প্রস্টেটের ইনফেকশন : লক্ষণ ও এড়ানোর উপায়
প্রস্টেটের ইনফেকশন : লক্ষণ ও এড়ানোর উপায় - ছবি সংগৃহীত
প্রস্টেট গ্রন্থি আসলে একটি জননগ্রন্থি বা রিপ্রোডাক্টিভ গ্ল্যান্ড, যা শুধু পুরুষ শরীরেই থাকে। ইউরিনারি ব্লাডার বা মূত্রথলির ঠিক নীচে ইউরেথ্রা বা মূত্রনালিকে ঘিরে এই গ্রন্থির অবস্থান। এটি একটি সহায়ক গ্রন্থি। এরা ঘন অর্ধস্বচ্ছ প্রস্টেটিক ফ্লুইড তৈরি করে, যা স্পার্ম বা শুক্রাণু বহন করে। বীর্য বা সিমেনের ৩০ শতাংশই এই প্রস্টেটিক ফ্লুইড।
বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট ডা. পৃথ্বীরাজ ঘোষাল জানালেন, “পঞ্চাশ পেরোনো পুরুষদের শরীরে হরমোনাল ভারসাম্যের সমস্যার জন্য প্রস্টেট গ্ল্যান্ড আকারে বড় হয়ে যায়। এর নাম বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লেশিয়া বা বিপিএইচ। কারও ক্ষেত্রে এতই বড় হয়ে যায় যে, প্রস্রাবথলি থেকে প্রস্রাব নির্গমনের রাস্তার উপরে চাপ পড়ে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। প্রস্রাব চেপে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। প্রস্রাবের গতি কমে যেতে পারে। প্রস্রাব করার পরেও মূত্রথলি পুরো খালি না হয়ে প্রস্রাব জমে থাকে। সেখান থেকে মূত্রথলিতে পাথরও তৈরি হতে পারে। কিডনির উপরে চাপ পড়ে কিডনি ফুলে যেতে পারে। কিডনি ফেলিয়োরও হতে পারে। প্রস্রাবে সংক্রমণের ফলে রক্তও পড়তে পারে। তবে শুধু যে পঞ্চাশ পেরোলেই প্রস্টেটের অসুখ হয়, তা কিন্তু নয়। কম বয়সেও প্রস্টেটের ইনফেকশন হতে পারে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় প্রস্টেটাইটিস বলে। এর ফলে প্রস্রাবে জ্বালা, রক্তক্ষরণ, পুঁজনিঃসরণ, জ্বর এই সব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যৌন সংক্রমণ বা সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড রোগের ক্ষেত্রেও এমন দেখা যায়।”
তবে শুধু সংক্রমণ বা আকারে বড় হয়ে যাওয়াই নয়, প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের অসুখের একটি তৃতীয় ধরনও আছে। তা হল প্রস্টেট ক্যানসার। ডা. পৃথ্বীরাজ ঘোষাল বললেন, “একজন পুরুষ মানুষের শরীরে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত যত ধরনের ক্যানসার হতে পারে, তার মধ্যে বিশ্বের পরিসংখ্যান বলছে, প্রস্টেট ক্যানসারের হার সবচেয়ে বেশি। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতার যথেষ্ট অভাব ছিল। ফলে ধরা পড়তে অনেকটাই দেরি হয়ে যেত। তখন আর কিছু করার থাকত না। বর্তমানে কিছু উপায় আছে যাতে গোড়ার স্টেজে প্রস্টেট ক্যানসার ধরে ফেলা যায়। ইউরোলজিস্টরা কিছু ম্যানুয়াল পরীক্ষা, যেমন ডিজিটাল রেক্টাল এগজ়ামিনেশন বা ডিআরই, তার পর প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন বা পিএসএ নামক রক্তপরীক্ষা দ্বারা আন্দাজ করতে পারেন প্রস্টেট ক্যানসারের আশঙ্কা আছে কি না। এই দুটি টেস্ট এবং বায়োপসি করে যদি এমন আর্লি স্টেজে ক্যানসার ডিটেক্ট করা যায়, যখন ক্যানসার প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের ভিতরেই আটকে আছে, বাইরে ছড়াতে পারেনি, তখন অপারেশন কিংবা রেডিয়েশন বা এ রকম একাধিক উপায়ে সম্পূর্ণ রোগ নিরাময় করা সম্ভব।” কাজেই মানুষকে সচেতন হতে হবে। প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের কোনো সমস্যা বা অসুবিধে টের না পেলেও একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর নিয়মিত চেকআপ করানো জরুরি। সাধারণত এই বয়সটি ৫০। কিন্তু বিদেশে অনেক ক্ষেত্রে, রক্তের সম্পর্কে কারও যদি প্রস্টেট ক্যানসার হয়, তবে ৪৫ বছর বয়স থেকেই প্রস্টেট ক্যানসারের স্ক্রিনিং টেস্ট করার পরামর্শ দেয়া হয়।
রিস্ক ফ্যাক্টর কোনগুলো?
