মাতা-পিতার মৃত্যুর পর সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তৃব্য
মাতা-পিতার মৃত্যুর পর সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তৃব্য - ছবি : সংগৃহীত
আমাদের জীবনে আল্লাহর পরেই মাতা-পিতার স্থান। এত বেশি তারা মর্যাদাবান যে, আজীবন তাদের খেদমতে নিয়োজিত থাকলেও এর গুরুত্ব আর উত্তম প্রতিদান কমবে না। জীবদ্দশাতেই নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে তাদের খেদমত করে যেতে হবে, পরিপূর্ণ অনুগত থেকে। আর তাদের মৃত্যুর পরেও আমাদের ওপরই সব দায়িত্ব কর্তব্য অর্পিত হয়। যেকোনো মানুষের জন্যই সন্তানের করে যাওয়া আমল পিতা-মাতার আমলের খাতায় যোগ হতে থাকে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সন্তানের নেক আমল পিতা-মাতার দোজখের আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারে। এত এত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব সন্তান কখনো ফেলে রাখতে পারে না, যদি সত্যিকার ভালোবাসা তাদের জন্য থাকে। ভালোবাসা অবশ্যই কাজে প্রকাশ পায়, মুখের কথায় না। আমাদের উচিত মাতা-পিতার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া।
আল্লাহ্ বলেছেন : ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।’(সূরা আনকাবুত : ০৮) এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও আল্লাহর পরেই মাতা-পিতার স্থান তবুও তাদের কথায় শিরক করা যাবে না। বরং সুন্দর ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে ইসলামের পথে আনতে হবে এবং উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের মৃত্যুর পরেও তাদের জন্য সর্বদা কল্যাণ কামনা করতে হবে।
মাতা-পিতার মৃত্যুর পর করণীয় : মহান রব আমাদের নির্দেশ দেয়ার পর আমাদের দায়িত্ব হয়ে যায় মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। যা করতে হবে মৃত্যুর পরেও। আমরা যারা এই সুন্দর পৃথিবীতে মাতা-পিতাকে হারিয়েছি বা তাদের আদর থেকে বঞ্চিত, তাদের কাছে নিশ্চয়ই এই পৃথিবীর রঙ রূপ বেমানান মনে হয়। পৃথিবীর সৌন্দর্যকে উপভোগ করার মতো সেই চোখ আর থাকে না। এমন একটি স্বাধীন মন থাকে না যার ডানায় ভর করে কল্পরাজ্যে যাওয়া যায়। তবুও আমরা আশায় বুক বাঁধি হয়তো পরবর্তী জীবনের সৌন্দর্য তাদের সাথেই উপভোগ করতে পারব। আর এই আশাকে সক্রিয় রাখতে এবং বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের সেই জান্নাতের সন্ধানে ছুটতে হবে। গড়তে হবে জান্নাতে বাগান। সেই বাগানেই হয়তো মাতা-পিতার সাক্ষাৎ মিলবে। আমাদের সাথে সাথে মাতাপিতার মৃত্যুর পরেও তাই তাদের জন্য দোয়া করে যেতে হবে। তাদের প্রতি মৃত্যুর পরে আমাদের যে কর্তব্য তা একটা হাদিস দিয়ে বুঝতে পারি।
আবু উসাইদ রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূল সা:-এর কাছে বসেছিলাম। এমতাবস্থায় বনু সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি রাসূল সা:-এর কাছে এলো। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল সা: মা-বাপের ইন্তিকালের পরও কি তাদের কোনো হক বাকি থাকে, যা আমার প্রদান করা উচিত? রাসূল সা: বললেন, হ্যাঁ, তাদের জন্য দোয়া করবে, ক্ষমা চাইবে, তারা যদি কোনো ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে, তবে তা পূরণ করবে। যাদের সাথে মা বাপের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল, তাদের আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখবে এবং মা বাপের বন্ধুবান্ধবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।’ (আবু-দাউদ)
দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা : মৃত মা-বাবার জন্য সন্তান সর্বদা দোয়া করবে। তাই আল্লাহ্ বলেন; ‘অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থাক এবং বলো : হে আমার রব্ব! তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন পালন করেছিলেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)
পাখি যখন তার বাচ্চাদের নিজ করুণার ছায়ায় রাখতে চায়, তখন তাদের জন্য নিজের ডানাকে নত করে দেয়। অর্থাৎ, তুমিও পিতা-মাতার সাথে ওইরূপ উত্তম এবং করুণাসিক্ত আচরণ কর। আর তাদের ওইরূপ সেবাযত্ন কর, যেরূপ তাঁরা তোমার সেবাযত্ন করেছিলেন; যখন তুমি শিশু ছিলে। অথবা এর অর্থ হলো, পাখি যখন ওড়ার এবং ঊর্ধ্বে যাওয়ার ইচ্ছা করে, তখন তার ডানা দুটিকে প্রসারিত করে দেয়। আর যখন নিচে অবতরণ করার ইচ্ছা করে, তখন ডানা দুটি গুটিয়ে নেয়। এই দিক দিয়ে বাজু বিছিয়ে দেয়ার অর্থ হবে, পিতা-মাতার সামনে নম্র ও বিনয়ী হয়ে যাও। সুতরাং, তাদের মৃত্যুর পরেও তাদের প্রতি সদাচরণ করত হবে। তাদের জন্য কল্যাণ কামনা করতে হবে। তাদের জন্য বেশি বেশি ক্ষমা চাইতে হবে।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা নেক বান্দার মর্তবা জান্নাতে বুলন্দ করবেন, সে বলবে : হে আমার রব এটা আমার জন্য কিভাবে হলো? তিনি বলবেন : তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তেগফারের কারণে।’ (সহিহ হাদিসে কুদসি, হাদিস নং ১২১)
দান ও সদকা : জীবিত ব্যক্তির দান-সদকা মৃত ব্যক্তিকে উপকৃত করে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সা:-কে বলেন, ‘আমার বাবা মারা গেছেন। তিনি সম্পদ রেখে গেছেন, তবে কোনো অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার জন্য সদকা করি, তবে কি তার পাপ মার্জনা হবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪০০১) অর্থাৎ মাতা-পিতার জন্য সন্তান যেকোনো নেক আমল করবে তা তাদের সওয়াবের পাল্লা ভারী হবে।
ইবনু আব্বাস রা: হতে মহান আল্লাহর এ বাণী সম্পর্কে বর্ণিত : ‘যাদের সাথে তোমরা ওয়াদাবদ্ধ তাদের প্রাপ্য তাদের প্রদান করো।’ (সূরাহ আন-নিসা : ৩৩) তিনি বলেন, মুহাজিরগণ হিজরত করে মদিনায় আসার পর, আত্মীয়তার বন্ধন ছাড়াই রাসূলুল্লাহ সা: কর্তৃক তাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত ভ্রাতৃবন্ধনের ভিত্তিতে আনসারদের মীরাস পান। যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় : ‘পিতা-মাতা ও আত্মীয়রা যে সম্পদ রেখে যাবে, আমরা এর প্রত্যেকটির হকদার নির্দিষ্ট করে দিয়েছি...। (সূরাহ আন-নিসা : ৩৩) তিনি বলেন, ‘যাদের সাথে তোমরা ওয়াদাবদ্ধ তাদের প্রাপ্য তাদেরকে প্রদান করো’ উপরের আয়াত দ্বারা রহিত। কিন্তু সাহায্য, উপদেশ, ওসিয়ত ইত্যাদি করার নির্দেশ বহাল আছে, কিন্তু ওয়ারিস হওয়ার প্রথা বাতিল। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২৯২২)
কুরআন তিলাওয়াত করা : সন্তান মৃত মা-বাবার উদ্দেশে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে। এতে তারা সওয়াব পাবেন। তবে অন্যের মাধ্যমে কুরআন পাঠ করানো এবং তার বিনিময় দেয়া উচিত নয়; বরং নিজেই কুরআন তিলাওয়াত করবে এবং মা-বাবার রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবে। আমাদের তেলাওয়াত করার ফজিলত তাদের আমলনামায় যোগ হবে। তাই তাদের মুক্তি চেয়ে আমরা মৃত্যুর দিনকে সামনে রেখেও বেশি বেশি কুরআন পাঠ করতে পারি। যাতে দোজখের আগুন নিভানো হয়।
কবর জিয়ারত করা : রাসূলুল্লাহ সা: নিয়মিত মদিনার ‘বাকি’ কবরস্থান জিয়ারত করতেন। মৃত আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ও সাহাবিদের জন্য দোয়া করতেন। চলার পথে কোনো কবর বা কবরস্থান পড়লেও মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, ‘নবী সা: মদিনার একটি কবরস্থান অতিক্রম করার সময় তার দিকে ফিরে বলেন, ‘হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মাফ করে দিন। তোমরা আমাদের অগ্রগামী, আমরা তোমাদের পদাঙ্ক অনুসারী।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৫৩)
মৃত ব্যক্তির জন্য হজ করার কথাও রয়েছে। আল্লামা ইবনে কাইয়্যিম রহ: বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে উপকারী হলো, দাসমুক্তি। তার জন্য রোজা রাখার চেয়ে তার জন্য দান করা উত্তম। যে দানের মাধ্যমে গ্রহীতার প্রয়োজন পূর্ণ হয় এবং যার উপকারের ধারা অব্যাহত থাকে তা উত্তম।
আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে মাতা-পিতার মৃত্যুর পরেও তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া। তাদের ওসিয়ত থাকলে তা পূরণ করা। তাদের ঋণ শোধ করা এবং আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেয়া। সবচেয়ে পাল্লায় ভারী হয় উত্তম সন্তানের উত্তম সব কাজ। তাদের জন্য দোয়া করা এবং তাদের জন্য কুরআন পড়াও উত্তম। এভাবে আমরা যদি আমাদের মাতা-পিতার সাথে একসাথে জান্নাতে থাকতে চাই অবশ্যই নিজেদের সেভাবে গঠন করব। আর নিজেদের আমলনামায় বেশি বেশি ভালো কাজ রাখব। যা মূলত মাতা-পিতার আমলনামায় যোগ হবে। আল্লাহ যেন আমাদের সহায় হোন।
লেখিকা : ইসলামী গবেষক