জাতিসঙ্ঘে যেভাবে এলো ভেটো ব্যবস্থা
জাতিসঙ্ঘে যেভাবে এলো ভেটো ব্যবস্থা - ছবি সংগৃহীত
জাতিসঙ্ঘ কেমন ধরনের প্রতিষ্ঠান আর কী তার ক্ষমতার এখতিয়ার ও সীমা? এ নিয়ে সাধারণ্যে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে, এমনকি সরকারপ্রধান বা অনেক দেশের একাডেমিক পর্যায়েও।
সাধারণত কোনো পাবলিক প্রতিষ্ঠান আর সাম্য ধারণাটা প্রায় হাত ধরাধরি করে চলে। এজন্য সংগঠন বা সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান মানেই তা মাস (ইংরেজি মাস বা বাংলায় গণ) অর্গানেইজেশন বলে ধরে নেয়া হয়। আর গণসংগঠন মানেই সেখানে সদস্যরা সবাই সমান; এমন সাম্যতার আবহাওয়া সেখানে বজায় থাকে বলে সবাই মেনে নিয়ে থাকে। গণপ্রতিষ্ঠান মানেই সবাই সেখানে সমান- এটা আধুনিক কালের ধারণা। কিন্তু এটার আসল মানে কী?
তা হলো, যখন রাজা বা সম্রাটের শাসনের দিন সমাপ্ত হয়ে পাবলিক বা জনগণের শাসন বলে ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। কোনো ব্যক্তি বা রাজা নয়, সব রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস পাবলিক, এ কথা যেখানে সবকিছুর শুরু। পাবলিকের রাষ্ট্র হলো সমাজের সবচেয়ে বড় বা প্রধান গণপ্রতিষ্ঠান। তাই ব্যক্তি বা রাজার খামখেয়ালি না, পাবলিক আর পাবলিকের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব দিয়ে এখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। অন্তত হওয়ার কথা।
এই সূত্রে যেখানে পাবলিকের রাষ্ট্র বা রিপাবলিক কথাটা এসে গেছে সেখানে রাষ্ট্রসহ যেকোনো গণপ্রতিষ্ঠান মানেই ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিক সবাই সমান, এমন বৈষম্যহীনতার এক সাম্য ধারণা ও নীতি বজায় থাকতে হবে। এই বিচারে তাহলে ১৯৪৫ সালে জন্মের কালে জাতিসঙ্ঘ সব সদস্য রাষ্ট্রই সমান এমন ধারণার ভিত্তিতেই একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে। যেমন- সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সবার সমান আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘেরই আরেকটা ফোরাম আছে নিরাপত্তা পরিষদ সাম্যনীতির ফোরাম নয়। তাহলে কী এটা পাবলিক প্রতিষ্ঠানের নীতি ভঙ্গ করে গড়া হয়েছে? জবাব হবে, না। ঠিক তা নয়; আর সেটা জরুরিও নয়। তাহলে? ব্যাপারটা কী, কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করব?
আমরা অনেক ফতোয়া পাবো এ বিষয়ে, এমনকি অনেক একাডেমিক প্রতিষ্ঠানেও; যেখানে হয়তো স্টুডেন্টরা শিখছে- জাতিসঙ্ঘ অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। প্রথমত ‘গণতন্ত্র’ খুব ভালো শব্দ নয়, বরং চাতুরীর শব্দ।
পাবলিকের ক্ষমতার রাষ্ট্র বা রিপাবলিক ধারণার বিকল্প বা সমতুল্য ধারণা ‘গণতন্ত্র’ নয়। যেমন এতে অনেকে ‘দেশে নির্বাচন হয় অতএব গণতন্ত্র আছে’ টাইপের কথা বলে রিপাবলিক ধারণাকে তাৎপর্যহীন করে ফেলতে পারে। তাই এখানে দুটি পয়েন্টে কথা বলব।
প্রথমত, ব্যাপারটা ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রবিষয়ক; আর আমরা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে একাকার করে দেখছি। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই এক করে দেখলেও কোনো ভুল হয় না, এ কথাও সত্যি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল হয় ও হবেই। লক্ষ্যণীয়, আমরা নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ে কথা বলছি মানে এটা রাষ্ট্রের ভিতরের বা অভ্যন্তরীণ দিক নিয়ে কথা বলছি না, বলছি রাষ্ট্রের বাইরে বা ঊর্ধ্বের বিষয় নিয়ে। রাষ্ট্রের বাইরে বা ঊর্ধ্বের বিষয় মানে এখন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কথা খেয়াল রেখে তা লঙ্ঘন যাতে না হয় এভাবে কথা বলতে হবে। সোজা কথাটা হলো, জাতিসঙ্ঘ বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কোনো সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন এমনটা বুঝে নিয়ে, এখানে নেয়া সবার সিদ্ধান্ত কী কোনও সদস্য রাষ্ট্রের ওপর প্রয়োগ করা যাবে? কারণ তা করতে গেলে তো ওই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হবে? এজন্য, যেকোনো রাষ্ট্রের ওপর আরেক রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগুলোর কোনো সিদ্ধান্ত যেমন কার্যকর মনে করা যায় না, তেমন জাতিসঙ্ঘেরও। (তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে করা যায়।) কাজেই ব্যক্তিদের নিয়ে একটা সমিতি আর রাষ্ট্রগুলোর কোনো সমিতি একই ধরন বা মর্যাদার নয় বা সমতুল্য নয়। তাই, এখানে এসে রাষ্ট্র আর ব্যক্তি একাকার করে দেখা যাবে না, ভুল হবে।
