পানি সম্পর্কে আশ্চর্য তথ্য
পানি সম্পর্কে আশ্চর্য তথ্য - ছবি : সংগৃহীত
এটা খুবই আশ্চর্যজনক বিষয় যে, আমরা নিজেরাই নিজেদের দেহে অন্তত ৫০-৬০ লিটার পানি নিয়ে বসে থাকি! মানুষ যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন তার দেহে ৮০ ভাগ পানি থাকে, ৫০ ভাগ পানি নিয়ে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়? আমাদের প্রতিমুহূর্তের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মিশে থাকে জলীয় বাষ্পাকারে পানি, মাথার ওপর মেঘের ভেতর লাখ লাখ টন পানি, পর্বতশিখরে তুষার-বরফ পানি, বৃষ্টির ফোঁটায়, পৃথিবীর তিন ভাগ সমুদ্র আকারে কোথায় পানি নেই!
আবার এই পানির কারণেই পৃথিবীতে যেমন জীবনধারণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে জীববৈচিত্র্য। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব ।
অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণা থেকেই এই বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। বায়োকেমিস্ট এ ই নিডহ্যাম তার দ্য ইউনিকনেস অব বায়োলজিক্যাল ম্যাটেরিয়ালস বইটিতে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে জীবনের জন্য পানি জরুরি। যদি পৃথিবীতে শুধু কঠিন বা গ্যাসীয় পদার্থ থাকত, তাহলে কোনো জীবই থাকত না। কারণ, শুধু কঠিন পদার্থের অণুগুলো এত ঘন-সন্নিবিষ্ট ও স্থির থাকে যে, তাতে কোনো গতিশীলতা থাকে না। তাহলে প্রাণী বা জীবজন্তু নড়তেচড়তে পারত না, তাদের বিকাশ হতো না কোনো। কিন্তু সেটা প্রাণের সংজ্ঞা নয়। অন্য দিকে শুধু গ্যাস থাকলে তারা এতই তীব্র গতিশীল হতো যে, কোথাও স্থির থাকত না এবং এতেও কোনো জীবের বিকাশ হতো না। কাজেই এই দুটোর মাঝামাঝি কোনো তরল থাকতে হবে, এ ক্ষেত্রে পানি হলো সবচেয়ে আদর্শ তরল।
পানির আছে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য যা জীবনধারণের জন্য খুবই উপযোগী। এই বিষয়টি প্রথম ল করেন ব্রিটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী উইলিয়াম হুইওয়েল। তিনি ১৮৩২ সালে তার লেখা Astronomy and General Physics Considered with Reference to Natural Theology বইতে তা তুলে ধরেন । তিনি পানির তাপীয় বৈশিষ্ট্য পরীা করে দেখতে পান যে, তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতির আইন লঙ্ঘন করে। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, নিশ্চয়ই পানিকে সৃষ্টি করা হয়েছে জীবনের জন্য বিশেষ উপযোগী করে। তারও ১০০ বছর পর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক লরেন্স হেন্ডারসন লিখেন দ্য ফিটনেস অব দ্য এনভায়রনমেন্ট বইটি। এখানে তিনি বলেছেন, পানির তাপীয়, ভৌতিক ও রাসায়নিক কিছু বেশিষ্ট্যের কথা। পানির সেই বিখ্যাত ব্যতিক্রান্ত প্রসারণের কথাই প্রথমে বলা যাক।
সব তরলই তাপমাত্রা হ্রাসের সাথে সাথে আয়তনে সঙ্কুচিত হয় এবং তাদের ঘনত্ব যায় বেড়ে, এক সময় তারা কঠিন পদার্থে পরিণত হয় । ফলে তরলের চেয়ে তাদের কঠিন রূপটাই বেশি ভারী হয়। পানির ক্ষেত্রে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বিষয়টি যে উল্টো অর্থাৎ এর পর থেকে পানির আয়তন প্রসারিত হতে থাকে, এ তো জানা কথাই। এ কারণে অন্য তরল পদার্থগুলো জমে কঠিন পদার্থে পরিণত হলে এতই ভারী হয় যে, নিচে বা তলানিতে অধঃপ্তি হয় । কিন্তু পানি জমে বরফে পরিণত হলে তা তলানিতে অধঃপ্তি না হয়ে উপরিতলে ভাসতে থাকে ওজন কম হওয়ার কারণে।
বরফ যখন গলে বা পানি যখন বাষ্পে পরিণত হয়, তখন তা চারপাশ থেকে তাপ শোষণ করে। একে ঘনীভবন বা বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ বলে । আবার বাষ্প পানিতে পরিণত হলে বা পানি জমে বরফে পরিণত হলে এই সুপ্ততাপ পরিবেশে বা বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। অন্যান্য তরলের তুলনায় পানির সুপ্ততাপ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অ্যামোনিয়া যখন জমে বরফে পরিণত হয়, তার তুলনায় পানির হিমাঙ্কের সুপ্ততাপ কম।
পানির তাপ ধারণ ক্ষমতাও বেশির ভাগ তরলের চেয়ে বেশি।
এর তাপ-পরিচালন ক্ষমতা ও সব তরলের চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি। কিন্তু বরফ ও তুষারের তাপ-পরিচালন মতা আবার তুলনামূলক কম।
এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে পানির এসব বৈশিষ্ট্য জীবজগতে কী এমন কাজে লাগে?
পৃথিবীর অনেক জায়গাই আছে, যেখানে শীতকালে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও নিচে নেমে যায়। যদি পানির ব্যতিক্রান্ত প্রসারণ না থাকত, তাহলে উপরিভাগের পানি ওই তাপমাত্রায় ভারী বরফ হয়ে হয়ে পানির তলদেশে অধঃপ্তি হতো, আর নিচের পানি উপরে উঠে এসে বায়ুমণ্ডলের শীতল তাপমাত্রায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ত এবং আবার বরফে পরিণত হতো। এভাবে প্রক্রিয়াটি চলতেই থাকত যে পর্যন্ত না সব পানি বরফ হতো। তাহলে পৃথিবীতে আর কোনো পানি থাকত না। কিন্তু পানির এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে উপরিভাগের পানি বরফ হলেও তা নিচের তরল পানির ওপর ভাসতে থাকে। এ দিকে বরফ ও তুষারের তাপ-পরিচালন কম থাকার কারণে বরফের আস্তরের নিচের পানি উষ্ণই থাকে। আর বরফের আস্তরের নিচে থাকে তরল পানি এবং তাতে বেঁচে থাকে অন্য প্রাণীরা। এ কারণে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও মেরু অঞ্চলের সিল ও পেঙ্গুইন ঠিকই বরফের নিচের অপোকৃত উষ্ণ পানিতে বেঁচে থাকবে, আর বরফের ১ মিটার স্তরের মধ্যেও থাকবে অসংখ্য ফাটল।
যদি পানি এ রকম অস্বাভাবিক আচরণ না করত, বরং সেও অন্য তরলের মতো আচরণ করত, তাহলে কী হতো? সমুদ্র, নদী বা হ্রদের পানি ক্রমেই বরফ হয়ে নিচে ডুবে যেত, আর নিচের পানি উপরে উঠে আসত। এরাও বায়ুমণ্ডলে তাপ ছেড়ে দিয়ে বরফ হতো, আর নিচে ডুবে যেত। এভাবে সব পানি বরফ হয়ে যেত, আর এদিকে পানির নিচে যেসব প্রাণী থাকে, তারাও বাঁচত না, পানির নিচের জীবজগতের কোনো অস্তিত্ব থাকত না। কী ভয়াবহ ব্যাপার হতো তাহলে!
