প্রচণ্ড মাইগ্রেন : কী করবেন
প্রচণ্ড মাইগ্রেন : কী করবেন - ছবি : সংগৃহীত
সহজ ভাষায়, মাইগ্রেন হলো এক বিশেষ ধরনের মাথা ব্যথা (হেডেক)। বহু মানুষ এই অসুখে ভোগেন। মাইগ্রেন হেডেক-এ মাথা দপদপ করা, টিসটিস করা, মাথায় হাতুড়ি পেটানোর অনুভূতি হয়। বেশিরভাগ সময় এই মাথা ব্যথা নিয়ে কাজ করে যাওয়া সম্ভব হয়। তবে অনেকসময় ব্যথার তীব্রতা এতটাই বেশি থাকে, কাজ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে মাথার একদিকে, নির্দিষ্ট অংশে বা গোটা মাথা জুড়েই যন্ত্রণা হওয়া সম্ভব।
মাইগ্রেনের মাথা ব্যথার সময় আলো ভালো না লাগা, শব্দ ভালো না লাগা, গা বমি দেওয়া, বমি হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারণভাবে যন্ত্রণা থাকে ৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা। যন্ত্রণা কমে যাওয়ার পর কিছু দিন রোগী ভালো থাকেন। ফের যন্ত্রণা ফিরে আসে।
মাইগ্রেন অরা
মাইগ্রেনের রোগী মূলত দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে— মাইগ্রেন উইথ অরা এবং মাইগ্রেন উইদাউট অরা।
মাইগ্রেন হেডেক শুরু হওয়ার আগে কিছু রোগী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পূর্বাভাস পেয়ে থাকেন। এই ঘটনাকে বলে মাইগ্রেন উইথ অরা। এই অরা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে— ভিজ্যুয়াল অরা (চোখে দেখা), অডিটরি অরা (কানে শোনা), সেনসির অরা (হাত-পায়ে অনুভূতি) ইত্যাদি। সমস্ত ধরনের অরার মধ্যে ভিজ্যুয়াল অরাই বেশি মানুষ অনুভব করেন। যেমন— রোগী বলতে পারেন মাথা ব্যথা হওয়ার আগে চোখে আলোর ছটা দেখছি, আলোর বিন্দু দেখছি, আলোর বিন্দু ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে ইত্যাদি। অবশ্য মাইগ্রেন অ্যাটাকের আগে অরা হচ্ছে, এমন রোগীর সংখ্যা খুবই কম। বেশিরভাগ রোগীই মাইগ্রেন উইদাউট অরা শ্রেণীর।
বিশেষ কিছু লক্ষণ
তবে অরা না থাকলেও একটু খেয়াল করলেই রোগীরা মোটামুটি মাইগ্রেন শুরুর আগে কিছু লক্ষণ সম্বন্ধে বুঝতে পারবেন। যেমন— শরীর ভালো না লাগা, ক্লান্ত লাগা, মন ভালো না লাগা ইত্যাদি। এই উপসর্গগুলিকে বলে প্রি মনিটরিং সিম্পটম।
যেকোনো বয়সে মাইগ্রেন হতে পারে। পুরুষ এবং মহিলা দুই দলেরই এই সমস্যা হয়। অবশ্য পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মাইগ্রেন বেশি হতে দেখা যায়। আর পরিবারের কারও মাইগ্রেন থাকলে এই অসুখে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।
মাইগ্রেনের অনুঘটক
এই নির্দিষ্ট কারণগুলো মাইগ্রেন অ্যাটাক তৈরি করতে পারে—
খালিপেটে থাকা রাত জাগা রোদে ঘোরা কোনো নির্দিষ্ট গন্ধ থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুগন্ধী বা ধূপের গন্ধ ইত্যাদি অতিরিক্ত চিন্তা চকোলেট খাওয়া ইত্যাদি। তবে মনে রাখবেন, প্রতিটি মানুষের মাইগ্রেনের অনুঘটক এক হয় না। মানুষ ভেদে অ্যাটাকের অনুঘটক ভিন্ন হয়ে থাকে।
রোগ নির্ণয়
মাইগ্রেন নির্ণয় করার কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। তাই এই রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি বুঝতে গেলে মাথা ব্যথার অন্যান্য কারণ সম্বন্ধেও জেনে নিতে হবে। মাথা ব্যথার দুই ধরনের কারণ রয়েছে— প্রাইমারি হেডেক এবং সেকেন্ডারি হেডেক।
