৭০ বছরের বৃদ্ধ যেভাবে সর্বস্বান্ত হন সাদিয়া জান্নাতের কাছে
সাদিয়া জান্নাত - ছবি : সংগৃহীত
শুরুটা করা যাক আন্তর্জাতিক এক প্রতারকের কাহিনী দিয়ে৷ এই ব্যক্তির ছদ্মনাম সাইমন লেভিয়েভ৷ আসল নাম সিমন হায়ুত৷ গত বছর তাকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাড়া ফেলেছিল নরওয়ের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ভিজি৷
ইসরাইলি এই যুবক ডেটিং-অ্যাপ ‘টিন্ডারের’ মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামর্থ্যবান তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতান৷ নিজেকে পরিচয় দেন বিরাট ধনী হিসেবে৷ এরপর পরিচয় হওয়া নারীদের সঙ্গে তিনি ডেটিং শুরু করেন৷
ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে তাদের নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ান৷ বিলাসবহুল হোটেলে থাকেন৷ সঙ্গে রাখেন ভাড়া করা বডিগার্ড৷ ভুয়া ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক সফরসঙ্গী৷ একেকজন নারীর সঙ্গে মাসের পর মাস বা বছর অবধি এই সম্পর্ক গড়াতে থাকে৷
একপর্যায়ে তিনি বিভিন্ন বিপদের কথা বলে প্রেমিকাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা ধার করতে শুরু করেন৷ তাকে উদ্ধারের জন্য কেউ কেউ ব্যাংক ঋণ করেও কয়েক কোটি টাকা ধার দেন৷ যেমন নরওয়ের সিসিলিয়ে৷ সিমনের জন্য তিনি দশটি ব্যাংক থেকে ঋণ করেছিলেন৷ পরে ওই টাকা পরিশোধের ভুয়া ডকুমেন্ট পাঠান সিমন সেসিলিয়ের কাছে৷ এর মধ্যেই সিমন পার্নিলা খয়াহোলম নামের আরেক সুইডিশ তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত গড়তে শুরু করে দিয়েছেন টিন্ডারে৷
ভিজির অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেসিলিয়ের পাঠানো টাকা থেকে সিমন পার্নিলাকে চার লাখ ক্রোনা আর সেই সঙ্গে ব্যাংকক যাওয়ার টিকেট কিনে পাঠিয়েছিলেন৷ সেসিলিয়ে কিংবা পার্নিলা যতক্ষণে তার অভিসন্ধি আঁচ করতে পারেন ততক্ষণে একজনকে ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে ডেটিং শুরু করেন সিমন৷ নতুন প্রেমিকার জন্য একই উপায়ে বিছান প্রতারণার জাল৷
কয়েক বছর ধরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন দেশের একাধিক নারীকে এমন অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন সিমন৷ ২০১১ সালেই ইসরাইলে তার বিরুদ্ধে চুরি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা হয়েছিল৷ কিন্তু গোটা ইউরোপ চষে বেড়ানো এই সিমনের টিকির দেখাও পাচ্ছিল না দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ ২০১৫ সালে ফিনল্যান্ডে তিন নারীর সঙ্গে প্রতারনায়ও অভিযুক্ত হন তিনি৷ শুধু ইসরাইল বা ফিনল্যান্ড নয় সিমনকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল সুইডেন, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক আর নরওয়ের পুলিশও৷ অবশেষে তিনি ধরা পড়েন ২০১৯ সালের জুনে গ্রিক পুলিশের হাতে৷
সম্প্রতি বাংলাদেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক নারীকে গ্রেফতার করে৷ তার ছদ্মনাম জান্নাতুল ফেরদৌস৷ আসল নাম সাদিয়া জান্নাত৷ সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির দেয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫-৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন৷ সিমনের ফাঁদ পাতার মাধ্যম ছিল টিন্ডার অ্যাপ৷ আর সাদিয়ার ছিল সংবাদপত্রে কানাডাপ্রবাসী ধণাঢ্য নারীর জন্য ‘ধার্মিক ও সুপাত্র’ চেয়ে বিজ্ঞাপন৷ বিয়ের পর সেই পাত্র পাবেন কানাডায় বসবাসের সুযোগ৷ এই বিজ্ঞাপন দেয়ার পর সাদিয়াকে তার সম্ভাব্য ‘পাত্রদের’ পিছনে সিমনের মতো তেমন বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়নি৷ উন্নত দেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্নে বিভোর যুবা, এমনকি বৃদ্ধরাও এসে ধরা দেন তার জালে৷ উল্টো তারাই কাড়ি কাড়ি টাকা তুলে দেন তার হাতে৷ হয়ে যান সর্বস্বান্ত৷
তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ৭০ বছর বয়সী ঢাকার এক ব্যবসায়ীর প্রতারিত হওয়ার কাহিনী৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত বর্ণনা অনুযায়ী কানাডা নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে তিন দফায় টাকা নেন সাদিয়া৷ ভিসা আবেদনের জন্য দেড় লাখ, ভিসার জন্য ৭০ হাজার, ট্রাভেল ডকুমেন্টস তৈরির জন্য ছয় লাখ, কানাডার সোশ্যাল সিকিউরিটির জন্য ৬০ লাখ টাকা তুলে দেন তিনি৷ টাকা দেয়ার কিছু দিন পর সাদিয়া ওই ব্যক্তিকে বলেন কানাডায় অনেক শীত, যে কারণে তিনি থাকতে পারবেন না৷ তার চেয়ে সাদিয়া তার নিজের ২০০ কোটি টাকাও কানাডা থেকে নিয়ে আসবেন৷ বিয়ে করে দুজনে ঢাকাতেই বসবাস করবেন৷ এরপর শুরু হয় ওই ব্যক্তির ও সাদিয়ার কথিত টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া! এজন্য আরো তিন ধাপে সাদিয়াকে ২৩ লাখ, ৭২ লাখ ও ১০ লাখ টাকা দেন ব্যবসায়ী৷ একসময় সাদিয়া তাকে ২০০ কোটি টাকা দেয়ার কথা বলে একটি প্যাকেট তুলে দেন৷ বাসায় নিয়ে খোলার পর যেখানে পেয়েছেন ‘এ-ফোর সাইজের ৫০০টি সাদা কাগজের একটি বান্ডিল’৷ এর মধ্যেই মোট এক কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নাই হয়ে গেল সত্তরের প্রৌঢ় ব্যবসায়ীর৷
সিমন আর সাদিয়া বিশ্বের দুই প্রান্তের দুজন৷ তাদের প্রতারণার ধরনে আছে অনেক মিল আবার অনেক অমিলও৷ সিমন এক প্রেমিকার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আরেক প্রেমিকার পেছনে খরচ করেন৷ নিজেও বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন৷ সাদিয়ার কোনো বিনিয়োগ বা দেয়া-নেয়া নেই৷ পুরোটাই আত্মসাৎ করেন৷ সিমনের প্রেমিকারা ভালোবেসে প্রেমিককে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য টাকা দেন৷ আর সাদিয়ার ‘পাত্ররা’ তাকে টাকা দেন বিদেশে পাড়ি জমিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে৷ একটি কাহিনীর চরিত্ররা ইউরোপের উন্নত দেশের আরেকটি এশিয়ার স্বল্পোন্নত (জাতিসংঘের তালিকায়) কিংবা স্বল্প মধ্যম আয়ের দেশের (বিশ্বব্যাংকের তালিকা)৷ যেখানে ৭০ বছরের একজন অবস্থাসম্পন্ন ব্যবসায়ীও বিদেশ পাড়ি জমাতে চান, প্রয়োজনে কাউকে বিয়ে করে হলেও৷
শুধু পাত্র চাই বিজ্ঞাপন নয়, ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে, পত্রিকায়, লিফলেটে সহজে ক্যানাডা-অ্যামেরিকা, ইউরোপ যাওয়ার লোভনীয় অফার চলে৷ সেই অফারে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত থাকেন কত হাজার, লাখোজন! কত রকমের প্রতারণা যে পথে পথে তাদের অপেক্ষায় থাকে তার খবর প্রায়ই মিলে৷ ইউরোপের স্বপ্ন থেমে যায় লিবিয়ায় কিংবা ভূমধ্যসাগরে৷ অনেকের পরিবার সর্বস্বান্ত হয় বন্দিদের জন্য দালাল, দস্যুদের মুক্তিপণের অর্থ দিতে দিতেই৷ মালয়েশিয়ার স্বপ্ন আটকে যায় অনেকের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে৷ এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ভিয়েতনাম কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেউ নিঃস্ব হয়ে ফিরলে বিহিত না করে রাষ্ট্রও যেন আরেক দফা প্রতারণা করে৷ প্রতারকদের না ধরে ভুক্তভোগীদেরই জেলে পোরে৷ বিশ্বাস ভঙ্গের ফাঁদ ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার, হাত ধরাধরি করেই যেন আছে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে