যে সমীকরণে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন আনোয়ার ইব্রাহিম
আনোয়ার ইব্রাহিম - ছবি সংগৃহীত
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতা ও ভেতর থেকে পরিবর্তনের একটি আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আগে থেকেই। সেই ঝড় একবারে ঘনীভূত হলো আনোয়ারের সরকার গঠনের মতো পর্যাপ্ত সংসদ সদস্যের সমর্থন নিশ্চিত হবার দাবির পর। নতুন সরকার গঠনের জন্য তার প্রতি দেওয়ান রাকিয়তের (সংসদ) বেশিরভাগ সদস্যের সমর্থন রয়েছে বলে দাবি করে আনোয়ার ঘোষণা করেছেন যে, শিগগিরই তিনি ইয়াং ডি-পার্টুয়ান আগোংয়ের (রাজা) কাছে সাক্ষাৎকার চাইবেন। আনোয়ার ভুমিপূতরা এবং মালে-মুসলিম নেতৃত্বাধীন সরকারে নেতৃত্ব দেবেন বলে জোর দিয়েও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করবেন মর্মে উল্লেখ করেন। আনোয়ার আরো যোগ করেছেন, যাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পাকাতান হারাপান সরকারের পতন ঘটেছে তারা এখন সরকার গঠনে যারা তাকে সমর্থন করছেন তাদের মধ্যে নেই।
আনোয়ারের এই ঘোষণার পর উমনু ও বারিসান জোট প্রধান আহমদ জাহিদ হামিদি বলেছেন, আনোয়ারের সরকার গঠনের ব্যাপারে অনেক উমনো ও বিএন এমপির সমর্থন রয়েছে। তিনি এও বলেছেন যে, অনেক সংসদ সদস্য আনোয়ারকে নতুন সরকার গঠনের জন্য তাদের মধ্য থেকে সমর্থন জানিয়েছেন। এটি যারা করেছেন তাদের অবস্থানকে তিনি সম্মান করছেন। জাহিদ জোর দিয়ে বলেন যে উমনো ও বিএন আনুষ্ঠানিকভাবে পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) জোটের অংশ নয়।
আনোয়ার তার বক্তব্যে সঠিক সংখ্যা এবং সংসদ সদস্যদের নাম উল্লেখ না করেই বলেন, তারা বেশিরভাগই মালয়-মুসলিম এবং ইয়াং ডি-পার্টুয়ান আগোংয়ের সাথে তাদের প্রথম সাক্ষাত করে মত বক্তব্য দান করতে চান।আমানাহ এবং ডিএপি আনোয়ারের পক্ষে আগেই সমর্থন ঘোষণা করেছে, তবে সারওয়াকের গাবুনগান পারটি সারাওয়াক বা জিপিএস বলেছে যে তারা দৃঢ়ভাবে মুহিউদ্দিনের পিছনে রয়েছে।
ইয়াং ডি-পার্টুয়ান আগোং বর্তমানে জাতীয় হার্ট ইনস্টিটিউটে হাসপাতালে ভর্তি আছেন, যেখানে তিনি একটি অনির্ধারিত অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ কারণে আনোয়ারের সাক্ষাত প্রার্থনার আবেদনে তিনি সম্মতি দিয়েও তা স্থগিত রেখেছেন বলে রাজপ্রাসাদ থেকে বলা হয়েছে।
পিকেআর প্রেসিডেন্ট দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার দাবি করার পর আইনি পথে সরকার গঠন এবং দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা তা নিয়ে এখনও কিছুটা প্রশ্ন রয়ে গেছে। আনোয়ারের সরকার গঠনের দাবি করার পর মঙ্গলবার ইস্তানা নেগারা (রাজপ্রাসাদ) নিশ্চিত করেছেন যে ইয়াং ডি-পার্টুয়ান আগোং আল-সুলতান আবদুল্লাহ রি’আয়াতুদ্দীন আল-মুস্তফা বিল্লাহ শাহ সোমবার জাতীয় হার্ট ইনস্টিটিউটে (আইজেএন) ভর্তি হয়েছেন।
মালয়েশিয়ার সাংবিধানিক আইন কমিটির সহ-সভাপতি অ্যান্ড্রু খু বলেছেন, রাজা তাকে সাক্ষাতকার দেওয়ার আগ পর্যন্ত আনোয়ারকে অপেক্ষা করতে হবে। আর রাজা এমন পরিস্থিতিতে নেই যে ডেপুটি আগোং এই দায়িত্ব নিতে পারবেন। সংবিধানের বিধান অনুসারে রাজা যদি ১৫ দিনের বেশি সময় অসুস্থ থাকেন তখন ডেপুটি কিং এই দায়িত্ব পালন করার অবকাশ পাবেন।
এর মধ্যে, যে কোনও বিলম্বে মুহিউদ্দিনের সমর্থন ফিরে পাবার অবকাশ তৈরি হবে। এর জন্য তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে বোঝাপড়ায় যেতে হবে। অন্য দিকে আনোয়ারকে আশা করতে হবে যে অপেক্ষা করার সময় দীর্ঘায়িত হবার মধ্যে তার সমর্থন পিছলে যাবার একটি আশঙ্কা থেকে যেতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, আনোয়ারের সরকার গঠনের ঘোষণার পর দুটি বিষয় ঘটতে পারে। এক, প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে রাজাকে বলতে পারেন। রাজা সংসদ বিলুপ্তিতে সম্মতি দিতে পারেন। অথবা প্রত্যাখ্যান করে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমর্থন আছে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন। অবশ্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সহযোগিতা করতে চান কিনা অথবা তিনি তার সরকারকে বিলুপ্ত করতে চান কিনা তার উপর এটি নির্ভর করবে।