কোনো অসুখের বহির্প্রকাশ হিসেবে মাথা ব্যথা হলে সেকেন্ডারি হেডেক বলা হয়। যেমন— টিউমার, ব্রেন স্ট্রোক, জ্বর, মাথায় চোট, চোখের সমস্যা ইত্যাদি কারণে মাথা ব্যথা হয়। তাই মাথা ব্যথা নিয়ে কোনও রোগী আসলে বুঝে নিতে হয় যে রোগীর কোনও সেকেন্ডারি হেডেক রয়েছে কি না। সেকেন্ডারি হেডেক খুঁজে না পেলে প্রাইমারি হেডেকের কথা ভাবতে হয়।
মাথা ব্যথাটা নিজেই যখন অসুখ তখন তাকে প্রাইমারি হেডেক বলে। এক্ষেত্রে প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা করার পরও রোগীর মস্তিষ্কের মধ্যে কোনো গঠনগত সমস্যা দেখা যায় না। অর্থাৎ মাথা ব্যথার নেপথ্যে কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মাথা ব্যথা হচ্ছে, এটাই হলো সমস্যা। প্রাইমারি হেডেক আবার তিন ধরনের হয়— টেনশন হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক ও মাইগ্রেন হেডেক।
দুশ্চিন্তা, অবসাদ দেখা দিলে মূলত টেনশন হেডেক হয়। মাথা ধরে থাকা, মাথার উপর ভারী বোঝা চাপানোর মতো অনুভূতি হয়। অবশ্য টেনশন হেডেক নিয়েই মানুষ নিজের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
মাথার একদিকেই বারেবারে ব্যথা হচ্ছে, চোখে যন্ত্রণা হয়, চোখ থেকে পানি পড়ে, নাক বুজে যায়— এই লক্ষণগুলো হলো ক্লাস্টার হেডেকের লক্ষণ।
এবার শেষে থাকল মাইগ্রেন। অর্থাৎ রোগীর মধ্যে টেনশন হেডেক বা ক্লাস্টার হেডেকের উপসর্গ না দেখতে পেলে মাইগ্রেনের কথা চিন্তা করা হয়। পাশাপাশি মাইগ্রেনের নিজস্ব রোগ লক্ষণের মানদণ্ড মিলিয়ে নিতেও হয়। তারপরই বলা যায় মানুষটির মাইগ্রেন হয়েছে। অর্থাৎ রোগীর মাইগ্রেন হয়েছে নির্ণয় করতে হলে আগে নিশ্চিত হতে হয় যে রোগীর অন্য কোনো কারণে মাথা ব্যথা হচ্ছে না।
চিকিৎসা
প্রথমত, রোগীর জীবনধারন বদলাতে হবে। যেই ঘটনাগুলো মাইগ্রেনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে, তা এড়িয়ে চলতে হয়।
এরপর আসছে মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্ট। ঘনঘন মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিলে রোগীকে প্রোফাইল্যাকটিক চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ওষুধের মাধ্যমে যতটা সম্ভব মাইগ্রেন অ্যাটাক আটকানোর চেষ্টা চলে। অবশ্য প্রোফাইল্যাকটিক চিকিৎসার সুফল পেতে বেশ কিছু দিন সময় লাগে। এতদিন তো আর রোগীর সমস্যা ফেলে রাখা যায় না। তাই এই নির্দিষ্ট সময়ে রোগীকে ব্যথা কমানোর জন্য কী ধরনের মাইগ্রেন বুঝে নির্দিষ্ট ওষুধ দিতে হয়।
মেডিকেশন ওভারইউজ হেডেক
মনে রাখবেন, নিয়মিত এই ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করলে সেই অভ্যাসের জন্যই মাথা ব্যথা হতে পারে। অর্থাৎ ব্যথা কমানোর ওষুধই এক্ষেত্রে মাথা ব্যথা বাড়িয়ে দেয়।
এই সমস্যার নাম মেডিকেশন ওভারইউজ হেডেক। এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। অবশ্য কালেভদ্রে মাইগ্রেন অ্যাটাক হলে প্রোফাইল্যাকটিক চিকিৎসার বদলে ব্যথা কমানোর ওষুধই দেয়া হয়। পাশাপাশি সব ক্ষেত্রেই রোগীকে কিছু রিল্যাক্সেশন থেরাপিও করতে বলা হয়ে থাকে।
লেখক : অধ্যাপক বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স-এর নিউরোমেডিসিন বিভাগ
সূত্র : বর্তমান