করোনায় সু চিকে সুবিধা দিচ্ছে না বিপদ ডেকে আনছে
সু চি -
ভোটারদের সুরক্ষা প্রশ্নে কোভিড ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয়ের মধ্যেই মিয়ানমার পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ভোটাভুটিতে যাচ্ছে। সরকার দৃঢ়ভাবে বলছে, পরিকল্পনা অনুযায়ীই নির্বাচন হবে, এমনকি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতও আসে। মহামারিটি কার্যত মিয়ানমারের বেশির ভাগ এলাকাকে স্থবির করে ফেলেছে, নির্বাচনী কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন স্থগিত করার দাবি তীব্র করছে।
দেশের বেশির ভাগ অংশেই নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ আছে। ভ্রমণ বিধিনিষেধের কারণে মিডিয়া কার্যত নির্বাচন কভার করতে পারছে না, আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কার্যত প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। আর স্থানীয় নজরদারিদের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বেশির ভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল অভিযোগ করছে যে কোভিড সঙ্কট ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)ও এর নেতা আং সান সু চিকে অন্যায় নির্বাচনী সুবিধা দিচ্ছে।
মিয়ানমারের অনেক ভোটার অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে অকুতভয়। তারা ভোট দিতে আগ্রহী। এই প্রেক্ষাপটে অনেক বিশ্লেষক ও কূটনীতিক এই নির্বাচনকে সরকারের ৫ বছরের দায়িত্ব পালনের ওপর গণভোট হিসেবে দেখছেন।
৩১ বছর বয়স্ক মেডিক্যাল সাপ্লাই প্রতিনিধি পো পইন্ট ফাইউ এসএএমকে বলেন, নির্বাচনের দিন ভোট দিতে আমি আগ্রহী। কারণ আমি চাই, আমারে পরবর্তী সরকার যাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বদলে ফেলে, পণ্যমূল্য হ্রাস করে।আমি অবশ্যই এনএলডিকে ভোট দেব। কারণ আমি আশা করি, সু চির পরবর্তী সরকার আমাদের অতি প্রয়োজনীয় ঘাটতিটি পূরণ করবে।
গত সপ্তাহের শেষ দিকেও কোভিডে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। দিনে ২০ জনের বেশি বাড়ছিল, আর এখন দিনে শনাক্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে।থাইল্যান্ড-সংলগ্ন ছোট্ট কায়া রাজ্য ছাড়া সব জায়গায়য় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। অবশ্য সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও সবচেয়ে জনবহুল নগরী ইয়াঙ্গুনে।
এর আগে দুটি কোভিড সংক্রমণ শনাক্ত হলে গত মাসে চীন ইউনান প্রদেশের রুইলি নগরী লকডাউন করে দেয়।এটি হলো মিয়ানমারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ স্থল-সীমান্ত ক্রসিং। এর ফলে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিকে সংক্রমণ যাতে আরো ছড়াতে না পারে, সেজন্য মিয়ানমারের সাথে থাকা দুই হাজার কিলোমিটারের সীমান্তে টহল জোরদার করেছে।
আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের মধ্যে মিয়ানমার এখন চতুর্থ সর্বোচ্চ করোনাভাইরাস সংক্রমিত দেশ। ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার পর এই দেশেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে।
করোনাভাইরাস বিস্তার ঠেকাতে দুই সপ্তাহ আগে ইয়াঙ্গুন কঠোর লকডাউনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। ১০ দন আগে সব অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল করা হয। দেশের প্রধান প্রধান মেট্রোপলিশ- মান্দালয়, রাজধানী নেপিদাও ও ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মহাসড়কগুলোতে চেকপয়েন্ট বসানো হয়।কিছু সুপারমার্কেট ও দোকানপাট খুললেও কর্মঘণ্ঠা সীমিত করা হয়েছে।
ইয়াঙ্গুনে টাউনশিপগুলোর মধ্যে চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লেকজনকে কেবল খাবার কেনা বা চিকিৎসার জন্য বাইরে বের হতে দেযা হচ্ছে। আর সেজন্যও লাগে সরকারি পাস। অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাসা থেকে কাজ করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। পরবর্তী নোটিশ জারি না করা পর্যন্ত সব পোশাককারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সাংবাদিকরা অভিযোগ করছেন, তাদেরকে তাদের বাড়িতে আবদ্ধ রাখা হয়েছে তারা যুক্তি দিচ্ছেন, তাদেরকে অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হো,। বিশেষ করে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারীদেরকে।সব সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের ছাপানো বন্ধ রাখা হয়েছে। অবশ্য ডিজিটাল সংস্করণ চালু রয়েছে।
