মধ্যপ্রাচ্যে ভাগাভাগির খেলা
মধ্যপ্রাচ্যে ভাগাভাগির খেলা - ছবি সংগৃহীত
সম্প্রসারবাদী নীতির দ্বারা তাড়িত রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারতসহ অনেক দেশই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। নব্বই দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ অনেকটাই মিইয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমবৃদ্ধির নীতিতে তেল সমৃদ্ধ মানচিত্রের দিকে হাত বাড়ায়। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য। প্রথমে ফিলিস্তিনকে নিয়ে খেলা শুরু হয়।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর এক পত্র তথা ‘বালফোর ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে ইহুদি ভূমির প্রতি ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রকাশ পায়। ১৮৮৭ সালে ব্যাসলে অনুষ্ঠিত প্রথম জায়নবাদ সম্মেলনে থিওডোর হার্জল ঘোষণা করেছিলেন ওই ইহুদি রাষ্ট্রের। বলেছিলেন- ‘জায়নবাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের একটি জাতীয় আবাস প্রতিষ্ঠা’। এর অব্যবহিত পর ফ্রান্স, ১৯১৮ সালে ইটালি ও আমেরিকা এবং এরপর গ্রিস ও জাপান এর প্রতি সমর্থন জানায়। ৮০ শতাংশ ভূমির মালিক ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জোরজবরদস্তি করে উচ্ছেদ করে চলে ইহুদি ও খ্রিষ্টান, তথা ২০ শতাংশের ভূমিমালিকদের অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পদানত করার কৌশল হিসেবে ইসরাইল নামক বিষবৃক্ষ রাষ্ট্রকে আমেরিকাসহ ওই সব দেশ একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে গড়ে তোলে। আজো ওই কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস বড়ই বেদনাদায়ক এবং বিশ্বাসঘাতকতার। ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য একবার মার্কিনিদের প্রভাববলয়, আরেকবার তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ার আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভের প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেলসম্পদকে লুটেপুটে খাওয়ার মহোৎসব করেছে মার্কিনিরা। রাশিয়াও ছিটেফোঁটা ভাগ নিয়েছে।
এতদিন ফিলিস্তিনকে নিয়ে চলছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভাগাভাগির খেলা। দু’একটা দেশ যখন রাশিয়ার সহযোগিতায় খানিকটা সামরিক শক্তিতে অগ্রসর হয়ে উঠে, তখন মার্কিনিরা ইরান-ইরাক দ্বন্দ্ব বাঁধায় যা একপর্যায়ে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে রূপ নেয়। এরপর ইরাককে দিয়ে কুয়েত দখলের নাটক করে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। এখন চলছে ইরানকে জুজু বানিয়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বল শাসকদের হাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বিভক্তির কূটচাল বিস্তার। কাতারের মতো ছোট্ট দেশও বাধ্য হয় মার্কিনিদের সাথে সাড়ে ১২ বিলিয়ন অস্ত্র কেনার চুক্তি করতে। সৌদি আরব ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে অস্ত্র ক্রয়ের অঙ্কে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথম ১১০ ও পরে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল অঙ্কের চুক্তি স্বাক্ষর করে সৌদি আরব। অস্ত্র ক্রয় করতে নগদ অর্থ যোগান দিতে হয়। কবে অস্ত্র পাওয়া যাবে, আদৌ পাওয়া যাবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। পাকিস্তান নব্বইয়ের দশকে ৩২ এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ পরিশোধ করে মাত্র আটটি লাভ করে, বাকিগুলো আজতক সরবরাহ করেনি মার্কিনিরা। তুরস্ক (ন্যাটোভুক্ত দেশ) ১০০ এফ-২৫ যুদ্ধবিমান যৌথভাবে নির্মাণের চুক্তি করে সব অর্থ পরিশোধ করা সত্ত্বে¡ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে মিসাইল সিস্টেম ‘এম-৪০০’ ক্রয় করার অজুহাতে দেয়নি যুদ্ধবিমানগুলো। আরব আমিরাতও বড় অঙ্কের অস্ত্র ক্রয়চুক্তি করেছে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। ‘ইরান জুজু’ দেখিয়ে চলছে অস্ত্র ব্যবসায়।
মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ তেল সম্পদের সুবাদে বিপুল অর্থে মালিক। এদের হাতে বিপুল পেট্রোডলার। মার্কিনি ও সম্প্রসারণবাদী দেশগুলো দিনের পর দিন নানা ছলাকলার ফাঁদে আটকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রোডলার। এখন সৌদি আরব, আমিরাত ভাবতে বসেছে বিপুল অস্ত্রের মালিক যখন হয়েছি আরব জাহানের মোডল হিসেবে মানতে হবে অন্যদের। সেই মান্যতা আদায় করতেই ইয়েমেন আক্রমণ, কাতার অবরোধের ঘটনা। কিন্তু বিধি বাম।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন খেলোয়াড় জুটেছে আরো দেশ- তুরস্ক, চীন ও ইরান। ইরানের সাথে চীনের ২৫ বছরের কিসের চুক্তি? বলা হচ্ছে ‘কৌশলগত’। চীন পাকিস্তানকে দিয়ে মুসলিম শক্তির মোর্চা গঠনের কাজ চালাচ্ছে তারা মার্কিনিদের প্রতিরোধ করতে। যাতে রাশিয়ানির্ভরতা থেকে এসব পেট্রোডলারের দেশ বাইরে থাকে। অস্ত্র বিক্রিতে চীনও মাথা ঢোকাতে চায় মধ্যপ্রাচ্যে। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটে। মার্চের শেষের দিকে তারা রোগটির বিস্তার ঠেকাতে সক্ষম হয় লকডাউন, শাটডাউন ইত্যাদির মাধ্যমে। ব্যাপক পরীক্ষা, দ্রুত চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করে তারা সাফল্য পায়। এখন পর্যন্ত তারা এ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। লকডাউনমুক্ত হয়েছে গোটা চীন। তারা ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার কাজেও বেশ এগিয়ে গেছে। তিন ধাপের পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে যৌথভাবে পরীক্ষার জন্য। করোনা মোকাবিলায় চীনের সাফল্যকে ভাগাভাগি করতে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইতালি চুক্তি স্বাক্ষর করে।