বিশ্বকে যেভাবে শোষণ শুরু করেছিল ইউরোপ

মুসা আল হাফিজ | Sep 25, 2020 05:46 pm
বিশ্বকে যেভাবে শোষণ শুরু করেছিল ইউরোপ

বিশ্বকে যেভাবে শোষণ শুরু করেছিল ইউরোপ - ছবি : সংগৃহীত

 

বিশ্বের ওপর স্পেন ও পর্তুগালের অধিকার প্রশ্নে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৩১-১৫০৩) এ সিদ্ধান্ত প্রদান করেন ১৪৯৪ সালের ৭ জুন। তিনি ইউরোপের বাইরের গোটা দুনিয়াকে বণ্টন করে দেন স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে। ইউরোপবহির্ভূত দুনিয়াকে তিনি দুই ভাগ করেন। পশ্চিম ভাগ দেন স্পেনকে, পূর্বভাগ পর্তুগালকে। উত্তর ও দণি আমেরিকা মহাদেশ দখল করে শাসন করবে স্পেন। পর্তুগাল দখল ও শাসন করবে আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপসমূহ। সেখানকার জীবন, সম্পদ, মানুষ ও প্রকৃতি, সভ্যতা-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুতে তারা কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারবে।

দেশ দখল ও শাসন, দাস বানানো বা শাস্তিদান, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, সম্পদ আত্মসাৎ কিংবা ব্যবহার সবকিছুতেই তাদের অধিকার। তারা সেখানকার অসভ্যদের সভ্য বানাবে, তথা অখ্রিষ্টানদেরকে খ্রিষ্টান বানাবে। বিনিময়ে নেটিভদের জীবন ও জগতে প্রতিষ্ঠা পাবে তাদের অধিকার।

সেকালে গড়পড়তা একজন পাদ্রী ও ইউরোপীয় দুনিয়াকে কিভাবে নিজের শিকার ক্ষেত্র মনে করতেন, তারই নমুনা ওই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটি যিনি দেন, তিনি পশ্চিমা মানসিকতার এক অনস্বীকার্য প্রতিনিধি। ১৪৩১ সালের ১ জানুয়ারি স্পেনের কিংডম অব ভ্যালেন্সিয়ায় (এরাগন রাজ্যের হাতিভাতে) তার জন্ম হয়। বালক বয়সে তার ডাকনাম ছিল রডরিগো বুর্জিয়া। স্পেনের মুসলিম সভ্যতার উচ্ছেদে কিংডম অব ভ্যালেন্সিয়া লড়াই করছিল যুগ যুগ ধরে। বালক রডরিগো শুনেছেন সেই লড়াইয়ের কাড়া-নাকাড়ার আওয়াজ। তার দাদা রডরিগো গিল ডে বুর্জিয়া (জন্ম ও মৃত্যুসন অজ্ঞাত) ছিলেন ক্রুসেডের প্রচারক। চাচা লুইস জোয়ান অব মিলা (১৪৩২-১৫১০) ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের কার্ডিনাল এবং পিতা জফ্রি লিয়াঙ্কল ই ইস্ক্রিভা (১৩৯০-১৪৩৭) ছিলেন ভেলেন্সিয়ার প্রভাবশালী নেতা। তার মা ইসাবেলা ডে বুর্জিয়া ই কাভানিলেস (মৃত্যু-১৯ অক্টোবর, ১৪৬৪) ছিলেন বিখ্যাত বুর্জিয়া পরিবারের কন্যা। যে পরিবার শত শত যোদ্ধা, পাদ্রী, রাজনৈতিক নেতা ও শিক উপহার দিয়েছে খ্রিষ্ট বিশ্বকে। ফলত অবধারিতভাবে তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। নানা জুয়ান ডোমিঙ্গো ডে বুর্জিয়া ছিলেন। ১ বুর্জিয়া ওরফে ক্যালিকস্টাস-৩ (১৩৭৮-১৪৫৮) ছিলেন ক্যাথলিক পোপ। বিশপ অব রোম।

ইউরোপের রাজনীতি তখন মুসলিম ভীতির জ্বরাক্রান্ত। কয়েক শতকের ধারাবাহিক ক্রুসেড পরাজয়ে পরিণত হয়েছে। ওসমানী সালতানাতের বিজয় অভিযানে জার্মানি, ইতালি ও বলকান অঞ্চল কম্পমান। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ (১৪৩২-১৪৮১) এর কনস্টান্টিনোপল জয় ছিল প্রবল এক আঘাত। এরপর ১৪৫৯ সালে সার্বিয়া দখল করে নেয় ওসমানীরা। ১৪৭০ সালে আলবেনিয়া চলে যায় তুর্কি অধিকারে। ১৪৮০ সালে ওসমানী বিজয় অভিযান প্রবেশ করে ইতালিতে। অধিকার করে নেয় অন্যতম শহর ওটরান্টো। ১৪৮১ সালে মুহাম্মদ ফাতেহ এর ইন্তেকালের পর মুসলিমরা ইতালি ত্যাগ করলেও ইউরোপীয়রা প্রবলভাবে ছিল আতঙ্কিত। কখন আবার এগিয়ে আসে তুর্কি বাহিনী! আত্মরার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না রাষ্ট্রগুলো। ইতালির পোপ দ্বিতীয় পিয়াস (১৪০৫-১৪৬৪) হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমি তো কোথাও আর আশার কোনো আলোই দেখতে পাচ্ছি না! তখন ক্যাস্টাইল-ভ্যালেন্সিয়ায় ইউরোপের আশার আলো প্রজ্ব¡লনের কাজ চলছে। ইতিহাস নিচ্ছে নতুন মোড়। আলেকজান্ডারের দাদা ও নানার পরিবার ছিল এর কেন্দ্রে।

‘মুসলিম শত্রু’ কথাটা শুনতে শুনতে পেরিয়েছে তার শৈশব, কৈশোর। জন্মদাগের মতো তার মনে গেঁথে যায় মুসলিমবিদ্বেষ। জাতীয় শত্রু হিসেবে মুসলিমবৈরী মানসিকতার ওপর দাঁড়ায় তার খ্রিষ্টীয় চেতনা। যৌবনে যখন তিনি বোলোগানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন, সেখানে জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে মুসলিম প-িতদের বই ছিল পাঠ্য। আবার সেখানে ছিল মুসলিম শত্রুদের বিরুদ্ধে জ্ঞানগত লড়াইয়ের উদ্যম। তাদের জ্ঞান দিয়ে তাদের হারিয়ে দেয়ার প্রত্যয়। রডরিগো এ প্রত্যয়ে নিজের শৈশব-কৈশোরের পরিচিত চেতনার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। আইনবিদ্যায় ডক্টর অব ল উপাধি নিয়ে তিনি সেখানে পাঠ সম্পন্ন করলেন। কিন্তু এর সাথে সাথে পড়া চালিয়ে গেলেন বিশেষত ইসলাম ও ইসলামী দুনিয়া নিয়ে। মুসলিম ইতিহাসের বিজয় ও আধিপত্য তাকে বিস্মিত করত। রডরিগো বিশ্বাস করতেন, দুনিয়াজুড়ে দখলদারি কেবলই খ্রিষ্টানদের অধিকার। অন্যরা অন্যায়ভাবে সেটা ভোগ করছে। এ বিশ্বাস অবশ্য তিনি লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তার মামা বিশপ আলফন্সো ডে বুর্জিয়ার সহায়তায় ১৪৫৬ সালে তিনি হন ভ্যালেন্সিয়ার কার্ডিনাল।

ভ্যালেন্সিয়া তখন মুসলিম ম্যুরদের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে নিরন্তর। চারদিক থেকে আন্দালুসিয়ার পরিসর সীমিত করে এনেছে। আরাগনের রাজা ফার্নান্দো দ্বিতীয় (১৪৫২-১৫১৬) এবং ক্যাস্টাইলের রাণী ইসাবেলা প্রথম (১৪৫১-১৫০৪) বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৪৬৯ সালে। দুই রাজ্য এক হয় মূলত মুসলিম উচ্ছেদের জন্য। মুসলিমদের চূড়ান্ত পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে উঠল। এতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ভূমিকা সর্বাত্মকভাবে পালন করছিলেন আলেকজান্ডার। রাজা ও রাণীর সহযোগিতায় তার উদ্যম ও প্রচেষ্টা ছিল প্রভাববিস্তারী। তাদেরই হাতে ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি স্পেনে চূড়ান্ত অবসান ঘটে ৭৮১ বছরের মুসলিম শাসনের।


এরপর আলেকজান্ডারের পরিসর হয় আরো প্রসারিত। ১৪৯২ সালের ১১ আগস্ট তিনি নির্বাচিত হলেন খ্রিস্টান দুনিয়ার পোপ। ১৯৯৪ সালে আলেকজান্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাথলিক কিং এবং কুইন উপাধি প্রদান করেন বিজয়ী রাজা-রাণীকে।
স্পেন তখন নৌ-আধিপত্যে প্রতিযোগিতা করছিল পর্তুগালের সাথে। পোপ চাইলেন উভয়ের দ্বন্দ্বের বদলে ঐক্য। দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য দুনিয়াকে করে দিলেন ভাগ-বাটোয়ারা। খ্রিষ্টীয় দুনিয়ার ঐক্যের অভিপ্রায় তিনি ছড়াচ্ছিলেন নানাভাবে। এরই প্রভাব পড়েছিল নানা ক্ষেত্র।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us