পানির তাপীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের শরীর ঘামে যা খুবই গুরুত্বপুর্ণ শারীরিক কাজ। কেন? স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রা অল্পবিস্তর কাছাকাছি (৩৫-৪০ ডিগ্রি সে.) । মানবদেহের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা থেকে মাত্র কয়েক ডিগ্রি কমে গেলেও যেমন জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, আবার বেড়ে গেলে তো আমরা সেটাকে জ্বর বলি। ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতে সচরাচর মানুষ মারা যায়। এখন সমস্যা হলো, আমাদের শরীর সবসময় কোনো না কোনো কাজ করতে থাকে যাতে শরীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করতে থাকি, আর তাতে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। আমরা যদি অন্তত ১০ কিলোমিটার দৌড়াই, তাহলে বাড়তি ১০০০ ক্যালরি উৎপন্ন হবে এবং এতে যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হবে আমরা মারা যেতে বাধ্য। কিন্তু আমরা মরি না। কেন? আসলে এটা হয় পানির তাপ ধারণমতার জন্য। পানির বদলে আমাদের শরীরে যদি ৭০ ভাগ অ্যালকোহল থাকত, তাহলে এ অবস্থায় দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যেত ২০ ডিগ্রি, লবণ থাকলে বাড়ত ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আয়রন থাকলে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সিসা থাকলে ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের দেহে ৭০ ভাগ পানি থাকা সত্ত্বেও এই পানি সহজে গরম হয়ে ওঠে না।
পানির বাষ্পীভূত হতে সর্বোচ্চ পরিমাণ সুপ্ততাপ লাগে বলে আমাদের দেহের বিপুল পরিমাণ তাপ শুষে দেহের পানি ত্বকের উপরিভাগে উঠে আসে ঘাম হয়ে। ফলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মাত্র ১ লিটার পানি বাষ্পীভূত হয়ে ঘামে পরিণত হলে দেহের তাপমাত্রা কমে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু তাই নয়, যদি ত্বকের বাইরে ঘাম না জমতো, তাহলে পানি বাষ্পীভূত হলো কী হলো না, তাতে কিছুই আসে যায় না। কেননা এতে দেহের ভেতরে ওই বাষ্প টগবগ করে ফুটতে থাকত, আর আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য জীবন্ত বয়লারে পরিণত হতাম। তার পর আমাদের জীবনের অবসান হতো। তার মানে পানির তাপ-পরিচলন মতাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে যা শরীরের গঠন কাঠামোর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। এ অবস্থা এতই কার্যকরী যে, আবহাওয়া গরম থাকলেও মাঝে মাঝে আমাদের ঠাণ্ডা অনুভব হতে পারে। দেহস্থ পানি উষ্ণ হয়ে ওঠাতে ত্বকসংলগ্ন রক্তনালীগুলো ওই সময় প্রসারিত হয় । এ জন্যই খুব গরম পড়লে আমরা এ রকম লালচে হয়ে যাই ।
আবার আর্দ্র আবহাওয়াতে গরম বেশি লাগে এবং হাঁসফাঁস লাগতে থাকে। দেহের পানি ওই সময় পরিবেশে বা বায়ুমণ্ডলে তাপ ছেড়ে দিতে পারে না বলে তখন খুব কষ্ট হতে থাকে। অনেকে বলেন, মরুভূমিতে আর্দ্রতা না থাকার কারণে তাপমাত্রা যত বেশিই হোক না কেন, গরমে কষ্ট হয় না।
কেনই বা তাহলে পানি অন্য তরলের থেকে দলছুটের মতো আচরণ করে? বিজ্ঞানীরা কেউ তার সদুত্তর দিতে পারেন না।
পানির তাপ ধারণমতা ছাড়াও তার কিছু ভৌতিক গুণাবলি আছে যা জীবনধারণের জন্য অতি জরুরি। যেমন পানির পৃষ্ঠটান অন্য সব তরলের চেয়ে বেশি। পানির এই বৈশিষ্ট্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ জগতের জন্য। উদ্ভিদ বা গাছের শিকড় মাটির যত গভীরে যায়, তত তার শিকড় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। ফলে পানি তার পৃষ্ঠটানের কারণে শিকড়ের মধ্যে প্রবেশ করে কোনো রকম পাম্প বা বাইরের সাহায্য ছাড়াই। একই বৈশিষ্ট্যের কারণে পানি পাথরের সরু খাঁজে প্রবেশ করে। যখন তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়, পানি জমে বরফে পরিণত হয়, তার পর ব্যতিক্রান্ত প্রসারণের সূত্র ধরে বরফের প্রসারণ ঘটে। এই বরফ তখন পাথরের ভেতরে অভ্যন্তরীণ চাপ প্রয়োগ করলে পাথর ফেটে যায়, পাথরের ভেতরের খনিজ বেরিয়ে আসে এবং মাটি গঠন করে যা উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের জন্য খুব জরুরি।
পানির রাসায়নিক গুণাবলির জন্য তা অন্য সব তরলের তুলনায় সর্বোৎকৃষ্ট দ্রাবক। মাটি বা পাথুরে জমির ভেতর সঞ্চিত খনিজ ও এ ধরনের পদার্থ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বেরিয়ে আসে এবং নদীবাহিত হয়ে তা সমুদ্রে গিয়ে মিশে। ধারণা করা হয় যে, প্রতি বছর এভাবে প্রায় ৫ বিলিয়ন টন পদার্থ সমুদ্রের পানিতে মিশে যা সামুদ্রিক জীবের বেঁচে থাকার জন্য সহায়ক হয়।
প্রায় প্রতিটি রাসায়নিক বিক্রিয়াতেই পানি একটি উৎকৃষ্ট অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে পানি সালফিউরিক এসিডের মতো অতিমাত্রায় ক্রিয়াশীল নয়। ফলে ওই এসিড যেভাবে অনুকূল পরিবেশ না পেলে বিক্রিয়াকালে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, পানির ক্ষেত্রে এ রকম আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। একইভাবে পানি আরগনের মতো নিষ্ক্রিয় তরল নয় যা একেবারেই বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োফিজিক্সের অধ্যাপক হ্যারল্ড মোরোইটজ বলেছেন :
প্রোটন-পরিবাহিতা পানির একটি একক বৈশিষ্ট্য যা জীবদেহে জ্বালানি বা শক্তি ট্রান্সফারে রাখে বিশেষ ভূমিকা এবং জীবনের উৎসের জন্যও এই বৈশিষ্ট্য খুবই জরুরি।
সম্প্রতি পানির আয়ন-পরিবাহিতার একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন ফ্রান্সের ইমিউনোলজির এক ডাক্তার জ্যাকুইস বেনভিনেস্তে। তিনি দেখিয়েছেন, পানিতে কোনো আয়ন দ্রবীভূত করে তার ভেতর বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ যদি কম্পিউটারে সংরণ করা যায়, পরে আবার ওই ডিজিটাল তরঙ্গ ফ্রেশ পানিতে চালনা করা হয়, তাহলে এই পানিও আগের আয়নিত পানির মতো আচরণ করবে । এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, পানির স্মৃতি ধারণমতা আছে।
আবার পানির প্রবহনশীলতার কথাই ধরা যাক। তরল পদার্থ মানে যা প্রবাহিত হয়। পানির প্রবহনশীলতা টারের তুলনায় ১০ বিলিয়ন গুণ, গ্লিসারিনের তুলনায় ১০০০ গুণ, জলপাই তেলের তুলনায় ১০০ গুণ ও সালফিউরিক এসিডের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। পানির এই গুণের পাশাপাশি তার রয়েছে আদর্শ viscosity, ভিস্কোসিটির অর্থ হলো আঠালো বা ভারী। আদর্শ ভিস্কোসিটি কথাটিকে ব্যাখ্যা করা যাক। যদি পানির ভিস্কোসিটি একটু কম হতো, তাহলে অতিমাত্রায় প্রবহনশীলতার কারণে মাইক্রোস্কপিক কোনো জীব বা প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত না, ভেসে যেত দেহস্থ পদার্থগুলো। কোষের যে সূক্ষ্ম ও আঠালো গঠন, তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। আবার ভিস্কোসিটি একটু বেশি হলে অতিমাত্রায় জড়তার কারণে কোষ বিভাজন থেমে যেত, মাইটোকন্ড্রিয়ার মতো জটিল ও বড় অণুগুলোর সচলতা থেমে গেলে প্রাণীদেহের বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ত। পুরো জৈবিক কার্যাবলি বন্ধ হয়ে যেত। ভ্রণের বিকাশও হতো না। পানির এই ভৌতিক বৈশিষ্ট্য শুধু কোষের গঠনের জন্যই নয়, বরং রক্ত পরিবহনের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রথম যে আয়াতগুলো কুরআনে নাজিল করেছেন, তা হলো :
‘ইকরা বিসমি...খালাকাল ইনসানা মিন আলাক ।’ (৯৬:১-২)
এখানে ‘আলাক’ শব্দটির প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে যার অর্থ হলো জমাট রক্তবিন্দু যা আসলে পানির একটি সাসপেনসন বা মিশ্রণের মতো। কুরআনে বহু আয়াতে মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, এটিও পানির একটি সাসপেনসন বা দ্রবণের মতো। রক্তকোষ, প্রোটিন ও হরমোন সরিয়ে নিলে রক্তপ্লাজমার অবশিষ্ট ৯৫ শতাংশই হলো পানি।
এক মিলিমিটারের এক-চতুর্থাংশ আকারের যেকোনো জীবেরই একটি কেন্দ্রীয় রক্ত পরিবহন বা সার্কুলেটরি সিস্টেম আছে। কারো আকার এর চেয়ে কম হলে অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছা বা শরীরের বর্জ্য বের হওয়া সম্ভব নয়। হৃৎপিণ্ড এই প্রক্রিয়াকে সচল রাখে এবং তরলাকারে পদার্থগুলো শরীরে পরিবাহিত হয় রক্তের মাধ্যমে। আর তা ঘটে বিভিন্ন নালী ও ধমনীর ভেতর দিয়ে। কৈশিক নালী থেকে ৫০ মাইক্রন (১ মাইক্রন= ১/১০০০ মিমি) দূরের কোনো কোষে অক্সিজেন, পুষ্টি উপাদান ও হরমোন পৌঁছতে পারে না। ফলে ওই কোষ বেঁচে থাকতে পারে না। জীবদেহে এ জন্য অসংখ্য কৈশিক নালী জাল বিছিয়ে থাকে।
মানবদেহের কৈশিক নালীর জাল সোজা করলে ৯৫০ কিমি দীর্ঘ হয়। কোনো কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংসপেশির ১ বর্গ সেমিতে ৩০০০ কৈশিক নালী থাকে। এসব নালীর ব্যাস ৩-৫ মাইক্রন হতে পারে। যদি রক্তকে ওই অতিসূক্ষ্ম নালীর কোনো বিকৃতি না ঘটিয়ে সেসবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে হয়, তাহলে রক্তের তারল্য বা প্রবহনশীলতা যেমন বেশি হতে হবে, তেমনি খুব ভারী বা আঠালো হলেও চলবে না। কেননা তারল্য ও ভিস্কোসিটি পরস্পর বিপরীত আনুপাতিক। মাইকেল ডেন্টন বলেছেন, রক্তের ভিস্কোসিটি আরেকটু বেশি হলে কৈশিক নালীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে হলে প্রচণ্ড চাপের প্রয়োজন হতো এবং দেহের সার্কুলেটরি সিস্টেম ভেঙে পড়ত।
এতক্ষণ পর্যন্ত পানির যে বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচিত হলো, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, পানিকে বিশেষ ডিজাইনে সৃষ্টি করা হয়েছে জীবনের উপযোগী করে। পৃথিবীর তাপমাত্রা, আলো, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, বায়ুমণ্ডল, ভূপৃষ্ঠ সবকিছুই জীবনের জন্য উপকারী, তবে তার সাথে যদি মিশে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি। এত সূক্ষ্ম ডিজাইন কোনো দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেনি, বরং তা সুপরিকল্পিত।
আল্লাহতায়ালা বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহতায়াালা প্রতিটি বিচরণশীল জীবকেই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন।’ (২৪:৪৫)
একইভাবে অন্যত্র বলেছেন,
‘...এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে’ (২১:৩০) । এ কথাটি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, পানিকে আল্লাহতায়ালা জীবনের কারণ ও জীবনের উৎস বানিয়েছেন।