খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যাপারে ইসলামের বিধিনিষেধ
খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যাপারে ইসলামের বিধিনিষেধ - ছবি সংগৃহীত
ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। প্রকৃতির যা কিছু সুন্দর তার সবই ইসলামে অনুমোদিত। অবশ্য নফসানি সব সুন্দর ইসলামে নিষিদ্ধ-নিন্দিত। প্রকৃতি আর নফসানির মাঝে পার্থক্য হলো- আপনার কর্মচারী আপনার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করা হলো প্রকৃতি। কর্মচারী নিজের পছন্দ অনুযায়ী আপনার কাজ করা হলো নফসানি। আপনি নিশ্চয়ই কাজের দ্বিতীয় পদ্ধতি সমর্থন করবেন না। সে যত সুন্দর করেই কাজ করুক না কেন।
পৃথিবীর মালিক আল্লাহ। পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হবে তাঁর গাইডলাইন অনুযায়ী। এটাই প্রকৃতি। আল্লাহর গাইডলাইন হলো ইসলাম। তাই ইসলামে যা আছে সবই সুন্দর। সবই প্রকৃতি। ইসলামের বাইরে যা সুন্দর তা নফসানি। ঈমানদারদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে নফসানি পরিহার করা। তিনি বলেন, ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার করো। তুমি তোমার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। কেননা, তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে।’ (সূরা সাদ-২৬)
নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার নফস আমার আনীত কুরআন-সুন্নাহর অনুগত হবে।’ (আল আরবাঈন-হাদিস : ৪১)
মানব প্রকৃতির একটি হলো আনন্দ বিনোদন। ভালো-মন্দ যে কাজই করুক না কেন, একাধারে এক কাজ করলে বিরক্তি আসে। এক জায়গায় থাকতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই ক্লান্তি আর অবসাদ দূর করতে শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় যুক্ত হয়। আর বড়রা খেলাধুলা দেখা কিংবা অন্য কোনো বিনোদনে জড়ায়। একটু চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ তায়ালাও তাঁর বান্দার শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির ব্যবস্থা করেছেন। ২৪ ঘণ্টার রুটিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দিয়েছেন। কাজের ফাঁকে পাঁচবার অজু ও নামাজ আদায়ে মানুষের আত্মিক ও দৈহিক প্রশান্তির কথা বিজ্ঞানও স্বীকার করে। এছাড়া নামাজের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ যাবতীয় মন্দ ও অশ্লীলতা থেকে বারণ করে।’ (সূরা আনকাবুত-৪৫) মন্দ আর পাপাচারের দুনিয়ার ক্ষতি হলো দেহ-মনের বিষণ্নতা। যা নামাজে দূর হয়। সুতরাং ঈমানদারের চিত্তানন্দের জন্য নামাজই হতে পারে শ্রেষ্ঠ উপায়।
খেলাধুলায়ও শরীরচর্চা এবং বিনোদনকেন্দ্রিক মানুষের কিছু উপকার রয়েছে। তাই খেলাধুলাকে ইসলাম নিষেধ করেনি। বরং খেলাধুলার মাঝে একটা সীমারেখা টেনে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু প্রকৃতির দাবিটুকু রেখে নফসানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সুস্থ প্রকৃতির দাবি হচ্ছে- কল্যাণকর কাজে জীবন ব্যয় করা। সাথে ঈমানের দাবি হচ্ছে, দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে কল্যাণ হয় এমন কাজ করা। আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো খেলাধুলা শরিয়ত অনুমোদন করে না। ইরশাদ হয়েছে- ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনর্থক কথা খরিদ করে, আর তারা ওইগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’ (সূরা লোকমান, আয়াত : ৬) এই আয়াতে অনর্থক কথায় বিনোদনের নামে গান-বাজনা বাজানোর ক্ষতি উল্লেখ করা হয়েছে। (রুহুল মায়ানি)
খেলাধুলায় নফসানি প্রবল থাকে বিধায় কুরআন-হাদিসে খেলাধুলার ব্যাপারে অধিক সতর্ক বার্তা উল্লেখ আছে। এ কারণে খেলাধুলা বৈধতার জন্য শরিয়ত কিছু নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন-
১. খেলাধুলাকে জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য না বানানো : কেননা, ঈমানদারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর ইবাদত, খেলা নয়। মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা জারিয়াত-৫৬)
২. সতর আবৃত রাখা : সতর (শরিয়ত কর্তৃক শরীরের নির্দিষ্ট অংশ) ঢাকা ওয়াজিব। অথচ অনেক খেলায় পুরুষের সতর খোলা থাকে। আলী রা: সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘তুমি নিজের ঊরু খুলো না। কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির ঊরুর দিকে দৃষ্টি দিও না।’ (আবু দাউদ : ৪০১৭) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, সতর খুলে খেলায় অংশগ্রহণ যেমন নাজায়েজ, এমন খেলা দেখাও নাজায়েজ।
৩. খেলা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া : খেলার জন্য নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা বা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার অনুমতি ইসলামে নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেরা নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫) রাসূল সা: বলেন, ‘ইসলামে কারোর ক্ষতি করা নেই, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও নেই।’ (মুয়াত্তা মালিক : ২৭৫৬; দারাকুতনি : ৪৫৯৫)
৪. হারাম উপার্জন মুক্ত হওয়া : খেলাধুলায় জুয়া ও বাজি ধরা হলে তা বৈধ নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো। যেন তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর চায় আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। তাই তোমরা কি বিরত হবে না?’ (সূরা মায়িদা : ৯০-৯১)
৫. জয়-পরাজয়ে শত্রুতা সৃষ্টি না হওয়া : খেলার জয়-পরাজয়ের কারণে শত্রুতা কিংবা মিত্রতা কোনোটাই ইসলামে কাম্য নয়। ইসলামে শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি কেবল আল্লাহর ভালোবাসা। আবু উমামা রা: সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘যে কাউকে আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে ও আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে এবং কাউকে কিছু দিয়ে থাকে আল্লাহর জন্যই, আবার কাউকে কিছু দেয়া থেকে বিরতও থাকে আল্লাহর জন্যই, তাহলে তার ঈমান পরিপূর্ণ হলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৮১)
৬. সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা : যেমন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, গান-বাজনা ইত্যাদি।
এ জাতীয় নানা শর্তে ইসলামে খেলাধুলার বৈধতা দেয়া হলেও বর্তমানে প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন নেই বললেই চলে। এসব খেলার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি, নামাজের প্রতি অবহেলা, ইসলামবহির্ভূত অন্য কিছুর অনুসরণ, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজি ধরা, রংখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উলকি আঁকা ইত্যাদির বাহুল্য থাকে। তাই এ ধরনের বাহুল্যযুক্ত সব খেলাধুলা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। আধুনিককালের খেলাধুলায় নানা শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটেছে। খেলার সাথে যুক্ত হয়েছে বহু নিষিদ্ধ বিষয়। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম খেলাধুলার ক্ষেত্রে বল্গাহীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আর সুস্থ সুন্দর ও শরিয়তের সীমায় থেকে খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম, দক্ষিণ কাজলা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা