লিবিয়ায় হচ্ছেটা কী
লিবিয়ায় হচ্ছেটা কী - ছবি সংগৃহীত
লিবিয়ায় গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত যখন চলমান রয়েছে, তখন ইস্টমেড পাইপলাইন পরিকল্পনা ‘আগুনে জ্বালানি ঢেলে দেয়া’র মতোই পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। এই পরিকল্পনায় তুরস্ক ক্ষুব্ধ। তুরস্ককে এই চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে। এই পরিকল্পনার ব্যাপারে রাশিয়াও উদ্বিগ্ন। চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে ক্ষমতাশালী করে তোলা হয়েছে। কারণ ইসরাইল এখন পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপ মহাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সংযোগ ঘটাতে পারে। ইসরাইলের নেতৃত্বে জোট গঠনের পূর্বাভাস পেয়ে তুরস্ক ও লিবিয়া গত বছর একটি সমুদ্রসীমা চুক্তি (মেরিটাইম বাউন্ডারি ট্রিটি) স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে আঙ্কারাকে লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় জলসীমায় প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। সাহসী ও দুর্দান্ত সামরিক মহড়ার মাধ্যমে তুরস্ক তার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল পর্যন্ত ব্যাপক এলাকায় গ্যাস আহরণের লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ভূখণ্ডগত অধিকার দাবি করে। তুরস্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলের দাবি ইউরোপের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
কারণ এটা উচ্চাভিলাষী ইস্টমেড প্রকল্পের সাথে সাংঘর্ষিক এবং এতে মৌলিকভাবে ভূরাজনীতি পাল্টে যাবে। ইউরোপের নির্দেশনায় এবং ন্যাটোর অনুমোদনে ওই অঞ্চলে নিয়ে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তুরস্কেও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি তাদের এ পরিকল্পনা ও ভূরাজনীতিকে পাল্টে দিতে পারে। তাই তারা এর বিরোধী। তবে ন্যাটো এখন আর আগের মতো দুর্ধর্ষ ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি নেই। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর অব্যাহতভাবে উত্থান হয়েছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি অপরটিকে সহায়তা এবং ‘সোভিয়েত হুমকি’ থেকে রক্ষা করার জন্য বড় বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আর ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়ার পরও ন্যাটো শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ন্যাটো নিজের ঐক্য ধরে রেখেছিল। সোভিয়েতের বিষয়টি দীর্ঘদিন আর ফ্যাক্টর থাকেনি। কারণ ওয়াশিংটন বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছে।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ ন্যাটোর নতুন মিশন হিসেবে প্রথম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ ন্যাটোর ক্ষমতার সর্বনাশ ডেকে আনে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে ‘প্রস্থানের বা ফিরে আসা’র কৌশল গ্রহণ করে। এতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার ক্রমান্বয়ে সরে আসার এবং একই সাথে ‘কেন্দ্রবিন্দু এশিয়ার দিকে’ এই পূর্বাভাস পাওয়া যায়। প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সামরিক আধিপত্য খর্ব করার দুর্ধর্ষ আশাবাদ নিয়ে আমেরিকা এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ ফুটে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকা যে সামরিকভাবে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে ২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর হস্তক্ষেপ থেকে।
সামরিক কৌশলবিদরা লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বর্ণনা করার জন্য ‘পেছন থেকে নেতৃত্ব দেয়ার’ মতো একটি বিভ্রান্তিকর টার্ম খুঁজে বের করেন। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেবারই প্রথম ওয়াশিংটন এমন একটি দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের অংশ হয়েছিল যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ তুলনামূলকভাবে ছোট ও দুর্বল সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ দিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন সামরিক কৌশলে ন্যাটোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেন। এটা প্রমাণিত যে, এক সময়ের ক্ষমতাশালী জোট ওয়াশিংটনের জন্য নিজেদের ব্যবহৃত হওয়াকে অত্যধিক গুরুত্ব দিত। এ দিকে ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অখণ্ড হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য যেভাবে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে থাকে, একইভাবে ন্যাটোর জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এই ফ্রান্সই ইউরোপিয়ান ও পশ্চিমা আদর্শে আস্থা রেখেছে এবং ওই আদর্শ থেকে আমেরিকার ক্রমান্বয়ে সরে যাওয়ার শূন্যতা পূরণ করতে প্যারিসকে বাধ্য করছে। বর্তমানে ভূ-মধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলের সঙ্ঘাত জ্বলে ওঠাসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক চলমান সঙ্কটে ফ্রান্স সামরিক কর্তৃত্ব এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।