করোনা ও বিশ্বরাজনীতির কলকাঠি
করোনা ও বিশ্বরাজনীতির কলকাঠি - ছবি সংগৃহীত
বিগত আট-নয় মাস ধরে করোনাভাইরাসে বিশ্ব টালমাটাল হলেও সম্প্রসারণ ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা থেকে বৃহৎ শক্তিধর ও তাদের সহযোগী দেশগুলো এক চুলও সরে আসেনি। চোখে মালুম হয় না, এমন অণুজীব করোনাভাইরাসের সাথে অসম লড়াইয়ে প্রায় পর্যুদস্ত বিশ্ব। কিন্তু এসব দেশ মানুষ মারার জন্য মারাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসেনি! বরং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছে নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য, অস্ত্র প্রস্তুত এবং সংগ্রহ করতে।
আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট, যত অর্থ অস্ত্র প্রস্তুত ও বিলাসিতার উপকরণ ক্রয়ে ব্যয় করা হচ্ছে, তার ক্ষুদ্র অংশও মানুষ বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হচ্ছে না। বিশ্বের কাছে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- কোনটা অনিবার্য করণীয় ছিল, মানুষ বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা, না সম্প্রসারণবাদী নীতির স্বার্থে অস্ত্রব্যয় শনৈ শনৈ বৃদ্ধি করা?
খোলাবাজার অর্থনীতির চালিকাশক্তি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর হাতে বন্দী বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পাশ্চাত্য (কিছুটা প্রাচ্যেও) মাল্টি-ন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানিগুলো মানুষের জীবনকে জিম্মি করে কোটি কোটি ডলার ইনকাম করছে। সরকারগুলো এদের সহযোগী। এরা অস্ত্র প্রস্তুতকারী ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মতোই সেবার নামে মানুষকে শোষণ করছে। অস্ত্রের বাজার যেমন বিরাট, ওষুধ-ভ্যাকসিনের বাজারও বিশাল। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিযোগিতার ঘটনা কি বলছে? কে করবে দখল ভ্যাকসিনের বাজার?
আজ বিশ্বের দু’শতাধিক (২১৫-২১৭) দেশের মানুষ করোনায় বিপর্যস্ত। প্রতিদিন এই কঠিন রোগে বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। এই মুহূর্তে কেউ বলতে পারছে না এ পরিস্থিতির অবসান কবে হবে। মানুষের চরম অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে করোনার কাছে। বলা হচ্ছে- সবগুলো দেশই করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা লুকাচ্ছে। এ ব্যাপারে চীনের দিকে আঙুল তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ।
করোনা সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত আছে। বলা হচ্ছে- এটা মানবসৃষ্ট। আবার ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) বলছে, এটা মানবসৃষ্ট নয়। পরিবেশবাদীরা বলছেন এই অর্থে, মানবসৃষ্ট যে, মানুষ পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে, তাপমাত্রা শোষণের উপায়গুলো ক্রমহ্রাসমান থাকায় বরফ গলতে শুরু করেছে। তাতেই নানা রকম ভাইরাস বরফ পানির সাথে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে, ইত্যাদি।
চীনকে প্রথম অভিযুক্ত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ‘চীনা ভাইরাস’ নামে করোনাকে অভিহিত করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘চীনাঘেঁষা’ নীতির কঠোর সমালোচনা করেই শুধু ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প, বিশ্ব সংস্থার জন্য মার্কিন চাঁদাও বন্ধ করেন। কিন্তু দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রেই সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ করোনাক্রান্ত হয়ে নাভিশ্বাস খেতে।
এটা যে, চীনা ভাইরাস নয় বা মানবসৃষ্ট নয় তা কিন্তু আরো পরে স্পষ্ট হতে থাকে। ইতোমধ্যে শক্তিধর ও উন্নত ধনী দেশের সরকারপ্রধান এবং সরকারি উচ্চ পদে আসীন মন্ত্রীসহ বড় বড় ব্যক্তিরা করোনা থাবায় মৃত্যুবরণ করেছেন বা বিপর্যস্ত হয়েছেন। আমাদের দেশেও এমন ঘটনা বিরল নয়। অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারও করোনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এরপরও মানুষ থেমে নেই জিঘাংসা চরিতার্থ করতে অস্ত্র প্রতিযোগিতায়। হানাহানি প্রতিহিংসা থেকে সামরিক মহড়া দিয়ে প্রতিপক্ষকে হুমকি জানাতে। এই তো সেদিন ভারত-চীন গর্জে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিতে। লাদাখের মালভূমি গালওয়ান উপত্যকায় দুই বাহিনীর প্রচলিত অস্ত্রের লড়াইয়ে ২৩ জন ভারতীয় সেনার প্রাণহানি পরিস্থিতি উত্তেজক করে তোলে। যদিও চূড়ান্ত লড়াইটা ঘটেনি, তবে পরিস্থিতি ১৯৬২ সালের পর চরম উত্তেজনাকর বলে সংবাদমাধ্যমের মত। এখনো অস্ত্রের মহড়া, সেনা সমাবেশ, ঘাঁটি নির্মাণ ইত্যাদিতে দুই দেশ বেশ তৎপর।