তাহলে কী জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সদস্য রাষ্ট্রের ওপর প্রযোজ্য নয় বা করা যাবে না? তাহলে হয়ে আছে কী করে? সেটা বুঝার জন্য সার্বভৌমত্ব কথাটা খেয়াল রেখে একটা কায়দা করা হয়েছে সেদিকে তাকাতে হবে। যেমন ধরা যাক, সব রাষ্ট্র বসে কোনো নতুন আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশন তৈরি করলো। বাংলাদেশের প্রতিনিধি ধরা যাক তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শেষে ওই দলিলে স্বাক্ষর দিয়ে এলেন। এখন ওই আইন মানতে বাংলাদেশকে বাধ্য করানো কী যাবে? কারণ সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই জটিলতা এড়িয়ে যেতে বা এ থেকে বিরত থাকতে যা করা হয় তা হলো, ওই মিটিংয়ে গৃহীত ওই আইন বা কনভেনশনটাই এবার দেশে নিয়ে এসে সরাসরি আমাদের সংসদে পেশ করা হয়। যেন আমরা আমাদের সংসদে কোনো প্রস্তাব পেশ করছি এভাবে। সেই প্রস্তাব আমাদের সংসদে পাস হওয়ার পর সেটা আর জাতিসঙ্ঘের আইন বা কনভেনশন বলে বাংলাদেশ মেনে চলছে এমন নয়। সেটা আমাদের সংসদে পাস হওয়া আইন (এটাকেই র্যাটিফিকেশন বা অনুসমর্থন করে নেয়া বলে) বলেই আমরা তা মানতে বাধ্য হবো। আর এই হলো সার্বভৌমত্ব বাঁচিয়ে আর জাতিসঙ্ঘের সাথে দেশের সম্পর্ক রক্ষার সমাধান।
দ্বিতীয় পয়েন্ট : আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১৯৩৩-১৯৪৫ সালের এ সময়ে একনাগাড়ে চারবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জাতিসঙ্ঘের আইডিয়া বা ইমাজিনেশনের উদ্গাতা মূলত তিনি। এর পেছনের কারণ, তিনি হলেন সেকালের কলোনি শাসন বিলুপ্ত করে দেয়ার পক্ষের লোক যাতে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে আমেরিকান পুঁজিবাজারের ঋণখাতক বা ক্রেতা হয়ে ওঠে। যাতে দুনিয়ায় কলোনি দখল শাসনের চেয়ে এক বেটার স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কাজে তিনি যুদ্ধের বিপক্ষে বা আইন-কনভেনশন তৈরি করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে স্বার্থ বিরোধ মীমাংসার ব্যবস্থা হিসেবে জাতিসঙ্ঘ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার পক্ষের লোক। কারণ যুদ্ধে পুঁজি-সম্পদ বিনষ্ট হয় মারাত্মক, এখান থেকে তিনি সরতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সেকালে তার প্রস্তাব আমেরিকার অধস্তন হয়ে পড়া তখনকার ইউরোপ মেনে নিলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিন তা মানতে চাননি। স্তালিনের সোজা আপত্তির দিকটা ছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাষ্ট্রের ভিত্তিতে চলে এমন এক জাতিসঙ্ঘ গড়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হিসেবে আমেরিকা যদি তা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তখন কী হবে?
আবার সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত রাষ্ট্র ওর ঊর্ধ্বে বা বাইরের কারো সিদ্ধান্ত (জাতিসঙ্ঘ বলে) কেন বাধ্য হয়ে মানবে? অতএব স্তালিন তা একেবারেই মানতে নারাজ।
এই জটিলতা সমাধান করতেই আসে ‘ভেটো’ সিস্টেমের আইডিয়া। এর সোজা মানে হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই ভেটোওয়ালারা একজনও যদি আপত্তি করে তবে সেটা সিদ্ধান্ত হতে পারবে না। সেজন্য এটা আলাদা করে নিরাপত্তা পরিষদ এখানে পাঁচ রাষ্ট্রের একটিও যদি আপত্তি করে তাতে আলোচনা প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাবে। তবে এটা গেল ভেটো ব্যবস্থার নেগেটিভ দিক থেকে ব্যাখ্যা। উল্টা ইতিবাচক করে বলা যায়, দুনিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে পাঁচটা পরাশক্তি বা বিশেষ রাষ্ট্র একমত না হলে সেটা নিয়ে এবার সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত হতে পারবে না। সবার আগে পাঁচটা বিশেষ রাষ্ট্রের একমত হওয়া, এক দিকে থাকাই মূল। এই আইডিয়া হাজির করেই রুজভেল্ট স্তালিনকে নিজের নৌকায় তুলতে পেরেছিলেন, জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়িত হয়েছিল।