অ্যামনেস্টির অভিযোগ : বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ভারত
অ্যামনেস্টির অভিযোগ : বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ভারত - ছবি : সংগৃহীত
আজ থেকে অ্যামনেস্টি আর ভারতের অভ্যন্তরে কাজ করতে পারবে না। কয়েক বছর ধরে সরকারি হুমকি, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির পর অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার অ্যাকাউন্টগুলো কোনো সরকারি নোটিশ ছাড়াই জব্দ করা হয়েছে। মানবাধিকার গবেষণা ও আমাদের সহকর্মীদের কার্যক্রম হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে।তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর তাদের কাজের মাধ্যমে সহায়তা পাওয়া লাখ লাখ লোক ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবি জোরালো করার মতো শক্তিশালী কণ্ঠ পাবে না।
এই সিদ্ধান্ত আইনের কোনো প্রশ্নের মাধ্যমে উদ্দীপ্ত হয়নি, যেভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখন দাবি করছে। এটা অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার তহবিলের উৎসের বিষয়ও নয়। কারণ তাদের তহবিল পুরোপুরি বৈধ এবং তাতে আইন লঙ্ঘনের কিছু নেই। এটি হলো বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মানবতার নির্যাস মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়ানোর শাস্তি।
দুটি বড় ধরনের মানবাধিকার প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছিল। এগুলোর একটি হলো চলতি বছরের প্রথম দিকে দিল্লি দাঙ্গার প্রতিবেদন। এতে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় পুলিশের সহযোগিতার প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরেছিল। অপরটি হলো, কাশ্মিরে দীর্ঘ দিন ধরে চলা নির্বিচার আটক ও ইন্টারনেটের ওপর বিধিনিষেধ।উভয় প্রতিবেদনই অন্যান্য পর্যবেক্ষকরাও সমর্থন করেছেন।
কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বাস্তবতা কোনো বিষয় নয়। প্রতিবেদনগুলো পাঠ করে ওই সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অবশেষে বারবার ও জোরালোভাবে সত্য বলা একটি মানবাধিকার সংস্থার ওপর থেকে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।গত কয়েক বছর ধরে অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, স্কুলে শিশুদের যৌন নির্যাতন, বর্ণবৈষম্য, স্বাস্থ্যকর্মীদের কোভিড-১৯ মহামারির সুরক্ষা না দেয়া, ধর্মবিশ্বাসের কারণে রাজপথে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে অ্যামনেস্টি কাজ করেছে, সোচ্চার হয়েছে।
তবে এসব উদ্যোগ ভারতের সুনাম ক্ষুণ্ন করার কোনো ষড়যন্ত্র নয়, যেমনটা কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ করছেন। এই কার্যক্রম আসলে ভারতের নিজস্ব ঐতিহ্যেই উদ্দীপ্ত। জাতিসঙ্ঘ সদস্যভুক্ত যে কয়েকটি দেশ সার্বজনীন মানবাধিকারের জন্য প্রথমে ভোট দিয়েছিল, তাদের অন্যতম ছিল ভারত। ভারতের নারী অধিকারের প্রবক্তা হাসনা মেহতা ওই ঐতিহাসিক দলিলের অন্যতম রচয়িতা ছিলেন। ভারতের আদালতগুলো বারবার বলে থাকে যে এসব মূল্যবোধ ভারতের নিজস্ব সংবিধানেও রয়েছে। উল্লেখ্য, মেহতা ভারতের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নেও সহায়তা করেছিলেন। এমন মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া কাজ করছিল।
অধিকন্তু, অ্যামনেস্টি নিরপেক্ষভাবে সারা বিশ্বেই একই মানদণ্ডের আলোকে কাজ করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে চীনে এই সংস্থা জিনজিয়াঙে উইঘুর ও অন্যান্য মুসলিম গ্রুপগুলোর ওপর নির্যাতনকে তুলে ধরছে। সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে নির্যাতন, অন্যায় বিচারিক কার্যক্রমের ওপর আলোকপাত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া হংকংয়ের স্বাধীনতা দমনে বেইজিংয়ের তৎপরতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকে অ্যামনেস্টি।
পাকিস্তানেও গুমের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টি দীর্ঘ দিন ধরে সোচ্চার। এছাড়া মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি, ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় অ্যামনেস্টি। পাকিস্তানে হিন্দু নারীদের অপহরণ করা, জোর জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তর, হিন্দুদের মন্দিরে যেতে বাধা দেয়ার বিরুদ্ধেও কথা বলে অ্যামনেস্টি।
ভারত একসময় এই অঞ্চলে ব্যতিক্রমী দেশ ছিল। তারা সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের ঐতিহ্য লালন করেছে দীর্ঘ দিন ধরে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে মেহতার মতো ভারতীয় অ্যাক্টিভিস্টরা বন্দী হয়েছিলেন কঠোর আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস দায়মুক্তি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ভারতের ঐতিহ্যের কারণেই দেশটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল, নানা ইউনিয়ন, নারীদের অধিকার গ্রুপ, আদিবাসী ও দলিত অধিকার অ্যাক্টিভিস্টদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।
এসব ঐতিহ্য এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। বর্তমান প্রশাসনের অধীনে সমালোচনামুখী সাংবাদিকদের চাকরি থেকে অপসারণ করা হচ্ছে, সরকারপন্থী বক্তব্য প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের রাজপথে দাঙ্গাবাজেরা নির্যাতন করছে, সরকার আবার সংখ্যালঘুদের দানবের মতো করে তুলে ধরছে। পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ কার্যক্রমের জন্যও ছাত্র, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতিসঙ্ঘে বলেছেন যে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন লাভের যোগ্য ভারত। তিনি তার যুক্তিতে জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শের সাথে ভারতের আদর্শের সামঞ্জস্যতার কথা বলেন। তবে তিনি যা বলেননি তা হলো, মেহতা ও অন্যদের প্রণীত এসব আদর্শের স্থান এখন কোথায এবং কিভাবে এসব আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।
ভারত আজ বিশ্বে মানবাধিকারের শীর্ষস্থানীয় রক্ষক নয়। বরং যেসব দেশ স্বাধীন ও সমালোচনামুখী মানবাধিকার সংস্থাকে ভয় পায়, সত্য সমুন্নত রাখা ও প্রকাশ করার মতো কারো আগ্রহী থাকা নিশ্চিত করতে চায়, ভারত এখন তাদেরই দলে।
লেখক : সিনিয়র পরিচালক; রিসার্চ, অ্যাডভোকেসি ও পলিসি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
সূত্র : দি গার্ডিয়ান