মোদ্দা কথা হলো, পাকাতানের পতনের জন্য ‘শেরাটন মুভ’ যেভাবে ঘটেছিল আনোয়ার ইব্রাহিম একইভাবে সরকার গঠন করতে পারেন। নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক ‘শেরাটন মুভ ’ আবার ঘটতে পারে এ কারণে যে তাতে আইনী কোনো বাধা নেই। এটি সরকার পরিবর্তনের একটি নজিরে পরিণত হতে পারে। গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, তৎকালীন পিকেআর উপ-প্রধান আজমিন আলী পিএনকে সমর্থন করার জন্য দলটির বাইরে থেকে দশজন সংসদ সদস্য বের করে এনে এ ঘটনায় তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তখন এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হয় এবং পিএইচের শাসনের পতন ঘটে এবং মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বর্তমান জোট ক্ষমতায় বসে।
বিকল্প হিসাবে আবার মালয়েশিয়ানদের সামনে একটি নতুন নির্বাচন দেয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটি হলে ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নেবে। অনেকের মতে, বর্তমান সময়ে সর্বোত্তম হলো একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং জনগণকে সরকার বেছে নেবার সুযোগ দেয়া। যদিও এখন সত্যিকার অর্থেই মালয়েশিয়ায় বর্তমান রাজনৈতিক উন্নয়নে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার সামনে অনিশ্চয়তার অবসান ঘটেনি।
আনোয়ারের এই ঘোষণাকে মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৮ সালের ঘোষণার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আনোয়ারের ক্ষমতায় যাবার পথে বাধা তৈরির গুটি এখনো সাজিয়ে চলেছেন বলে মনে হয় তার এই কথায়। তবে ৯৫ বয়সী এই নেতা তার বিশ্বাসযোগ্যতার অনেকখানি ক্ষতি করেছেন। তিনি ক্ষমতায় আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণে তার হাতে থাকা অনেক গুটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন এর অতি ব্যবহারের কারণে।
আনোয়ারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে উমনোর বেশ কিছু এমপির সমর্থন রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যেটি খোলামেলাভাবে জাহিদ হামিদি উল্লেখ করেছেন। মুহিউদ্দিন ইয়াসিন চেয়েছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী যারা রয়েছেন সবাইকে সাইডলাইনে ফেলে দিতে। মাহাথিরকে তিনি পুত্রসহ দল থেকে বের করে দিয়েছেন। নাজিব রাজ্জাককে দুর্নীতি মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করে রাজনীতি থেকে বিদায়ের ব্যবস্থা করেছেন। জাহিদ হামিদির মামলাও চলমান রয়েছে। যেকোনো সময় দণ্ড হতে পারে। আনোয়ার ইব্রাহিমকে রাজা যে ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলার রুজু করার ব্যবস্থা হয়েছে। ডিএপির প্রধান গুয়াং ও এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা নতুন করে চালু করে দিয়েছেন।
রাজনীতির এত এত ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে কুপোকাত করতে গেলে পায়ের নিচের মাটি যে সরে যাবে সেই হিসাব মুহিউদ্দিন ইয়াসিন কতটা করতে পেরেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। তবে এবার উমনো ও পাস সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেও ভেতরে ভেতরে তাদের শীর্ষ নেতারা মুহিউদ্দিনের বিদায়ের
আয়োজনের সাথে সরবে নীরবে যুক্ত বলে মনে হয়। ফলে বলা যায়, মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি সমাগত।
হয়তোবা আনোয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে মালয় প্রধান অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সংহত করবেন। অথবা সাবাহ রাজ্যের মতো একটি অপরিপক্ক নির্বাচন আসন্ন হবে। কোভিড-১৯-এ বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে এ রাস্তাটি অনভিপ্রেত মনে হতে পারে। তবে মালয়েশিয়ান ডিপ স্টেট যদি আনোয়ারকে কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে না চান তবে সেটি ঘটারই সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও আনোয়ার ঘনিষ্ঠ অনেকের মতে, মালয়েশিয়ার সুলতানরা এখন আনোয়ারের ক্ষমতার পথে সেভাবে বাধা হতে চাইছেন না। এটি স্পষ্ট হবে রাজার সিদ্ধান্তে।