ভারতে কি নাগা সমস্যার সমাধান হবে?
ভারতে কি নাগা সমস্যার সমাধান হবে? - ছবি : সংগৃহীত
নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের (এনএনসি) নেতৃত্বে নাগাল্যান্ড ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। দিনটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রশাসনের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের মাত্র এক দিন আগের। তারপর ১৯৫১ সালে তারা গণভোটের আয়োজন করে, ৯৯.৯ ভাগ নাগা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। নাগাল্যান্ড ১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি নাগাল্যান্ড সংবিধান গ্রহণ করে, ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এমএনসির ওই সময়ের সভাপতি এ জেড ফিজো নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রতি অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক সমর্থনের জন্য আন্তর্জাতিক সফরে বের হন।
এর বিপরীতে ভারত সরকার নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাকে তার জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকি মনে করতে থাকে। নাগা বিদ্রোহের জবাবে ভারতীয় নেতারা সামরিক নীতি গ্রহণ করে, সাবেক ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেসাই কোহিমা সফরকালে নাগা নেতৃত্বকে হুঁশিয়ার করে দেন : ‘আমি কোনো ধরনের করুণা ছাড়াই সব নাগাকে নির্মূল করে দিতে পারি।‘ ইন্দিরা গান্ধীও একই ধরনের নীতি অবলম্বন করে বলেন যে তিনি ইন্দো-নাগা ইস্যুতে কোনো ধরনের ছাড় দিয়ে ভারতের সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করবেন না।
সাত দশক ধরে চলা নাগা বিদ্রোহ হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের সব বিদ্রোহের জননী। বলা নিষ্প্রয়োজন, মানবাধিকার লঙ্ঘানের সমাধান এবং একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্ব ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য এই কঠিন সঙ্ঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়াটা দরকার। নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেইফিউ রিও বলেছেন, ইন্দো-নাগা সঙ্ঘাতের অবসান কেবল পুরো অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আন্দোলনেরই সমাপ্তি ঘটাবে না, সেইসাথে সব বিদ্রোহের জননী হিসেবে পরিচিত বিদ্রোহ প্রশমিত করবে।
প্রথম ইন্দো-নাগা শান্তি আলোচনা স্থায়ী হয়েছিল আট বছর (১৯৬৪-১৯৭২)। আর দ্বিতীয় শান্তি আলোচনার স্থায়িত্ব হয়েছিল মাত্র কয়েক মাস (১৯৭৫-৭৬)। তৃতীয় রাউন্ডের আলোচনা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে এবং তা কোভিড-১৯-এর মধ্যেই অব্যাহত আছে। এই আলোচনা চলছে নাগা ন্যাশনাল পলিটিক্যাল গ্রুপ (এনএনপিজি) ও ন্যাশনালিস্ট সোস্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (এনএসসিএন-আইএম) মধ্যে।
এছাড়াও নাগা হোহো, জনতা দল (ইউনাইটেড), পাবলিক অ্যাকশন কমিটি-নাগা কাউন্সিল ডিমাপুর (পিএভিসি-এনসিডি) এবং আরো অনেক রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের সংস্থা রয়েছে এই আলোচনায়। আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে তিনটি বিষয় : প্রতীকি বিষয়গুলো, আঞ্চলিক অখণ্ডতা প্রশ্নে মনিপুরের উদ্বেগ ও অন্তভুক্তিকরণ।
দুটি প্রতীকী বিষয়ের (নাগাদের জন্য আলাদা পতাকা ও সংবিধান) সমাধান হবে কিনা তা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যেই ব্যাপক সংশয় রয়েছে। সরকারি মধ্যস্ততাকারী ও নাগাল্যান্ডের গভর্নর আর এন রবি মন্তব্য করেছেন যে বিলম্বকরণ মনোভাবের মধ্য দিয়ে এনএসসিএন (আইএম) নিষ্পত্তিতে কালক্ষেপণ করছে। এর বিপরীতে এনএসসিএন (আইএম) অভিযোগ করছে, তারা তাদের এই দুটি প্রতীকী বিষয়ের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সম্মানজক ও গ্রহণযোগ্য কোনো শান্তিচুক্তি হতে পারে না বলে তারা মনে করছে।
দ্বিতীয়ত, মনিপুরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে কুকিরা সম্প্রতি তেঙ্গানোপাল, উখরুল, মোরেহ, চুরাচান্দপুর, সদর হিলসে ব্যাপক সমাবেশ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছে। তারা ভারত সরকারের বিভেদমূলক ও বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ করে। তারা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা ছাড়া কোনো নিষ্পত্তিতে না পৌঁছানোর দাবি জানায়। তারা জানায়, মনিপুরের অখণ্ডতা নিয়ে কোনো আলোচনার প্রশ্নই আসে না।
তৃতীয়টি হলো, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী ও নাগরিক সমাজের গ্রুপকে শান্তি আলোচনা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে এনএসসিএন (ইউ) ও এনএসসিএন (কে) নামের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপকে। খণ্ডিত নেতৃত্বের সাথে চুক্তি হলে তা ভারত সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। তাছাড়া এনএসসিএন (আইএম) ইতোমধ্যেই ভারত সরকারের সাথে চলমান আলোচনায় এনএনপিজির অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা দাবি করছে, এই গ্রুপটি ‘ইয়েস ম্যান’ এবং তারা নাগা রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, নাগারা দীর্ঘ দিনের সঙ্ঘাত সমাধানের জন্য একটি যৌক্তিক, সম্মানজনক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান চায়। অবশ্য, ভারত তিনজন মধ্যস্ততাকারী (স্বরাজ কৌশল, কে পদ্মনবি, আর এস পান্ডে) নিয়োগ করেছিল অতীতে। তবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত রবি পূর্বসূরীদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি সাম্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সমাধান চান বলে মনে হয়েছে।
ভারত সরকারের উচিত হবে কয়েকটি বিষয়ের ওপর নজর দেয়া : চুক্তিতে কি সঙ্ঘাতের মূল ইস্যুর সমাধান হবে? সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যেই কি চুক্তিটি সই হবে? নারী ও নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা থাকবে?
এসব বিষয়ের সুরাহা না হলে নাগাদের সাথে স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণই থাকবে।
সূত্র : দি ডিপ্লোম্যাট