যেভাবে এসসিওতে ভারতকে কোণঠাসা করছে চীন-পাকিস্তান
যেভাবে এসসিওতে ভারতকে কোণঠাসা করছে চীন-পাকিস্তান - ছবি : সংগৃহীত
লাদাখের পাহাড়ি এলাকায় জুনে বিরোধপূর্ণ সীমান্তে এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক জায়ান্ট ভারত ও চীন লড়াইয়ে নামে। ৪০ বছরের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘটনা। আরো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) থেকে ভারতকে সরিয়ে দিতে চীন তার সবসময়ের মিত্র পাকিস্তানের সাথে একযোগে কাজ করছে। এটি হবে ইউরেশিয়ায় ভারসাম্যের পরিবর্তন। উল্লেখ্য, আগামী নভেম্বরেই দিল্লিতে হওয়ার কথা ছিল এসসিওর সম্মেলন।
ভারত ২০০৫ সালে মরিয়াভাবে এই ফোরামে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সাংহাই চেতনার আলোকে এসসিও হলো ভারতের আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করার পথ। নয়া দিল্লি চেয়েছিল তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সম্প্রসারণ করতে, কানেকটিভিটি বাড়াতে এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে এসসিওকে ব্যবহার করতে।
কৌশলগতভাবে এসসিওকে ভারত মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য করা এবং একইসাথে চীনের আঞ্চলিক উচ্চাভিলাষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
রাশিয়ার সহযোগিতায় ভারত ২০১৭ সালে অবশেষে সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলোর একই ক্লাবে প্রবেশ করে। তবে ওই সময় প্রতিন্দ্বন্দ্বী পাকিস্তানও তাতে যোগ দেয়। তিন বছর পর ভারত ভূরাজনৈতিক গোলকধাঁধায় (কার্যত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটি সংস্থায় বহাল থেকেও চীনের বিরুদ্ধে আরো আগ্রাসী অবস্থান গ্রহণ করতে ওয়াশিংটনের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখা ) নিজেকে আবিষ্কার করে ভারত।
ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের সম্পর্ক মারাত্মক অবনতি হওয়ায় চীনা নেতৃত্বাধীন এসসিওতে ভারতের অবস্থান করার সিদ্ধান্তটি মারাত্মক নজরদারির মধ্যে পড়ে যায়।
এই সংস্থায় অ্যাজেন্ডা নির্ধারণে বেইজিং এখনো প্রধান শক্তি হিসেবে বহাল রয়েছে ২০০১ সাল থেকে চীন, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রগুলোকে নিয়ে গঠিত এসসিও (আগে ১৯৯৬ সাল থেকে ছিল সাংহাই ফাইভ) বেইজিংয়ের আঞ্চলিক লক্ষ্য হাসিলে কাজ করছে।ওইসব লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত নিরাপদ রাখা, উইঘুরদের সংযত রাখা, ইউরেশিয়ান বাজারগুলোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ লাভ করা। সাম্প্রতিক সময়ে চীন এটিকে ব্যবহার করছে ইউরেশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খর্ব করতে। তাছাড়া মধ্য এশিয়ায় রুশ ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করতে, চীনের পশ্চিম সীমান্তে ইসলামি হুমকি ভণ্ডুল করে দিতেও বেইজিং এটিকে কাজে লাগাচ্ছে।
রাশিয়াই এসসিওতে ভারতকে নিয়ে এসেছিল। রাশিয়া মনে করেছিল, এই সংগঠনে চীনা প্রভাব হ্রাস করতে ভারতকে সে কাজে লাগাতে পারবে। চীন-রুশ সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গ কৌশলগত সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়ই এমনটা ঘটে। কিন্তু রুশ-চীন সম্পর্কের নতুন যুগের সাথে ভারত তাল মেলাতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। আর বেইজিংয়ের ওপর ক্রমাগতভাবে নির্ভরশীল থাকা মস্কোর পক্ষে ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে সৈন্য মোতায়েনসহ চীনা কৌশল সামাল দেয়া অব্যাহতভাবে কঠিন হয়ে পড়ছে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসসিওর মূল নজর হলো আফগান সঙ্ঘাতের অবসান এবং মধ্য এশিয়া ও জিনজিয়াঙে কথিত সন্ত্রাসীদের প্রবাহ বন্ধ করা। পাকিস্তানকেন্দ্রিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগগুলোর সুরাহা কিন্তু হয়নি।
মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের বাণিজ্য এখনো তেমন কিছু নয়, মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার। অথচ রাশিয়ার সাথে তা ১০ বিলিয়ন ডলার। ভারতের এসসিও দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় চীনের সাথে। আর তা করার জন্য এসসিও কার্যকর কিছু নয়।
কানেকটিভিটির ক্ষেত্রেও এসসিও নয়া দিল্লির জন্য কোনো সুবিধা দিতে পারেনি। চাবাহার থেকে জায়দান ও তারপর আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে প্রস্তাবিত ৬১০ কিলোমিটারের রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনাও অচল হয়ে রয়েছে। আবার তুর্কমেনিস্তান ও ভারতের মধ্যে তাপি গ্যাস পাইপলাইনও অধরা রয়ে যাচ্ছে।
নয়া দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় এসসিওতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কথা ওঠছে। সংস্থাটি এখন কেবল চীনা স্বার্থই এগিয়ে নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। শি জিনপিংয়ের অধীনে ইউরেশিয়া অঞ্চলটি তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সম্প্রসারণেই কাজ করছে।
আবার ইউরেশিয়ায় চীনা উচ্চগতির রেল ও জ্বালানি নেটওয়ার্ক নির্মাণ চীনের সামরিক সক্ষমতাই বাড়াবে, তাদের শক্তিই তুলে ধরবে। মধ্য এশিয়ায় ১,৪৩৫ এমএম রেলওয়ে নির্মাণ করার মানে হচ্ছে চীন ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানসহ পুরো ইউরেশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলতে পারা।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পাকিস্তান পর্যন্ত এসিওকে ব্যবহার করে তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা স্বার্থ হাসিল করে ফেলছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও কাশ্মিরে তারা তাদের নিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই সংগঠনের কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছে।তারা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর ও গোয়াদর বন্দরকে ব্যবহার করার জন্য এসসিওকে কাজে লাগাতে চাইছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এসসিও-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সম্মেলনে পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে বিরোধপূর্ণ কাশ্মিরকে নিজের বলে দাবি করে মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ওয়াক আউট করেন।
চীনের সাথে অব্যাহত উত্তেজনার ফলে এসসিওতে ভারতের অবস্থান জটিল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটেই নয়া দিল্লিতে এসসিওর পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এসসিও হওয়ার কথা ছিল একমত প্রতিষ্ঠার স্থান, সঙ্ঘাত থেকে সংযত রাখার ফোরাম। কিন্তু তা হচ্ছে এর বিপরীত। গ্রুপে নয়া দিল্লিকে কোণঠাসা করার জন্য রাশিয়া ও পাকিস্তানের সাথে চীন তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় ভারত পড়ে গেছে প্রতিকূল অবস্থায়।
সূত্র : দি ডিপ্লোম্যাট