দেশের কার্যত নেতা ও স্টেট কাউন্সিলর আং সান সু চি নতুন লকডাউন ব্যবস্থা নিয়ে টেলিভিশন বক্তৃতায় বলেন, লোকজনের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার জন্য আমরা এসব আইন জারি করছি না। আমরা চাই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে।
চলতি বছরের প্রথম দিকে কোভিডের প্রথম সংক্রমণের সময় লোকজন বিধিনিষেধ পালন না করলেও সু চির বক্তব্যের পর তা পালন করতে দেখা যাচ্ছে।
তবে দেশের প্রধান বেসামরিক নেতা এবং আবার নির্বাচিত হতে আকাঙ্ক্ষী ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেতার মধ্যে পার্থক্য করা এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এবারের নির্বাচন আসলে কোভিড নির্বাচনে পরিণত হয়ে গেছে।
বিশ্লেষক ও উদ্যেক্তা জাও নাইঙ বলেন, কোভিড নির্বাচনের দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ফেসবুকে তার উপস্থিতি একটি বড় জয়। তিনি সামাজিক মাধ্যম, মিডিয়া, টেলিভিশন, সরকারি সংবাদপত্র- সবখানে আছেন।
তিনি এসএ্মকে বলেন, আর এগুলো নির্বাচনে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও অন্যান্য বিধিনিষেধ আরোপ অবশ্যই নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলবে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন বাড়িতে থাকার আদেশ জারি করে কার্যত নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধই করে দিয়েছেন। এবারের নির্বাচন হবে ডিজিটালভাবে।
বিরোধী দলগুলো অবশ্য ৮ নভেম্বরের নির্বাচন স্থগিত রাখতে বলেছে। বৃহত্তম বিরোধী দল, সামরিক-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিসহ ২০টির বেশি দল নির্বাচন স্থগিত করার জন্য কমিশনের কাছে অনুরোধ করেছে।
তবে এনএলডি নির্বাচনীপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দলের মুখপাত্র মোয়ো নহান্ত স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা না জেনেই যদি নির্বাচন স্থগিত করে দেয়া হয়, তবে সমস্যা আরো বাড়বে। জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সমস্যাসহ রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হবে তখন।
নির্বাচন কমিশনও নির্বাচন স্থগিত করার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা পুরো নির্বাচন স্থগিত করার কোনো পরিকল্পনা করছি না। লোকজন যাতে নিরাপদে ভোট দিতে পারে, ওই ব্যবস্থা আমরা করব।আমরা বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করছি।
তবে করোনাভাইরাস মহামারি এনএলডির জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করছে।২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী, মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে ভারসাম্যের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে মহামারির ফলে নির্বাচনে সরকার সুবিধা পেলেও স্থগিত হলে তা সরকারের জন্য সাংবিধানিক সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে তা যদি জানুয়ারির মধ্যে না হতে পারে।
নির্বাচন যদি যথাযথ সময়ে না হতে পারে, তবে সঙ্কট কিভাবে সামাল দেয়া হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা নেই।সামরিক বাহিনী সমর্থিত প্রধান বিরোধী দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) জানিয়েছে, দীর্ঘ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেলে জরুরি আইন জারি করা প্রয়োজন। আর তাতে সরকারের ওপর ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন আং হ্লাইঙ নির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণ করবেন, তা আং সান সু চি ও তার দলের কাছে কাম্য নয়।
গত ৫ বছরে সরকার দেশের ওপর সেনাপ্রধঅনের নিয়ন্ত্রণ এড়ানোর জন্য অনেক পরিশ্রমে জরুরি অবস্থা জারি এড়িয়ে গেছেন। বস্তুত, সামরিক বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ এড়ানোর জন্য ২০১৫ সালের এপ্রিলে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এনডিসিএসের সভা আয়োজন এড়িয়ে গেছে সরকার।
আসন্ন নির্বাচন প্রায় নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে যাবে। অবশ্য এই নির্বাচন হবে ত্রুটিপূর্ণ। তবে সাধারণ লোকজন আশা করছে, এই নির্বঅচন সত্যিকারের গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুশাসনের পথে এক ধাপ এগিয়ে পাওয়ার পথ দেখাবে।
সূত্র : এসএএম