আজারবাইজান যুদ্ধে কেন জড়িয়ে পড়ল তুরস্ক
এরদোগান - আজারবাইজান যুদ্ধে কেন জড়িয়ে পড়ল তুরস্ক
ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে আজারবাইজান তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তুরস্ক বিভিন্ন সময়ে আজারবাইজানকে নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে। নব্বই-এর দশকের শুরুর দিকে যুদ্ধের সময় আজারবাইজানে অস্ত্র ও সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল তুরস্ক। ২০১০ সালে দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তিতে সই করেছে।
এবারের সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর আজারবাইজানের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন প্রকাশ করেছে তুরস্ক। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, আজারবাইজানকে তারা ‘সব ধরনের’ সহায়তা দেবেন। আর্মেনিয়াকে তিনি ওই অঞ্চলে শান্তির জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করে সারা বিশ্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন আর্মেনিয়ার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
তুরস্কের একজন বিশ্লেষক ইলহান উজগেল বলেছেন, ‘তুর্কি সৈন্যরা ফ্রন্ট লাইনে থাকবে না। আজেরি বাহিনীর তাদের প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে, আঙ্কারা সবসময়ই বাকুর সামরিক মিত্র। আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীকে তারা আগে থেকেই সমর্থন দিচ্ছে। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়া ছাড়াও তারা বাকুর কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে তুরস্ক কতটা অগ্রসর হবে সেটা নির্ভর করে রাশিয়ার অবস্থানের ওপর। কারণ দক্ষিণ ককেশাসে আধিপত্য বিস্তার করে রাশিয়া। সে কারণে আঙ্কারা চাইবে না মস্কোর সাথে সরাসরি সামরিক সঙ্ঘাতে জড়াতে। এর পরেও তুরস্কের আজারবাইজানের পক্ষ নেয়ার অন্যতম কারণ হলো জ্বালানি স্বার্থ।
ককেশাসের ওই অঞ্চল জ্বালানির উৎস এবং সরবরাহ ব্যবস্থা- এই দুই কারণেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরের মে মাসে তুরস্ক তার এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস আমদানি করেছে আজারবাইজানের কাছ থেকে। কাস্পিয়ান সাগরে পাওয়া তেলও আজারবাইজান তুরস্কের কাছে বিক্রি করে থাকে। আজারবাইজানের কারণে গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর তুরস্কের নির্ভরশীলতাও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হ্রাস পেয়েছে।
রাশিয়ার সাথে তুরস্কের জ্বালানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালে। আঙ্কারার পরিকল্পনা হচ্ছে, এরপর তারা ট্রান্স আনাতোলিয়ান গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে আজারবাইজান থেকে গ্যাস এনে চাহিদা পূরণ করবে।
এ বছরের জুলাই মাসে আজারবাইজানের তভুজ অঞ্চলে আর্মেনিয়ার সাথে যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়েছিল তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আঙ্কারা। যে পাইপলাইনের সাহায্যে তুরস্কে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তার খুব কাছেই ওই এলাকা। আজারবাইজানের গ্যাস ইউরোপে পাঠাতে হলেও সেটা তুরস্কের ভেতর দিয়ে ট্রান্স আনাতোলিয়ান গ্যাস পাইপলাইনের সাহায্যে পাঠাতে হবে।
এ ছাড়া আজারবাইজানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দুটো দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘এক জাতি, দুই দেশ’ এই নীতিতে বিশ্বাসী। শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পর্যায়ে নয়; তুরস্ক ও আজারবাইজানের সাধারণ জনগণও তাদেরকে ‘একই জাতি’ বলে মনে করে। তুর্কি ও আজেরিরা বিশ্বাস করে যে, তাদের উৎস এক এবং তারা একই রক্ত, ইতিহাস ও সংস্কৃতির উত্তরসূরী।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের একেবারে শেষের দিকেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিল। ১৯১৮ সালে আজারবাইজান আর্মেনিয়া ও রাশিয়ার দিক থেকে আক্রমণের মুখে পড়লে বাকুকে রক্ষার জন্য অটোম্যান সাম্রাজ্য তাদের সামরিক সহযোগিতা দিয়েছিল। তারাই আজারবাইজানকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রথম স্বীকৃতিও দিয়েছিল।
সে সময় আজারবাইজান ও অটোম্যান শাসকদের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে উল্লেখ ছিল যে, নতুন রাষ্ট্রটি যখনই হুমকির মুখে পড়বে তখনই তারা অটোম্যান সাম্রাজ্যের কাছে সামরিক সহযোগিতা চাইতে পারবে। তার পরপরই বাকুকে রক্ষার জন্য সেখানে অটোম্যান বাহিনী পাঠানো হয়েছিল।
পরে ১৯২০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আজারবাইজানের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আজারবাইজান আবার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন এই দেশটিকে স্বীকৃতি দিতে এবারও তুরস্ক বিলম্ব করেনি। তারপর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সবসময় একই রকমের উষ্ণ রয়ে গেছে।
আজারবাইজানকে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এমনকি সামরিক- যেকোনো ধরনের সমর্থন দেয়ার জন্য তুরস্কের রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকেও সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। বর্তমানে এরদোগানের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিসহ প্রধান বিরোধী দলও তুর্কি জাতীয়তাবাদী। উভয়েই আজারবাইজানের পক্ষে। বাকুকে সমর্থন দেয়ার পক্ষে তুর্কি জনগণও। এ বছরের জুন মাসে তুরস্কের কাদির হেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৫ শতাংশেরও বেশি তুর্কি মনে করে যে, আজারবাইজান তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
কত দূর যাবে তুরস্ক
এই যুদ্ধে তুরস্ক কতখানি অগ্রসর হবে সেটা পরিষ্কার নয়। ফ্রান্স আঙ্কারাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, তুরস্কের ‘যুদ্ধংদেহী’ মনোভাব গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মধ্যেও কথা হয়েছে এবং তারা দু’জনেই অনতিবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ওই অঞ্চলে নতুন শক্তি হিসেবে তুরস্কের আবির্ভাব ঘটুক সেটি রাশিয়া না-ও চাইতে পারে। তুর্কি বিশ্লেষক উজগেল বলেন, ‘তুরস্কের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। ককেশাস মূলত রাশিয়ার প্রভাবাধীন অঞ্চল। তারা হয়তো আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে তুর্কি-আজেরি সামরিক অভিযান সহ্য করবে না। তারা যদি সেখানে বড় ধরনের সামরিক সাফল্য আশা করে তাহলে মস্কোর সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে পড়বে।’
আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। সেদেশে রয়েছে তাদের সামরিক ঘাঁটিও। আজারবাইজানের সাথেও মস্কোর সম্পর্ক ভালো এবং দুই দেশের কাছেই তারা অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। ওই অঞ্চলে রাশিয়ার নীতি হচ্ছে- শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করা।
এই যুদ্ধে যদি তুরস্ক জড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটা মস্কোর জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই দক্ষিণ ককেশাসে সামরিক অভিযানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তুরস্ক নিশ্চয়ই রাশিয়ার কথা বিবেচনা করবে। অনেকে মনে করেন, এই যুদ্ধে তুরস্ক হস্তক্ষেপ করলে সেটা রাশিয়ার সাথে সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে। সিরিয়া ও লিবিয়ার ইস্যুতে তাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই কিছু বিরোধ তৈরি হয়ে গেছে। তবে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার বড় একটি স্বার্থসম্পৃক্ততা এবং বোঝাপড়াও রয়েছে। কিছু বিরোধ থাকলেও রাশিয়ার সাথে সিরিয়া বা লিবিয়ায় প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাত তৈরি হয়নি আঙ্কারার। দু’পক্ষই সঙ্ঘাত এড়িয়ে গেছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান ইস্যুতেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে বলে মনে হয় না।
নতুন সমীকরণ
বিরোধপূর্ণ এই অঞ্চলে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আজারবাইজান ‘প্রতিরক্ষা সময়’ শেষ করেছে। তারা আর্মেনিয়ার আক্রমণে জমি হারিয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি প্রথমবারের মতো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্য দিকে আর্মেনিয়া এবার প্রথমবারের মতো প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে।
বর্তমান সঙ্ঘাতটি আজারবাইজানের জন্য নিজেদের রক্ষা তথা ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’। আর্মেনিয়ায় তারা আক্রমণকারী নয়; আজারবাইজানি ভূখণ্ডে সন্ত্রাসবাদী দখলের অবসানের জন্য তারা লড়াই করছে। ফলে নৈতিক অবস্থান আজারবাইজানের অনেক মজবুত।
নাগোরনো-কারাবাখ ১৯৯২ সাল আর্মেনিয়া দখলে নেয়ার পর থেকে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইয়েরেভানকে চারবার এই অঞ্চল থেকে সরে আসার নির্দেশ দেয়, তবে আর্মেনিয়া সরকার তা মানতে অস্বীকার করে।
বাকু বিশ্বাস করে যে, আর্মেনিয়ার প্রায় ৩০ বছরের দখল শেষ করার এবং এর অধিকৃত অঞ্চলগুলো পুনরায় দাবি করার সময় এসেছে। অন্য কথায়, নাগোরনো-কারাবাখ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আজারবাইজান তার সামরিক অভিযান শেষ করবে না। রাশিয়া যদি নীরবতা অবলম্বন করে, বাকুতে সরকার যা চায় তাই পেতে পারে। যদি আজারবাইজান নাগোরনো-কারাবাখকে ফিরিয়ে নিতে পারে এবং এর অঞ্চলগত অখণ্ডতা পুনরুদ্ধার করে তবে ককেশাসের উত্তেজনার একটি উৎস বন্ধ হতে পারে।