কোন দিকে যাচ্ছে গণফোরাম!
ড. কামাল ও ড . রেজা কিবরিয়া - ছবি : সংগৃহীত
‘গৃহবিবাদ’ থেকে বিভক্তির পথে এগোচ্ছে গণফোরাম। ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে দুই অংশের বিভক্তি থেকে এই গৃহবিবাদের সূত্রপাত। এ নিয়ে বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে।
গত কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান না পাওয়া অংশটি আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর বর্ধিত সভা ডেকেছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে। এই বর্ধিত সভার সাথে রয়েছেন গত কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুর মতো সিনিয়র নেতারা। যদিও এই বর্ধিত সভাকে ‘অগঠনতান্ত্রিক’ বলছেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া। গত মঙ্গলবার সংগঠনের সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়ার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে এই বর্ধিত সভার সাথে গণফোরামের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
ড. রেজা কিবরিয়া এ বিষয়ে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ওরা এরকম বর্ধিত সভা আহ্বান করতে পারেন না। এটি সম্পূর্ণভাবে গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ। গঠনতন্ত্র এটি পারমিট করে না। তবে এটা ঠিক, যে কারো রাজনীতি করার অধিকার আছে। সেটি তারা কোনো দল গঠন করে করতে পারেন। কিন্তু গণফোরামের নাম ব্যবহার করে কোনো সভা করার অধিকার কারো নেই।
তিনি দাবি করেন বলেন, ২৬ সেপ্টেম্বরের ‘কথিত’ ওই সভায় গণফোরামের কোনো জেলা কমিটির নেতারা আসবেন না। আমার সাথে প্রতিটি জেলা কমিটি নেতাদের কথা হয়েছে তারা আমাকে জানিয়েছেন যে, তারা ওই সভায় যাবেন না। ‘গাজীপুর’ ও ‘এ্যালিফেন্ট রোড’ থেকে ‘কিছু লোকজন’ নিয়ে এই সভা হবে বলে তার বিশ্বাস।
ড. রেজা কিবরিয়ার এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী।
তিনি বলেন, উনি (সাধারণ সম্পাদক) নিজেই তো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা করছেন না। গঠনতন্ত্রে আছে ৩০ দিনে সম্পাদক পরিষদ, ৬০ দিনে স্থায়ী কমিটি এবং ৯০ দিনে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করতে হবে। ২০১৯ সালে ৫ মে মাসে ১০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার এক বছরের মধ্যে একটি মিটিংও উনি করেনি। এসব মিটিং আহ্বান করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির ৭০ জন সদস্য লিখিতভাবে চিঠি দিয়েছে। উল্টো তাদের মধ্যে ১৩ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ এবং চারজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এভাবে তো দল চলতে পারে না। এটি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে আলাপ-আলোচনা ছাড়া দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন সুব্রত বলেন, এরকম ‘চরম স্বেচ্ছাচারিতা’র ঘটনাও ঘটেছে।
বর্ধিত সভা আহ্বানকারী অংশের নেতারা জানান, এই অনুষ্ঠানে ‘বির্তকিত’ সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া ব্যতিরেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সারা দেশের জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিনিধিদের আসতে চিঠিও দিয়ে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সুব্রত চৌধুরী বলেন, আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর বর্ধিত সভা হবে। ড. কামাল হোসেনকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তিনি না এলে উপস্থিত নেতাদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মকৌশল ঠিক করা হবে।
আমরা রাজনীতি করতে চাই, রাজনীতির স্বাভাবিক চর্চার অধিকার চাই। গণফোরাম গঠনটাই হয়েছিল এখানে সব কিছু স্বচ্ছতার আলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা হবে সেই নীতিতে। সে জন্য এই দলের সভাপতির একচ্ছত্র ক্ষমতা নেই, যা অন্যান্য দলে আছে।
গত বছরের কাউন্সিলের পরে ঘোষিত কমিটিতে স্থান পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে মূলত বিরোধের সূত্রপাত। মোস্তফা মহসিন মন্টুকে বাদ দিয়ে ড. রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার পর থেকে এই বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহ্বান নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দাঁড়ায় দুই গ্রুপ। দলের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে বিপক্ষ গ্রুপের নেতারা।
একপর্যায়ে ড. রেজা কিবরিয়া বহিষ্কার করেছেন চারজনকে, তারা হলেন কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল হাসিব চৌধুরী, খান সিদ্দিকুর রহমান, হেলাল উদ্দিন ও লতিফুল বারী হামিম।
এই নিয়ে বিপক্ষ গ্রুপও পাল্টা বহিষ্কার করে চারজনকে; তার মধ্যে রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির মহসীন রশিদ, আওম শফিকউল্লাহ ও মোশতাক আহমেদ।
পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের মধ্যে গত ৪ মার্চ গণফোরামের নানা গ্রুপ-বিভক্তির মধ্যে ড. কামাল হোসেন কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিয়ে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করেন। সেই কমিটিতে তিনি নিজেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে ড. রেজা কিবরিয়াকে, যিনি ভেঙে দেয়া কমিটিতেও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সংগঠনের ভেতরে এরকম পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রেজা কিবরিয়া বলেন, ওরা কোনো গঠনতন্ত্র মানতে চায় না। এটি নিয়ে ঝগড়া। এভাবে তো দল বলুন কিংবা সংগঠন বলুন চলতে পারে না। একটা সিস্টেম আছে, একটা কনস্টিটিউশন আছে, একটা ল কিংবা রেগুলেশন আছে, তার ভিত্তিতে তো জেনারেল সেক্রেটারিকে দল পরিচালনা করতে হবে।
তিনি জানান, দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা কমিটি সফর করার কথাও জানিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রাজশাহী, সিলেটসহ বেশ কিছু জেলায় আমি গিয়ে কমিটিগুলোকে সক্রিয় করার কাজ করেছি। আমাদের প্রায় ৩৫টা জেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম সক্রিয় আছে, আরো জেলায় আমরা কাজ করছিলাম। এর মধ্যে কোভিড-১৯ প্রকোপের কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত হয়ে যায়।
প্রতিপক্ষ নেতাদের অভিযোগ, দলের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিয়মিত আসেন না এবং সম্পাদক পরিষদ, স্থায়ী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং ডাকেন না। এটি নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে মূলত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।