মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের ভূমিকা
এরদোগান - ছবি সংগৃহীত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানী সাম্রাজ্যের (অটোমান এম্পায়ার) মিত্ররা ওসমানী সাম্রাজ্যের ওপর ‘ট্রিটি অব সেভর্স’ চাপিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এই চুক্তিটি একটি জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ককে ধ্বংস করে দেয়। মোস্তফা কামাল পাশার (পরে ‘আতার্তুক’ নামে পরিচিত) ‘জাতীয়তাবাদী সরকার’ এই চুক্তিকে স্বীকৃতি দেয়নি। গ্রিকদের ওপর তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের বিজয় লাভের পর এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওসমানী সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করে আতার্তুকের সরকার একটি নতুন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে অনুরোধ জানানোর সুযোগ পায়। সেভর্স চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী এবং ইউএসএসআর’র প্রতিনিধিরা (আগের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে) সুইজারল্যান্ডের লুজনে বৈঠকে মিলিত হন।
দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর ১৯২৩ সালে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯২৩ সালে এই লুজন চুক্তি অনুযায়ী আধুনিক তুর্কি ‘প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওসমানী সাম্রাজ্যের অধিকারের বিরুদ্ধে ব্রিটেন বেশ কয়েকটি অসৎ অন্যায্য ও বেদনাদায়ক শর্তারোপ করেছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খেলাফতের বিলুপ্তি এবং খলিফা ও তার পরিবারকে তুরস্কের বাইরে নির্বাসনে পাঠানো এবং তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া। এসব শর্ত ছাড়াও তুরস্ককে তেল ক্ষেত্র আবিষ্কারের পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে বিরত রাখার শর্তারোপ করা হয়। আর বসফোরাস প্রণালীকে একটি আন্তর্জাতিক করিডোর হিসেবে বিবেচনা করতে বলা হয়। উল্লেখ্য, বসফোরাস প্রণালী কৃষ্ণসাগর এবং মারমারা সাগরের সংযোগ স্থাপন করেছে। এরপর বসফোরাস একটি আন্তর্জাতিক করিডোর হিসেবে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে। বলা হলো, বসফোরাস প্রণালী দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজ থেকে তুরস্ক কোনো ফি বা ট্যাক্স নিতে পারবে না।
তুর্কিরা কখনো ট্রিটি অব লুজন বা লুজনের চুক্তিকে ভুলতে পারবে না। কারণ এই চুক্তির মাধ্যমে আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রের ভূগোলকে বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তুরস্ককে তার মালিকানাধীন একটি বিশাল ভূখণ্ড পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা তুরস্ক এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে চলমান মতপার্থক্যের কিছু বিষয় বুঝতে পারি। পশ্চিমা দেশগুলোর আশঙ্কা, চুক্তিটি বলবৎ না থাকলে তুরস্ক মসুলে হস্তক্ষেপ করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে। তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইরাকের মসুল না হারানো পর্যন্ত সেটির ওপর চার শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তুরস্কের মালিকানা ছিল।
তাহলে চুক্তিটি যথাস্থানে থাকলে অর্থাৎ কার্যকর থাকলে কী ঘটবে? মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তুরস্ক এখনো গতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে- সময়ের এটা একটা অপরিহার্য দাবি।
বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলো সন্ত্রাসবাদ এবং গৃহযুদ্ধসহ বহু হুমকির মোকাবেলা করছে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আমাদের বাজার, মসজিদ এবং স্কুলগুলোকে রক্তাক্ত করছে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে। মুসলমানরা এখন ক্ষমতাহীন, নিষ্ক্রিয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে তাদের যথাযথ কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। মুসলিম বিশ্বের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ কোনো অগ্রাধিকার নেই। বিশ্বের জনসংখ্যা বিবেচনায় জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের গঠন ও কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার অনুকূল সম্পর্কের বাইরে গিয়েও তুরস্ক এসব দেশকে ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে কারিগরি, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ভিত্তিতে সহযোগিতা করার জন্য পরামর্শ দিতে পারে। ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সব মুসলিম দেশকে ‘আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস’ পালনের জন্য দাঁড়াতে হবে এবং সোচ্চার হতে হবে ক্রমবর্ধমান মুসলিমবিরোধী সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে। মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে সব মুসলিম দেশকে যৌথ মিডিয়া ও যোগাযোগ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উগ্র ডানপন্থী চরমপন্থীরা পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিমবিরোধী হিংসাবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা দায়েশ এবং আল কায়েদাকে তাদের এসব অপকর্মকে বৈধ করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সব মুসলিম দেশকে অবশ্যই ইসরাইলের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে একটি সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। ফিলিস্তিনি জনগণের বসবাস এবং শান্তিতে কাজ করার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে ইসরাইল বিশ্ব এবং ওই অঞ্চলের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলেছে। ইসলামী বিশ্বের সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে ঐক্য, সংহতি এবং জোট গঠন। যত দিন আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, তত দিন সব সমস্যার সমাধান করতে পারব। মুসলিম হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকলে আমরা এক শতাব্দীরও দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের একাকিত্বের অবসান ঘটাতে পারব। তুর্কি নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হলে ইরাকের রক্তপাতের অবসান ঘটানো এবং সিরীয় ও কাশ্মিরি শিশুদের মৃত্যু বন্ধ করা সম্ভব হবে।
‘দ্য নেশন’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার