দ্বারা জয়লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে এটি খিলাফত কর্তৃক অনুমোদিত স্থানীয় গভর্নরদের দ্বারা বিজিত হয়েছিল। সোভিয়েত যুগে নাগোরনো-কারাবাখ ছিল স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পরে কারাবাখ ট্রান্সককেশীয় গণতান্ত্রিক ফেডারেটিভ রিপাবলিকের অংশ হয়েছিল। পরের দু’বছর (১৯১৮-১৯২০), কারাবাখসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলজুড়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে একাধিক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়।
১৯১৮ সালের জুলাইয়ে, নাগোরনো-কারাবাখে প্রথমে আর্মেনীয়রা একটি জাতীয় কাউন্সিল এবং সরকার গঠন করে। পরে অটোম্যান সেনাবাহিনী কারাবাখে প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পরে ব্রিটিশ সেনারা কারাবাখ দখল করে নেয়। ১৯২০ সালে বলশেভিকরা আজারবাইজানকে দখল করে। ১৯২১ সালে আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়াও বলশেভিকরা দখল করে নেয়। নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ৭ জুলাই ১৯২৩ সালে আজারবাইজান সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৮৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কারাবাখকে আর্মেনীয়রা আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্রের সাথে একীকরণের পক্ষে বিক্ষোভ শুরু করে। ১৯৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর নাগোরনো-কারাবাখে প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটে এবং অঞ্চলটি আজারবাইজানের প্রশাসনে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৮৯ সালে নাগোরনো-কারাবাখের জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯২ হাজার। তখনকার জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ আর্মেনীয় ও রাশিয়ান এবং কুর্দি সংখ্যালঘুসহ ২৩ শতাংশ আজারবাইজানি। ১৯৯১ সালের ২৬ নভেম্বর আজারবাইজান নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলটি প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। তবে ১৯৯১ সালের ১০ ডিসেম্বর নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা একটি ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ গঠনের কথা ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে আর্মেনিয়া থেকে সমর্থন পেয়ে আজারবাইজান এবং নাগোরনো-কারাবাখের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে এই সঙ্ঘাতে হাজার হাজার হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং উভয় পক্ষে কয়েক লাখ শরণার্থী তৈরি হয়। ১৯৯৪ সালের মে অবধি আর্মেনিয়ানরা আজারবাইজানের ১৪% অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং রাশিয়ার আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৪ সালের ১২ মে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছে।
২০০৭ সালের ১৫-১৭ মে ইসলামী সম্মেলন সংগঠনের (ওআইসি) পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী কাউন্সিলের ৩৪তম অধিবেশনে রেজোলিউশন ৭/৩৪-পি গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে আজারবাইজানি অঞ্চল দখলকে আর্মেনিয়ার আগ্রাসন হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং আজারবাইজানি নাগরিকদের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই বছরের ১৪ই মার্চ জাতিসঙ্ঘের গৃহীত সাধারণ অধিবেশন রেজোলিউশন ৬২/২৪৩ এ ‘আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের সমস্ত দখলকৃত অঞ্চল থেকে সমস্ত আর্মেনিয়ান বাহিনীকে তাৎক্ষণিক, সম্পূর্ণ এবং শর্তহীন’ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
২ জানুয়ারি ২০১৬, ইউরোপ কাউন্সিলের সংসদীয় সংসদ (পেইস) কর্তৃক রেজোলিউশন ২০৮৫ গৃহীত হয়। এতে বলা হয়, নাগোরনো-কারাবাখ এবং আজারবাইজানের সংলগ্ন অঞ্চলে আর্মেনিয়ার দখল আজারবাইজানের নাগরিকদের জন্য মানবিক ও পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আজারবাইজানিদের সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে আর্মেনিয়ান সশস্ত্র বাহিনী অবিলম্বে প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয় প্রস্তাবে।