বলছিলাম, আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদিতা থেমে থাকেনি। করোনা যতই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিক, মানুষ কত অসহায় একটা অণুজীবের সাথে লড়াইয়ে, তাই উচিত মিলিত শক্তি মানুষের এই চরম শত্রু দমনে আত্মনিয়োগ করা; তার পরিবর্তে চালিয়ে যাচ্ছে অস্ত্র বারুদ ইত্যাদি প্রস্তুতির জন্য ডলার ডলার খরচে। একটা মাঝারি পাল্লার মিসাইল বানাতে বা ক্রয় করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তা দিয়ে বড় বড় দু’টি কোভিড হসপিটাল নির্মাণ করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর এক নম্বর ধনী দেশে আইসিইউ চিকিৎসা বেডের সুবিধা রয়েছে ৯৫ হাজার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্তের সংখা ৬০ লাখ চার হাজার ২৬২। তার মানে আক্রান্তদের যদি ৫০ শতাংশের ভেন্টিলেটর সুবিধার বেডের প্রয়োজন পড়ে তখন? তাহলে অন্যান্য দেশের চিত্রটা অনুধাবন করা যায়। আমাদের দেশের পরিস্থিতি কতটা করুণ তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অথচ সম্প্রতি লকহিড (যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) এফ-১১ একটি সিঙ্গেল আসনের দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট পঞ্চম জেনারেশনের ‘স্টিলথ’ যুদ্ধবিমান নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। এই বিমান নাকি বিশ্বের যেকোনো রাডার ফাঁকি দিতে পারবে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ট্রাম্প দূরপাল্লার হাইপারসোনিক মিসাইল বানাতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিভাগকে। মার্কিন সামরিক ব্যয় সম্পর্কে একটি গল্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পেন্টাগন একটি সামরিক ব্যয় অনুমোদনের জন্য বিল পেশ করে। ট্রাম্পের কাছে বাজেটটি অনেক বেশি মনে হওয়ায় স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠান। নোট দেন- আগের খরচের হিসাব পুনর্মূল্যায়নকৃত বিলের সাথে সংযুক্ত করতে। ওই নোটের জবাবে পেন্টাগণ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টকে পেন্টাগণ হিসাবে ব্যয় দেখাতে বাধ্য নয়।’ বিষয়টা ছিল আফগানিস্তান সংক্রান্ত। তাহলে আমরা বুঝতে পারি, কি বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রসারণবাদী নীতির জন্য ব্যয় করে থাকে।
সম্প্রসারবাদী নীতির দ্বারা তাড়িত রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারতসহ অনেক দেশই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। নব্বই দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ অনেকটাই মিইয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমবৃদ্ধির নীতিতে তেল সমৃদ্ধ মানচিত্রের দিকে হাত বাড়ায়। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য। প্রথমে ফিলিস্তিনকে নিয়ে খেলা শুরু হয়।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর এক পত্র তথা ‘বালফোর ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে ইহুদি ভূমির প্রতি ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রকাশ পায়। ১৮৮৭ সালে ব্যাসলে অনুষ্ঠিত প্রথম জায়নবাদ সম্মেলনে থিওডোর হার্জল ঘোষণা করেছিলেন ওই ইহুদি রাষ্ট্রের। বলেছিলেন- ‘জায়নবাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের একটি জাতীয় আবাস প্রতিষ্ঠা’। এর অব্যবহিত পর ফ্রান্স, ১৯১৮ সালে ইটালি ও আমেরিকা এবং এরপর গ্রিস ও জাপান এর প্রতি সমর্থন জানায়। ৮০ শতাংশ ভূমির মালিক ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জোরজবরদস্তি করে উচ্ছেদ করে চলে ইহুদি ও খ্রিষ্টান, তথা ২০ শতাংশের ভূমিমালিকদের অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পদানত করার কৌশল হিসেবে ইসরাইল নামক বিষবৃক্ষ রাষ্ট্রকে আমেরিকাসহ ওই সব দেশ একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে গড়ে তোলে। আজো ওই কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস বড়ই বেদনাদায়ক এবং বিশ্বাসঘাতকতার। ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য একবার মার্কিনিদের প্রভাববলয়, আরেকবার তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ার আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভের প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেলসম্পদকে লুটেপুটে খাওয়ার মহোৎসব করেছে মার্কিনিরা। রাশিয়াও ছিটেফোঁটা ভাগ নিয়েছে।
এতদিন ফিলিস্তিনকে নিয়ে চলছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভাগাভাগির খেলা। দু’একটা দেশ যখন রাশিয়ার সহযোগিতায় খানিকটা সামরিক শক্তিতে অগ্রসর হয়ে উঠে, তখন মার্কিনিরা ইরান-ইরাক দ্বন্দ্ব বাঁধায় যা একপর্যায়ে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে রূপ নেয়। এরপর ইরাককে দিয়ে কুয়েত দখলের নাটক করে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। এখন চলছে ইরানকে জুজু বানিয়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বল শাসকদের হাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বিভক্তির কূটচাল বিস্তার। কাতারের মতো ছোট্ট দেশও বাধ্য হয় মার্কিনিদের সাথে সাড়ে ১২ বিলিয়ন অস্ত্র কেনার চুক্তি করতে। সৌদি আরব ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে অস্ত্র ক্রয়ের অঙ্কে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথম ১১০ ও পরে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল অঙ্কের চুক্তি স্বাক্ষর করে সৌদি আরব। অস্ত্র ক্রয় করতে নগদ অর্থ যোগান দিতে হয়। কবে অস্ত্র পাওয়া যাবে, আদৌ পাওয়া যাবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই।
পাকিস্তান নব্বইয়ের দশকে ৩২ এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ পরিশোধ করে মাত্র আটটি লাভ করে, বাকিগুলো আজতক সরবরাহ করেনি মার্কিনিরা। তুরস্ক (ন্যাটোভুক্ত দেশ) ১০০ এফ-২৫ যুদ্ধবিমান যৌথভাবে নির্মাণের চুক্তি করে সব অর্থ পরিশোধ করা সত্ত্বে¡ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে মিসাইল সিস্টেম ‘এম-৪০০’ ক্রয় করার অজুহাতে দেয়নি যুদ্ধবিমানগুলো। আরব আমিরাতও বড় অঙ্কের অস্ত্র ক্রয়চুক্তি করেছে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। ‘ইরান জুজু’ দেখিয়ে চলছে অস্ত্র ব্যবসায়।
মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ তেল সম্পদের সুবাদে বিপুল অর্থে মালিক। এদের হাতে বিপুল পেট্রোডলার। মার্কিনি ও সম্প্রসারণবাদী দেশগুলো দিনের পর দিন নানা ছলাকলার ফাঁদে আটকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রোডলার। এখন সৌদি আরব, আমিরাত ভাবতে বসেছে বিপুল অস্ত্রের মালিক যখন হয়েছি আরব জাহানের মোডল হিসেবে মানতে হবে অন্যদের। সেই মান্যতা আদায় করতেই ইয়েমেন আক্রমণ, কাতার অবরোধের ঘটনা। কিন্তু বিধি বাম।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন খেলোয়াড় জুটেছে আরো দেশ- তুরস্ক, চীন ও ইরান। ইরানের সাথে চীনের ২৫ বছরের কিসের চুক্তি? বলা হচ্ছে ‘কৌশলগত’। চীন পাকিস্তানকে দিয়ে মুসলিম শক্তির মোর্চা গঠনের কাজ চালাচ্ছে তারা মার্কিনিদের প্রতিরোধ করতে। যাতে রাশিয়ানির্ভরতা থেকে এসব পেট্রোডলারের দেশ বাইরে থাকে। অস্ত্র বিক্রিতে চীনও মাথা ঢোকাতে চায় মধ্যপ্রাচ্যে। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটে। মার্চের শেষের দিকে তারা রোগটির বিস্তার ঠেকাতে সক্ষম হয় লকডাউন, শাটডাউন ইত্যাদির মাধ্যমে। ব্যাপক পরীক্ষা, দ্রুত চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করে তারা সাফল্য পায়। এখন পর্যন্ত তারা এ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। লকডাউনমুক্ত হয়েছে গোটা চীন। তারা ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার কাজেও বেশ এগিয়ে গেছে। তিন ধাপের পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে যৌথভাবে পরীক্ষার জন্য। করোনা মোকাবিলায় চীনের সাফল্যকে ভাগাভাগি করতে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইতালি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
কিন্তু সেই চীনও করোনা সঙ্কটের জন্য থেমে থাকেনি তাদের সম্প্রসারণবাদিতায়। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-চীন চিহ্নিত পানি সীমানার বিশাল সন্নিহিত মানচিত্রের ওপর চীন ইতোমধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত চীনের আধিপত্য টিকে আছে সেখানে। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সাউথ-চীনে কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করে বিমান উড্ডয়ন রানওয়ে নির্মাণ, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন, নিয়মিত সামরিক মহড়া পরিচালনার মাধ্যমে চীন ক্রমাগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আপাতত চীনের নৌবহরে বিমানবাহী রণতরী থাকলেও আরো একটি ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয়, যার কমিশনিং খুব শিগগিরই হবে। এ ছাড়া আরো তিনটি রণতরী নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যায়ে ছয়টি রণতরী নির্মাণের টার্গেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ রেপ্টার (স্টিলথ) অনুরূপ যুদ্ধ বিমান বানিয়ে ফেলেছে (জে-২০)।
তুমুলভাবে চলছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় মাথা ব্যথার কারণ। ওই মিসাইল সিস্টেম পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে কতিপয় দেশ। এর মধ্যে ইরান অগ্রগামী। রাশিয়া আরো উন্নত এবং বহুমুখী মিসাইল সিস্টেম এম-৫০০ বানিয়ে ফেলেছে। চীন চেষ্টা চালাচ্ছে এম-৪০০ এর কপি বানাতে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে বলেছে, রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম তার কাছে বিক্রি করলে ১০০ এফ-৩৫ বিমান দিতে বাধা থাকবে না। তার মানে, রুশ অস্ত্রের কপি বানাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
কিছু কৌশলগত অস্ত্র তৈরিতে তুরস্ক ও ইরান পেছনে পড়ে থাকলেও এ দুটি দেশ অস্ত্র নির্মাণে পরনির্ভরতা থেকে অনেকটা উঠে এসেছে। তাই এ দু’টি দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখাতে পারছে। গ্রিসের সাথে তুরস্কের উত্তেজনা শেষতক যুদ্ধে গড়ালে তা হবে শক্তি প্রতিযোগিতার আরেক নির্ণায়ক ঘটনা। ইউরোপ তখন পাবে নতুন মানচিত্র। তেমনি চীন-ভারত উত্তেজনা যদি স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধে রূপ নেয়, এখানেও ঘটবে মানচিত্রের পরিবর্তন এবং নতুন অক্ষশক্তির উত্থান।
ভারত সামরিক শক্তিতে পৃথিবীতে চতুর্থ। বিশাল সেনাবহর, বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার। সারা পৃথিবীর সেরা অস্ত্র সংগ্রহ তাদের সামরিক শক্তিকে করেছে ক্ষুরধার। কিন্তু তাদের দুর্বলতা হচ্ছে- নিজস্ব প্রযুক্তিতে তেমন উন্নত অস্ত্র নির্মাণে এগিয়ে যেতে পারেনি। আর সে কারণে অস্ত্র ক্রয়ের বাজারে ভারত বিগত কয়েক বছর একনম্বর ক্রেতা ছিল। এখনো দুই হাতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করছে। তাদের সামনে চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে মোকাবেলার একটা চ্যালেঞ্জ থাকে।
সারা বিশ্বে চলছে সামরিক মহড়া। নতুন নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা। নতুন যুদ্ধকৌশল বিস্তারের নানা স্থাপন নির্মাণ। তারকাযুদ্ধের বিস্তৃতি বন্ধের সে-ই কবে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া বের হয়ে এলেও তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে মহাশূন্যে। চীন নাকি মহাশূন্যে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট স্টেশন স্থাপন করেছে যেখানে তাদের পরমাণু শক্তির বোমার ওয়ারহেডগুলোর নিয়ন্ত্রণ সংরক্ষিত। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ স্থল ধ্বংস হলেও যুদ্ধ চালাবে ওই স্যাটেলাইট স্টেশন থেকে। এ রকম অনেক গোপন সামরিক প্রস্তুতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভারত ভিন্ন একটি দেশে ২০০ যুদ্ধবিমান লুকিয়ে রেখেছে- যা যুদ্ধকালে উড়াতে সক্ষম হবে। ইরানও মাটির ভেতর নাকি বিশাল মিসাইল ভণ্ডার লুকিয়ে রেখেছে।
এসব করা হচ্ছে সম্প্রসারণবাদিতার জন্য তা ঠেকাতে। অথচ করোনা নামক অণুজীবের কাছে আমরা কত অসহায়!
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক