যেসব অত্যাচার চালিয়েছিলেন কলম্বাস

মুসা আল হাফিজ | Sep 25, 2020 05:42 pm
কলম্বাস ও তার বাহিনী

কলম্বাস ও তার বাহিনী - ছবি : সংগৃহীত

 

১৫০৯ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার কন্যা কাতেরিনার (১৪৮৫-১৫৩৬) বিয়ে হয় ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির (১৪৯১-১৫৪৭) সাথে। ১৫১২ সালে রাজা ফার্ডিনান্ড নাভার রাজ্য দখল করেন এবং এর মাধ্যমে বিভক্ত স্পেনের একত্রীকরণ সম্পূর্ণ করেন। দুনিয়াজুড়ে দখলদারি বিস্তারে স্পেন এগিয়ে চলল দ্রুতই। অচিরেই গোটা ইউরোপ মেনে নেয় তার শ্রেষ্ঠত্ব। রাজা প্রথম কার্লোস (মেয়াদকাল ১৫১৬-১৫৫৬) ১৫১৯ সালে লাভ করবেন পবিত্র রোমান সম্রাটের উপাধি। এর ফলে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, ফ্রান্সের বিশাল অংশ এবং ইতালির একাংশ নিয়ন্ত্রণের মতা আসে তার হাতে। আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশ যখন প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত, তখন ১৫২১ সালের ১৭ মার্চ ফার্নান্দো ম্যাগেলান (১৪৮০-১৫২১) উপনীত হন ফিলিপাইনে। দাবি করেন স্পেনের মালিকানা, নিহত হন স্থানীয়দের আক্রমণে। আবিষ্কৃত হয় এশিয়ায় স্পেনিশদের নতুন নৌ-পথ। ১৫১৯-১৫২১ সালে হারনান্দো কারতেজ (১৪৮৫-১৫৪৭) আক্রমণ করেন আজটেকদের মেক্সিকো। কায়েম করেন স্পেনিশ দখলদারি। ১৫৩৩ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারো (১৪৭৮-১৫৪১) ইনকাদের আক্রমণ করে দাস বানান। দখল করেন পেরু। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে মধ্য ও দণি আমেরিকা মহাদেশের কর্তৃত্ব চলে আসে স্পেনের হাতে। বলিভিয়া, মেক্সিকো ইত্যাদি দখল করে স্পেনিশরা বুঝতে পারে, তাদের পায়ের নিচে রুপার খনি। ১৫৬৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মেক্সিকো থেকে মিগুয়েল ল্যাপেজ ডি লেগাজপির (১৫০২-১৫৭২) অভিযানে ফিলিপাইনে প্রতিষ্ঠিত হয় স্পেনিশ উপনিবেশ।

পর্তুগাল তার নির্ধারিত এলাকা অতিক্রম করে ল্যাতিন আমেরিকায়ও দখলদারি বিস্তার করে। ১৫০০ সালের ৯ মার্চ পেড্রো কাবরল (মৃত্যু-১৫২০) ১৩টি জাহাজ নিয়ে পৌঁছে যান ব্রাজিলে। কায়েম করেন উপনিবেশ। ১৮২২ সাল অবধি ব্রাজিল ছিল পর্তুগীজ দখলে। ভারতে পর্তুগীজরা পৌঁছে ১৪৯৮ সালের মে মাসে। গোয়ায় প্রতিষ্ঠা করে মিশনারি আস্তানা। অচিরেই তারা নিজেদের কুঠি গড়ে নেয় সিংহল, সুমাত্রা, জাভা ও মশলার দ্বীপে। ১৪১৭ সালে তারা উপনীত হয় চীনের ক্যান্টন বন্দরে। ১৪৪২-এ অভিযান চালায় জাপানে। আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল এবং দেশটি পর্তুগীজ পশ্চিম আফ্রিকা নামেও পরিচিত ছিল। মোজাম্বিকে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে পর্তুগীজ শাসন। দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭৫ সালে। দুনিয়াজুড়ে স্পেন-পর্তুগালের এই দখলদারির মূলে ছিল বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক নানা কারণ। কিন্তু প্রধান কারণ ছিল ধর্মীয়। তাদের কাছে দখলদারি ছিল পবিত্র। এ ক্ষেত্রে যা যা করণীয়, সেগুলোও ছিল পবিত্র। কারণ তাদের অভিযানসমূহ মূলত অপবিত্র জাতিদের খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস দ্বারা পবিত্র করার জন্য। অসভ্যদের সভ্য বানানোর জন্য। এ ছিল এক মহান ক্রুসেড।

এ কাজে তারা কত বেশি হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক ছিলো তার নজির আমরা দেখতে পাই তাদের উপনিবেশ কায়েমের পরের পরিস্থিতিতে। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর কলম্বাস পৌঁছান বাহামা দ্বীপপুঞ্জে। সেখানে স্থানীয়দের দেখেই তার মনে হয় এদের সহজেই দাস বানানো এবং খ্রিষ্টধর্মে দীতি করা যাবে। ভূমি দেখে মনে হয়, এখান থেকে প্রচুর সোনা নেয়া যাবে। তিনি সে কাজই শুরু করেছিলেন। এরপর ১৪৯৩ এবং ১৪৯৮ সালে আমেরিকা মহাদেশে নৌযাত্রা করেন কলম্বাস। সেখানকার মানুষের জন্য তিনি নিয়ে যান গণহত্যা ও গণমৃত্যু। স্পেনের দরকার প্রচুর সোনা। হিস্পানিওলা দ্বীপের একটি প্রদেশে ১৪ বছরের বেশি বয়সী সব আদিবাসীকে তিন মাস পরপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ জমা দেয়ার আদেশ দিলেন কলম্বাস। এই নির্দেশ মানতে যারাই ব্যর্থ হত তাদেরই দুই হাত কেটে ফেলা হতো। অতিরিক্ত রক্তরণেই মারা যেত তারা। অনেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। তাদেরকে ধরে এনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। কেউই বাঁচতে পারত না। হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করা হতো প্রত্যেক পলাতককে। হিস্পানিওলা দ্বীপে বসবাসকারীরা ছিল আরাওয়াক গোত্রের। কলম্বাস বাহিনীর নির্মমতা সইতে না পেরে ৫০ হাজার আদিবাসী বিষ খেয়ে গণ-আত্মহত্যা করেছিলেন। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতেন যাতে ইউরোপীয়রা ওই বাচ্চাদের কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এরপরও যারা বেঁচে ছিলেন তাদের দাসে পরিণত করেন কলম্বাস।

এ কেবল হিস্পানিওলার বাসিন্দাদের নিয়তি ছিল না। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের প্রধান অংশটির ভাগ্যে এমনই ঘটেছে। তাদের হত্যা করা হতো যে কোনো কারণে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই। কলম্বাসের সমকালীন পাদ্রী বার্তোলোমি ডে লা কাসা (১৪৮৪-১৫৬৬) তার History of the Indies গ্রন্থে লিখেন, স্পেনিশরা তরবারি বা চাকুর ধার পরীক্ষা করার জন্য আদিবাসী শিশুদের গলা কেটে ফেলতো। হিসপানিওলা দ্বীপে স্পেনিশ উপনিবেশ কায়েমের সময় লোকসংখ্যা ছিল আড়াই লাখ। সেখানে ১৫৩৮ সালে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ৫০০ জন। মেক্সিকোয় স্পেনিশ উপনিবেশের ১০০ বছরে জনসংখ্যা বিশ শতাংশ কমে যায়। তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল নির্বিচার গণহত্যা এবং স্পেনিশদের বহন করা এবং ছড়িয়ে দেয়া রোগে। দাসব্যবসার রমরমা শুরু হয় তাদের হাতে। অন্যান্য উপনিবেশের কথা বাদ দিলেও স্পেনিশরা কেবল আমেরিকায় অষ্টাদশ শতকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫ থেকে ৯০ হাজার দাস ধরে আনত আফ্রিকা থেকে।

এই হতভাগা দাসদের বেশির ভাগই ছিল মুসলমান। মার্কিন কোস্টগার্ড আলেকজান্ডার মারে পামার ওরফে অ্যালেক্স হেলির (১৯২১-১৯৯২) আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রুট্স : দ্য সাগা অব অ্যান অ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ (১৯৭৬) এ বিষয়ে দুনিয়ার নজর খুলে দেয়। বইটিতে রয়েছে আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে আনার কিছু ঘটনার প্রামাণ্য বর্ণনা। দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণার পর তিনি জানতে পারেন আমেরিকায় তার প্রথম পূর্বপুরুষের নাম কুন্তা কিন্তে। গাম্বিয়া থেকে কুন্তা কিন্তেকে ধরে নিয়ে আসে ইউরোপীয়রা। স্বজনেরা তাকে খুঁজে পায়নি কখনো। বিভিন্ন পণ্যের সাথে পশুর খাঁচায় ভরে ১৪০ জন শিকার করা মানুষকে জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়। রাস্তায় নির্মমতায় মারা যায় ৪২ জন ভাগ্যহত। বেঁচে থাকেন ৯৮ জন। আমেরিকার আ্যনাপোলিসের বাজারে তাদেরকে বিক্রি করা হয়। কুন্তাকে কিনে নেন জনৈক জন ওয়ালার। নামপরিচয়হীন ঝরাপাতার মতো ঝরে গেছে কুন্তা-কিন্তেদের জীবন। আ্যালেক্স হেলির গবেষণা থেকে দুনিয়া জানল, সংখ্যাহীন, সন্ধানহীন এমন কুন্তা কিন্তেরা ছিলেন মুসলমান।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us