বিপদে ধৈর্যধারণ : কেন করবেন, কিভাবে করবেন
বিপদে ধৈর্যধারণ : কেন করবেন, কিভাবে করবেন - ছবি সংগৃহীত
‘তোমাদের কি এমন ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনো তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি? তাদের বিপদ ও দুঃখ স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও প্রকম্পিত হয়েছিল; এমনকি রাসূল ও বিশ্বাস স্থাপনকারীরা বলেছিলেন, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? সতর্ক হও, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।’ (সূরা বাকারা : ২১৪) আল্লাহতায়ালা মানব জাতি সৃষ্টি করে তাদের হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন এবং বিশ্বাস স্থাপনের পর তারা আল্লাহ ও তার বিধিবিধানকে কী পরিমাণে ধারণ করেছিলেন সে লক্ষ্যে আল্লাহ তাদের বিভিন্ন উপায়ে পরীক্ষা করতেন। আল্লাহর যাচাই-বাচাই প্রক্রিয়া থেকে কেউ অবকাশ পায়নি বরং মানব জাতির ওপর এটি তার চিরন্তন ধারা। আদম সন্তানকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বস্তুত এসব পরীক্ষা সম্পর্কে তিনি আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন।
বান্দাদের এরূপ পরীক্ষা করার ব্যাপারে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।’ (সূরা বাকারা : ১৫৫) আল্লাহ তার বান্দাদের কখনো পরীক্ষা করেন উন্নতি ও মঙ্গলের দ্বারা, আবার কখনো অবনতি ও অমঙ্গলের দ্বারা। যেমন, আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন; যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?’ (সূরা মুলক : ০২) মানুষ যখন সত্য পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে নানা রকম পাপাচার ও খোদাদ্রোহে লিপ্ত হয় তখন সুনিশ্চিতভাবেই তারা ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষিত হয়। যেমন- আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তখন আল্লাহ তাদের তাদের কৃতকর্মের কারণে ক্ষুধা ও ভীতির স্বাদ আস্বাদন করালেন।’ (নাহল : ১১২)
এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অবাধ্য সম্প্রদায়কে বিভিন্ন বিপদ ও শাস্তি দানের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন। কোনো জাতি যতক্ষণ ইসলামের পথে ছিল ততক্ষণ আল্লাহ তাদের শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান করে রেখেছিলেন; আবার যখন কোনো জাতি আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছে, তারা আল্লাহর অভিশাপ ও গজবের পাত্রে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো জনপদ ধ্বংস করার আগে আমি সেখানকার বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের সৎকর্ম করার নির্দেশ দেই। কিন্তু তারা আমার আদেশের অবাধ্য হয়ে অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়। তখন ন্যায়সঙ্গতভাবেই আজাবের ফয়সালা হয়ে যায় এবং তারা ধ্বংস হয়।’ (বনী ইসরাঈল : ১৬) আল্লাহর ক্রোধ পতিত হয়েছিল নুহ আ:-এর অবাধ্য লোকদের ওপর; আ’দ, সামুদ, কওমে লুতের ওপর। তিনি ধ্বংস করেছেন কারুন, নমরুদ ও ফিরআউনের অনুসারীদের এবং অবাধ্যতার কারণে কঠিন শাস্তি প্রদান করেছেন বনী ইসরাঈলদেরও।
স্বভাবত সবার ওপরই নিশ্চিতভাবে বিপদাপদ আপতিত হয়। ‘হে মানুষ! তোমাদের কর্মের প্রতিক্রিয়াতেই জলে-স্থলে বিপর্যয় ও বালা-মুসিবত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন তোমাদের কৃতকর্মের ফল কিছুটা আস্বাদনের সুযোগ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা পেয়ে সৎপথে ফিরে আসতে পারো।’ (সূরা রুম : ৪১) তবে তা মুমিনদের জন্য শাস্তি বা গজব নয়; বরং পরীক্ষা স্বরূপ। যেখানে ধৈর্য যাচাই করা হয়, যা সান্ত¡না ও সফলতা লাভের উত্তম উপকরণ। বিপদে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের জন্য সহজতর। আল্লাহ যেহেতু সবার পরীক্ষা নিবেন, সুতরাং সম্ভাব্য বিপদগুলোকে অপ্রত্যাশিত না ভেবে সুসংবাদের অপেক্ষা করা। তারাই ধৈর্যশীল যারা বিপদে পতিত হলে বলে সব অবস্থাতে আল্লাহ আমাদের নির্ভরতা ও প্রকৃত আশ্রয়, সুখ-দুঃখ সব তারই হাতে এবং তার দিকেই ফিরে যেতে হবে। এতে তারা অসীম সওয়াব ও আন্তরিক শান্তিলাভ করে এবং বিপদ থেকে উত্তরণও সহজ হয়। বিপদ-আপদ বা বিভিন্ন উপায়ে আল্লাহর পরীক্ষাগুলো আত্মশুদ্ধির পথ উন্মুক্ত করে দেয়; বিশেষ করে আল্লাহ যখন মানুষের জীবন প্রদীপকে শঙ্কা ও সঙ্কটে ফেলেন। তখন মানুষ কৃতকর্ম নিয়ে ভাবতে শুরু করে। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বিপদ-বিপর্যয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু বেড়ে যায়; চার দিকে মৃত্যুর ধ্বনি বেজে ওঠে, বাঁচার কোনো পথ অবশিষ্ট থাকে না; যখন কুরআনের কথা স্মরণে আসে- ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও মৃত্যু তোমাদের পাকড়াও করবেই’ (সূরা নিসা : ৭৮); তখন স্বীয় রবের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতির লক্ষ্যে জ্ঞানীরা তাদের আমলকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ গ্রহণ করেন।
আল্লাহ বলেন, ‘সে-ই সফল হয়েছে যে নিজের নফসকে (পাপ-পঙ্কিলতা থেকে) পরিশুদ্ধ করেছে।’ (সূরা শামস : ১০) রাসূল সা:কে প্রশ্ন করা হলো- দুনিয়াতে বুদ্ধিমান ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যারা বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করে এবং তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। (মুজামুল কবির) । পরিশেষে, বিপদাপদ মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করে দেয়; তার ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। মুমিনগণ পরীক্ষার মুখোমুখি হবে, ধৈর্যশীল হবে এবং আল্লাহর সুসংবাদের জন্য প্রহর গুণবে। রোগ-ব্যাধি পরকালীন যাত্রার কথা মনে করে দেয়; পরকালীন পাথেয়গুলো বিশুদ্ধতার নিরিখে পরিমাপের সুযোগ সৃষ্টি হয়; ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনত্তোর উত্তম আমল করে মহান বিচারকের ক্ষমা ও রহমতের আশায় প্রস্তুতি গ্রহণ করাই ইমানের দাবি।
শিক্ষক, ইসলাম শিক্ষা, কে সি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দক্ষিণ খান, ঢাকা।