ডা. পৃথ্বীরাজ ঘোষালের কথায়, “ডায়াবেটিস, একাধিক পার্টনারের সঙ্গে যৌন সংসর্গ, বিভিন্ন নেশা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ফলে প্রস্টেটের ইনফেকশন হতে পারে। কিন্তু বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লেশিয়ার ক্ষেত্রে সে রকম রিস্ক ফ্যাক্টর কিছু নেই। এটা সকলেরই হয়, কারও বেশি, কারও কম। আজ থেকে তিন-চার দশক আগেও বিপিএইচ-এর ক্ষেত্রে সে রকম ভালো ওষুধপত্র ছিল না। মানুষ তখন খুব কষ্ট পেতেন, অপারেশনের দ্বারা আরোগ্য হতো। কিন্তু এখন অনেক ভালো ওষুধপত্র বেরিয়েছে। দেখা যায়, শতকরা ৭৫-৮০ জনই ওষুধ খেয়ে ভালো থাকেন। বাকি যাদের ক্ষেত্রে অন্য কোনো জটিলতা থাকে, ফলে ওষুধে ফল পাওয়া সম্ভব হয় না, তাদের ক্ষেত্রে অপারেশন প্রয়োজন হয়।”
প্রস্টেটের অসুখের লক্ষণ
প্রস্টেট বৃদ্ধি খুব ধীরে হলেও প্রথম থেকে কিছু কিছু পরিবর্তন অনুভব করা যায়। প্রস্রাব নির্গমনের বেগ দুর্বল হয়ে পড়ে। কখনো আবার বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সরু ধারায় প্রস্রাব হতে থাকে। কখনো প্রচণ্ড বেগ আসার পরেও টয়লেটে গিয়ে প্রস্রাব শুরু হতে দেরি হয়। প্রস্রাব কখনো কিছুটা হয়, বন্ধ হয়, আবার হয় এবং শেষে ফোঁটায় ফোঁটায় চুঁইয়ে পড়ে। সেই কারণে প্রস্রাব করতে অনেক বেশি সময় লাগে। প্রস্টেট খুব বেশি মাত্রায় বাধা দান করলে প্রস্রাব করতে খুব কষ্ট হয়। মূত্রনালির পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
“একেবারে আর্লি স্টেজে প্রস্টেট ক্যানসারের কিন্তু কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না,” বললেন ডা. ঘোষাল, “আবার পরবর্তী স্টেজে প্রস্টেট ক্যানসারের অনেক লক্ষণ কিন্তু বিপিএইচ-এর মতোই। যেমন, প্রস্রাবের বেগ সামলাতে না পারা, বারবার প্রস্রাব, রাতেও তিন-চারবার উঠে প্রস্রাব করতে যাওয়া ইত্যাদি। এগুলোকে বলে স্টোরেজ বা ইরিটেটিভ সিম্পটম। আবার অন্য আর-এক ধরনের লক্ষণ হলো অবস্ট্রাকটিভ সিম্পটম। এতে প্রস্রাবের গতি কমে যায়, ধারা স্বাভাবিকের চেয়ে সরু হয়ে যায়। এক-এক বারে পুরো প্রস্রাব করাও সম্ভব হয় না, জমা থেকে যায়। বারবার সংক্রমণ হওয়া, প্রস্রাবে জ্বালা কিংবা রক্তক্ষরণ এ সবও হতে পারে।”
সায়েন্স ম্যাগাজিনের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে দেখতে পাওয়া যায়, টম্যাটোর লাইকোপিন প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি রোধ করে। কিংবা ঢেঁড়শ সিদ্ধ করে পানি খেলে প্রস্রাবের গতি স্বাভাবিক থাকে। এই বিষয়গুলো সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণিত নয়। স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, নেশা না করা, যথেষ্ট পানিপান এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি নির্দিষ্ট বয়স থেকে নিয়মিত ব্যবধানে পুরুষদের জন্য প্রস্টেট চেকআপও জরুরি। সাবধানে থাকাই সুস্থ থাকার অন্যতম শর্ত।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা