ভারতীয় পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ না দিতে ইসরাইলি আদালতে আবেদন
ভারতীয় পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ না দিতে ইসরাইলি আদালতে আবেদন - ছবি : সংগৃহীত
ভারত-শাসিত কাশ্মির মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের ‘মারাত্মক লঙ্ঘনের’ সাথে জড়িত ভারতীয় পুলিশ অফিসারদের প্রশিক্ষণ থেকে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিরত রাখার জন্য কয়েক ডজন ইসরাইলি অ্যাক্টিভিস্ট সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন।
চল্লিশজন আবেদনকারীর অন্যতম ইসরাইলি মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট সাইগাল আভিভি আল জাজিরাকে বলেন, আমরা কাশ্মিরি জনসাধারণের সাথে সংহতি প্রকাশের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
আবেদন দাখিলকার ইসরাইলি মানবাধিকার আইনজীবী ইতে ম্যাক বলেন, জানুয়ারিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা কাশ্মিরে কিনা তা যাচাই করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে ইসরাইলি পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অস্বীকৃতি জানায়।
ইসরাইলে গত সপ্তাহে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফার দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ায় আদালতের কার্যক্রম আরো বিলম্বিত হবে।
আবেদনে বলা হয়, সত্য বটে, ভারত হলো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ এবং ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার। কিন্তু তা কাশ্মিরে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় মরাত্মক অপরাধে জড়িত বিশেষ ভারতীয় পুলিশদের ইসরাইলি পুলিশের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করার অজুহাত হতে পারে না।
ইসরাইলে আফ্রিকান আশ্রয় প্রার্থীদের সাথে কাজে জড়িত আভিভি বলেন, বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমরা জানতে চাই যে আপনার সাথে কী হচ্ছে। আমরা অজ্ঞ থাকতে চাই না।
মে মাসে ইসরাইলি সরকার আবেদনটি খারিজ করে দেয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে অনুরোধ করে। ওই অনুরোধে বলা হয়েছিল যে ভারতীয় পুলিশ সদস্যদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো বা যাচাই করার কাজটি হবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল। এতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইসরালি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে মন্তব্য করেনি।
ভারত ও ইসরাইল ২০১৪ সালে ব্যাপকভিত্তিক একটি সহযোগিতা চুক্তি সই করে। এতে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ, অর্থ পাচার, মানব পাচার, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানসহ ‘পাবলিক অ্যান্ড হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’ সম্পর্কিত বিষয়াদি স্থান পায়।
আন্তর্জাতিক অধিকার গ্রুপগুলো ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি রকমের শক্তি প্রয়োগ ও ইসরাইলি অধিকৃত এলাকায় তাদের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপের জন্য ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিযুক্ত করে আসছে।
ইসরাইল ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনের বিরাট অংশ দখল করার পর থেকে তাজা গুলি ব্যবহার, চেকপোস্টে বেসামরিক লোকজনকে গুলি করা, বন্দীদের ওপর নির্যাতন, শিশুদের গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে বলে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
আভিভি বলেন, ফিলিস্তিনি ও অধিকৃত এলাকার অভিবাসীদের প্রতি ইসরাইলের অসদাচরণের প্রেক্ষাপটে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে বিদেশি সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে বিশ্বজুড়ে লোকজনকে আঘাত দিতে থাকবে।
‘অনিষ্টকর প্রতিষ্ঠান’
কাশ্মিরে ৫ লাখের বেশি ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন আছে কয়েক দশক ধরে চলা ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে চলা সশস্ত্র বিদ্রোহ ঠেকাতে। অথচ সেখানে জনসংখ্যা রয়েছে ১২ লাখ।
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন, নির্যাতন, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেফতারের অভিযোগ রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার অভিযোগগুলোর ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহেই ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে যে তার সৈন্যরা জুলাই মাসে তিন বেসামরিক নাগরিককে হত্যায় অন্যায় কাজ করেছে।
লাফায়েতে কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হাফসা কানজওয়াল বলেন, অধিকৃত কাশ্মিরে যাতে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধেদ কোনো ধরনের প্রতিবাদ না দেখা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
অবশ্য নয়া দিল্লি তার বাহিনীকে সমর্থন করে বলেছে যে তারা স্বাধীনতাকামী বা পাকিস্তানের সাথে একীভূত হতে আগ্রহী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মির নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। উভয় দেশই কাশ্মিরের অংশবিশেষের অধিকারী।
কানজওয়ালের মতে, কাশ্মিরে ভারতীয় পুলিশ ‘চরম অনিষ্টকারী প্রতিষ্ঠান।‘ তিনি বলেন, তারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত এবং সম্পূর্ণ দায়মুক্তি নিয়ে কাশ্মিরি জনগণের ওপর যা ইচ্ছা করে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক নীতি
ভারত ও ইসরাইল ১৯৯২ সাল কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশের মধ্যকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।
দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ১৯৯২ সালেল মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে হয়েছে ৫.৮৪ বিলিয়ন ডলার। বেশির ভাগ বাণিজ্য হয় প্রতিরক্ষা খাতে।
ইসরাইলি অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা হলো ভারত। ২০১৩-১৭ সময়কালে ইসরাইল যত অস্ত্র রফতানি করেছে, তার অর্ধেক কিনেছে ভারত।
ভারতে বিক্রি করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী প্রতিরক্ষা সিস্টেম, বিমান থেকে বিমানে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, অ্যাসাল্ট রাইফেল ইত্যাদি। এর মধ্যে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মিরে ট্যাভর অ্যান্ড গালিল অ্যাসাল্ট রাইফেল ব্যবহার করে। আর চীন সীমান্তের লাদাখে ব্যবহার করে হেরন ড্রোন।
ভারতে অব্যাহত করোনাভাইরাস অতিমারির মধ্যেই ২০২০ সালের মে মাসে ইসরাইল থেকে ১১৬ মিলিয়ন ডলারে ১৬,৪৭৯টি নেগেভ লাইট মেশিন গান কেনে।
কাশ্মিরের বাইরেও ভারতীয় নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে ইসরাইলি অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। ২০১৯ সালে ফেসবুকের মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপ অভিযোগ করে, ইসরাইলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপ বিরোধী নেত্রী ও কংগ্রেস সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ রাজনীতিবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষাবিদদের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে।
ইসরাইলি পুলিশব্যবস্থা
মে মাসে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর মার্কিন পুলিশের সাথে ইসরাইলি পুলিশের বিনিময় কর্মসূচিও আলোচনায় আসে।
রিসার্চিং দি আমেরিকান-ইসরাইলি অ্যালায়েন্স ও জিউশ ভয়েস ফর পিস গ্রুপ ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক নজরদারি, বর্ণবাদী কার্যক্রমকে যৌক্তিককরণ, গণবিক্ষোভ দমন হলো মার্কিন পুলিশ কর্মকর্তাদের ইসরাইলি প্রশিক্ষণের ফল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৬ সালে জানিয়েছিল, ইসরাইলি পুলিশই মার্কিন পুলিশ সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত করছে।
আমরা নীরবে বসে থাকতে পারি না
অ্যাক্টিভিস্ট আভিভি ও নেসেট সদস্য ক্যাসিফ উভয়েই সুপ্রিম কোর্টে এই আবেদনে জয়ের ব্যাপারে সামান্যই আশাবাদী। তারা জানান, ইতোপূর্বে সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের সব মামলা খারিজ করে দিয়েছিল।
আভিভি আল জাজিরাকে বলেন, আমরা জানি যে আমরা সফল হতে পারব না। তবে আমরা নীরবে বসে থাকতে পারি না।
সূত্র : আল জাজিরা/এসএএম