টিকে থাকতে পারে ইরান?
ইরানের অর্থনীতিতে কী হচ্ছে? - ছবি সংগৃহীত
অবরোধ ও বিভিন্ন কারণে ইরানের অর্থনীতিতে ধস নামে। ইরানের অর্থনীতির জীবনীশক্তি তেল। সেই তেলের উৎপাদন দৈনিক ৩.৮ মিলিয়ন থেকে ২০১৯ সালে ২.১ মিলিয়ন ব্যারেলে নামে। ২০১৮ সালেও একই অবস্থা বিরাজ করে। ২০১৯ সালে জিডিপি ৯ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়। ডলারের বিপরীতে ইরানি রিয়েল ৫০ শতাংশ ভ্যালু হারায়। ভূরাজনীতিতে একটি সূত্র আছে কোনো দেশকে বেশি চাপ দিলে কোনো একসময় প্রতিরোধের জন্য উঠে আসে। কোভিড-১৯ এর কারণে ইরানে ১ আগস্ট পর্যন্ত ৮,৫০,০০০ জন চাকরি হারিয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরে ৩১ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ শতাংশ শ্রমিক লে অফের জাঁতাকলে পড়েছে। এই সময়ে পেনশনে গিয়েছেন ১৩,৫০০ জন। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ২৪ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি রয়েছে এবং সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ইরানের তেল, গ্যাস ও পেট্রো কেমিকেলে ২৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য বসে আছে চীন। তাছাড়া পরিবহন ও নির্মাণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১২০ বিলিয়ন ডলার দেয়ারও চিন্তা রয়েছে। চীনারা ইরানে ম্যানুফেকচার করে ইউরোপের মার্কেটে কম দামে রোড ও বেল্ট প্রকল্পের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করবে। এই সবই ২৫ এর প্রথম পাঁচ বছরে সম্পন্ন হবে। রেল, মহাসড়ক, বন্দর, ফ্যাক্টরি ও রিফাইনারির মতো ১০০টি প্রকল্প দ্রুত নেয়ার কথা চুক্তিতে রয়েছে। এসব কারণ ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। চবাহারে তাদের বাড়া ভাতে যেন পানি ঢেলে দেয়া হয়েছে।
এসবের বিনিময়ে চীন নতুন তেল, গ্যাস ও পেট্রো কেমিক্যাল প্রকল্পগুলোতে ফাস্ট বিডার হিসাবে সুযোগ পাবে এবং ১২ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট পাবে। তাই আন্তর্জাতিক সব বিডে চীন সহজেই আধিপত্য করতে পারবে। এছাড়া ইরানের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন বানাবে চীন। চীনের জন্য আরো সুবিধা হলো দু’বছর দেরি করে এবং ‘সফট কারেন্সি’র মাধ্যমে পেমেন্ট করতে পারবে। টেক জায়েন্ট হুয়াওয়ে ইরানে ৫জি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে। চীনকেন্দ্রিক জিপিএস ব্যবহার করে সাইবারস্পেস চলবে এবং চীনা ফায়ারওয়াল ব্যবহৃত হবে। উল্লেখ, ইরানেরও নিজস্ব শক্তিশালী ফায়ারওয়াল রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের সাইবার আক্রমণে ব্যবহৃত হয়।
চবাহারে যাওয়া মানে পারস্য উপসাগরে চীনের অবাধ ও নিরাপদ গতিতে ঘুরাফেরা করা, কৌশলগত হরমুজ প্রণালী, যেখান দিয়ে বিশ্বের বেশির ভাগ হাইড্রোকার্বন যায় সেখানে বুক ফুলিয়ে চলা। চীন ইতোমধ্যে পাকিস্তানের গোয়াদর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা ও আফ্রিকার জিবুতিতে বন্দর নির্মাণ করেছে। চীনের সামুদ্রিক জাহাজগুলো সহজেই ‘রিফুয়েলিং’ সরবরাহ লাইন মজবুত রাখতে সক্ষম হবে এবং দক্ষিণ চীন সাগর থেকে সুয়েজ খাল যাতায়াতে বিশেষ সুবিধা পাবে।
চুক্তিতে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ, যৌথ ড্রিল, যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা গবেষণা ও উন্নয়ন, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় রয়েছে। ইউরোপীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে ৫০০০ চীনা কমান্ডো তেহরানে প্রেরিত হয়েছে। চীন বলেছে, এই বাহিনী ইরানে চীনের পুঁজি বিনিয়োগ ও সম্পদ পাহারা দেবে। চীন ইরানকে ইলেক্ট্রোনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম প্রদান করবে এবং যুদ্ধকৌশলের উন্নয়ন সাধন করবে। ফলে ইরানের এন্টি-মিসাইল ডিফেন্স নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী হবে। বিশেষ সূত্র থেকে এসব কর্মসূচির খসড়া প্রকাশ হয়ে পড়ে। পুরো ড্রাফট এখনো ইরানি পার্লামেন্টে উপস্থাপিত হয়নি। এসব কিছু পরিপূর্ণভাবে শুরু হলে তেহরান, বেইজিং ও ওয়াশিংটন কৌশলগত ‘ক্রসরোডে’ পড়বে এবং ভয়-দুর্যোগের পারদাঙ্ক উপরে উঠবে। সেখানেও চীনের অবস্থান হবে ‘উইন-উইন’!
চীন আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্য থেকে বৈশ্বিক শক্তির বলয়ে রোড ও বেল্ট ইনিসিয়েটিভের মাধ্যমে প্রবেশ করছে। এতে অনেক দেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। চীনের সাথে বিআরআই প্রকল্পে ইরান আগামী ২৫ বছরের জন্য স্থায়ীভাবে তেল রফতানির একটি নির্ভেজাল স্থান পেয়ে গেলে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন চীন তো আর সব তেল কিনবে না। ইরানও সব তেল চীনকে দিতে চায় না। ইরানের তিনটি জায়েন্ট কোম্পানি বিশ্বব্যাপী তেল রফতানি করে। ইরানের ওপর অবরোধকালে এসব কোম্পানি বিভিন্ন পয়েন্টে তেল রফতানি করতে পারবে চবাহার বন্দরের মাধ্যমে। চীন এতবড় বিনিয়োগ আগে কোথাও করেনি।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, তেহরান-জিনজিয়াংয়ের উরুমকি ২৩০০ কিলোমিটার যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চীন ১২০ বিলিয়ান ডলার খরচ করবে। এই রাস্তা পাকিস্তানে যুক্ত হয়ে গোয়াদরও যাবে। সিপিইসি অংশেও এই কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে। রাস্তাটি তৈরি হলে কাজাকিস্তান, কিরঘিজস্থান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের সাথে সংযোগ হবে। ইরান-পাকিস্তান-চীন-আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে আসবে। মূলত চীনের এই উদ্যোগে রাশিয়াও সায় দিয়েছে। ফলে মধ্য এশিয়া একটি শক্তিশালী উন্নয়নশীল ও বর্ধিঞ্চু অঞ্চলে পরিণত হবে। এখান থেকে প্রাথমিকভাবে তুরস্ক ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথেও যোগাযোগ করা যাবে। ভারতও ইরানের সাথে সংযুক্ত থাকলে চবাহার থেকে আফগানিস্তানে ও মধ্য এশিয়ার সাথে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে। ইরান ও চীনের সম্পর্ক নিয়ে আতঙ্কিত ভারত! ইরানের সাথে চীনের সম্পর্ক নিয়ে মনে করা হচ্ছে আতঙ্কে রয়েছে ভারত। ভারতের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী সম্প্রতি ইরান সফর করেছেন। চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথেও ইরানের সম্পর্ক নিয়ে মাথাব্যথা ভারতের। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের চিরশত্রু চীন এবং পাকিস্তানের সাথে ইরান যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তাতে ভারত চরম উদ্বিগ্ন।
ইরানের গুরুত্বপূর্ণ চাবাহার বন্দরটির উন্নয়ন ভারতের হাতে শুরু হয়েছে সেই বন্দরের সম্প্রসারণ এবং ওই বন্দরের সাথে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের রেল যোগাযোগের কাজ এখন চীনের হাতে তুলে দেয়ার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে ইরান। কেননা ভারতের গড়িমসিতে ইরান ক্ষুব্ধ। কাজটি করার জন্য IRCOM কে ২০১৬ সালে টেন্ডার দেয়া হয় রেললাইনের জন্য। ১.৬ বিলিয়ন খরচ করতে হবে। ২০২০ পর্যন্ত এক রুপিও দেয়া হয়নি। ডকুমেন্টারিতে বলা হয় আমেরিকার চাপে ভারত তা করেনি। এখন ভারত আসতে পারবে মেহমান হিসেবে মালিক হিসেবে নয়। চীন এখন চাবাহার বন্দরটিকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) অংশ করতে চায়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের আগ্রহে পাকিস্তানের সাথে ইরানের সম্পর্কে যেভাবে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে তা ভারতের জন্য বাড়তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে ভারত তাদের প্রভাব কতটা ধরে রাখতে পারবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্ক ও চবাহার বন্দর ব্যবহারের ওপর।
একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘সৌদি আরব দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের স্বার্থ নতুন করে পর্যালোচনা করছে এবং পাকিস্তানের চেয়ে ভারত তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইরান এখন পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’ এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভারত কি তাদের এক সময়কার ঘনিষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু দেশ ইরানকে একেবারেই হারিয়ে ফেলছে?
বিশ্লেষক বলেন, ‘ভারতের মতো বড় একটি বাজার সবসময়ই ইরানের জন্য লোভনীয় এবং ইরান নিশ্চয়ই জানে যে তাদের জ্বালানি তেলের পুরোটাই চীন কিনবে না।’ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের রেষারেষিকে কেন্দ্র করে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যে দলাদলি শুরু হয়েছে তাতে ভারত-ইরান সম্পর্ক যে বলি হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
খারাপ দিক পর্যালোচনা
২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ইরানে চীনা পুঁজি বিনিয়োগ ফি বছর ২০০ বিলিয়নে দেখানো হচ্ছে। সে হিসেবে আগামী পাঁচ বছরে ৪০০ বিলিয়ন প্রদান করা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা নানা প্রশ্ন তুলছেন। বিশেষ করে একটি দেশে এককভাবে এতবড় অঙ্কের অর্থ দেয়া সম্ভব কিনা তাও আলোচনায় এসেছে। সমালোচকরা সিইপিসির প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছেন, সে প্রকল্পটিতে এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি এবং এতে পাকিস্তানের যেরকম উপকার দেখা যাওয়ার কথা সেটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ইরানের প্রকল্পও এরকম কিছু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কারণে হয়তো অনেক বাধাবিপত্তি সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। সাথে ইসরাইল-আমিরাত-সৌদি ব্লক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটাতে পারে।
অনেকে মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতে চীন সর্বাবস্থায় ইরানের পাশে নাও দাঁড়াতে পারে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুধু ইরানের জন্য নয় এর উদ্দেশ্য বৈশ্বিক বলয়, ইরান-চীন আলোচনায় এটি ভুলে গেলে চলবে না। সৌদি আরব ভিশন ২০৩০-কে লক্ষ রেখে চীনের সাথে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এনার্জি খাতে ১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।
ইসরাইলে চীন নৌবন্দর, শিপিং ও লবণাক্ততা দূরীকরণ প্রকল্পে ১ বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে। এটি ইসরাইলের ইকো সিস্টেম অবকাঠামো উন্নয়নের একটি প্রাথমিক ধাপ মাত্র। তাই অনেকে মনে করেন, শুধু ইরানের জন্য সৌদি আরব ও ইসরাইলের লাভজনক বিনিয়োগ ও ব্যবসা চীন ছেড়ে দেবে কেন? এদিক দিয়ে পাকিস্তানের বিষয়টি ভিন্ন। কৌশলগত দিক দিয়ে বলতে হয় চুক্তিটিতে চীনের বেশি সুবিধা হয়েছে। ইরানকে বিশ্লেষণ করতে হবে ওয়াশিংটন চীন রশি টানাটানিতে ইরান কোনো পোদ্দারিতে পড়ল কিনা?
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার