অপারেশন অল ক্লিয়ারে ভুটানি সৈন্যদের পোশাকে ভারতের গোপন বাহিনী!

অপারেশন অল ক্লিয়ারে ভুটানি সৈন্যদের পোশাকে ভারতের গোপন বাহিনী! - ছবি : সংগৃহীত
চীনের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর থেকে ভারতের গোপন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের তৎপরতা সম্পর্কে খবরাখবর আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। গোপনীয়তার মোড়কে ঢাকা এই বাহিনী কি কয়েক বছর আগে ভুটান থেকে ভারতের বিচ্ছিন্নবাদী গোষ্ঠীগুলোকে বিতাড়িত করতে অভিযান চালিয়েছিলো? অবস্থাদৃষ্টে এখন সেটাই মনে হচ্ছে।
গত বছর নিষিদ্ধ ঘোষিত ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম (উলফার)-এর এক নেতার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) একটি বিশেষ আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘অপারেশন অল ক্লিয়ার’ অভিযানে স্পেশার ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এসএফএফ) ভুটানের সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিলো। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ওই অভিযান শুরু হয়।
আসামের রাজধানী গৌহাটিতে ঘোষণা করা ওই রায়ে বলা হয়, কিছু দিন আগে পর্যন্ত ভুটানে তাদের শিবির ছিলো, যা এসএফএফের সহায়তায় ভুটান সেনাবাহিনী ২০০৩ সালে ধ্বংস করেছিলো। এসব শিবিরে উলফা সদস্যদের যোদ্ধা ও অযোদ্ধা সদস্যদের পরিবারগুলো বাস করতো। আদালত উলফা নেতা গগন হাজারিকাকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়।
এসএফএফ নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্স অ্যান্ড এনালাইসিস উইং (র)। মূলত তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা লোকজন ও গোর্খাদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত। এই প্যারাট্রুপার বাহিনী পার্বত্য এলাকার যুদ্ধে পারদর্শী। চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর এই বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং এদের প্রথম ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএস ও ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো।
হাজারিকার বিরুদ্ধে এনআইএ’র চার্যশিটের কপি গৌহাটি থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করা হলেও মহামারির কারণে তা পারা যায়নি। তবে সূত্র জানায়, তাতে উলফার উৎপত্তি, ইতিহাস ও বিদেশের মাটিতে তৎপরতা সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
ভুটানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বেশ কয়েকটি জেলায় ২০০৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর একযোগে ‘অপারেশন অল ক্লিয়ার’ শুরু হয়। নিষিদ্ধ গ্রুপ উলফা, ন্যাশনাল ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট অব বোড়োল্যান্ড (এনডিএফবি) ও কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (কেএলও) বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হয়। শেষের সংগঠনটি উত্তরবঙ্গে সক্রিয়। ১৯৮৯ সালের পর থেকে এসব গ্রুপ ভুটানে ছোট বড় ৪০টির মতো শিবির গড়ে তুলেছিলো।
ভুটানে এসএফএফ-এর ভূমিকা গোপন রাখা হয়েছে। যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাত আছে বলে মিডিয়া সন্দেহ করতো। অহমিয়া ভাষায় লেখা উলফা নেতা তুষার প্যাঙ্গিংয়ের বই ‘অপারেশন অল ক্লিয়ার: ভুটান চাপ্টার অব আসাম-ইন্ডিয়া কনফ্লিক্ট’-এ ওই অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্থানীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয় যে ভুটান সীমান্তের কাছে ভারতীয় শহর দারাঙ্গায় সেনাবাহিনীর হ্যালিপ্যাডে ভারতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিন নামানো হয়েছে। এই শহর ভুটানের সামদ্রুপ জংখারের কাছে। সেখানে বিদ্রোহীদের বড় ধরনের শিবির ছিলো। জাতীয় সংবাদপত্রেও এই খবর ছাপা হয়।
ভারতীয় কর্মকর্তারা রায়ে এসএফএফের উল্লেখ সম্পর্কে মুখ খুলতে না চাইলেও অভিযানে ভারতের গোপন বাহিনীর অংশগ্রহণের ব্যাপারে উলফার সাবেক নেতারা নিশ্চিত ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক উলফা নেতা বলেন, তিব্বতিদের নিয়ে গঠিত এসএফএফের বড় একটি দল ওই অপারেশনে জড়িত ছিলো। তারা ভুটানি সেনাদের পোশাক পড়ে এতে অংশ নেয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো সামদ্রুপ ঝংখারে তাদের নিখুঁত গোলাবর্ষণ, যাতে উলফার কেন্দ্রিয় ও সাধারণ সদরদফতর ধ্বংস হয়ে যায়।
ভুটানি বাহিনীর মতো অনভিজ্ঞ সেনাদের দ্বারা এটা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নয়া দিল্লী বার বার চাপ দিলেও থিম্ফু এসব শিবিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী ছিলো না। তাদের আশঙ্কা ছিলো এটা করা হলে ভুটানের নাগরিকরা আসাম ও অন্যান্য এলাকায় গেলে বিপদে পড়তে পারে। তাছাড়া ভুটানি সেনাবাহিনীর সরঞ্জাম ও অভিজ্ঞতার অভাব ছিলো। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা ছিলো অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত।
ভারতের এক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, থিম্ফু শেষ পর্যন্ত রাজি হওয়ার পর অপারেশন শুরুর এক বছর আগেই বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করা হয় এবং ভুটান সেনাবাহিনীতে একটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। এই ব্যাটালিয়নকে প্রশিক্ষণ দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।
সূত্র : দি ডিপ্লোম্যাট/এসএএম