আফগানিস্তান হাতছাড়া হওয়ায় ভারত চিন্তিত!
নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশের আড়ালে অত্যন্ত অন্ধকার দিকও আছে। ওই চিত্র কিন্তু মূলধারার মিডিয়া বা প্রাইমটাইম ডিবেটে দেখা যায় না। অবাক করা তথ্য হলো,কোনো না কোনো সময় ইরাক বা আফগানিস্তানে থাকা মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রায় ৫ লাখ সদস্য পোস্ট ট্রাউমেটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছে।
গত ২০ বছর ধরে তালেবানের বিরুদ্ধে ৪০টি মিত্র নিয়ে লড়াই করার পর এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র তার তিন হাজারের বেশি সৈন্য হারিয়েছে, আহত হয়েছে ২০ হাজার ৬০০। আর ক্ষতির মূল্য ৯৭৫ বিলিয়ন ডলার।
এখন আফগানিস্তান ত্যাগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা দুই দশক ধরে যে আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তাদের সাথে চুক্তি করেই বিদায় নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন নজর দিয়েছে আরব দেশগুলো যাতে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সেদিকে।
আর একইসাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজেকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করাটাও বিস্ময়কর নয়।
পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থা
চেনা রাজনৈতিক ছকের বাইরের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান তালেবান লড়াই করেছিল।আর আজ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান রাশিয়া কিন্তু একই আফগান তালেবানকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। চীনা সমর্থন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল ভিয়েতনাম। আজ যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়ছে ভিয়েতনাম।
এখন নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠছে। চীন, পাকিস্তান, ইরান, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও রাশিয়া নতুন ব্লক গঠন করছে। আর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত ও জাপান গঠন করছে আরেকটি ব্লক।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব এখন তিক্ত হয়ে পড়েছে, তুরস্কের সাথে জোট গড়তে শুরু করেছে পাকিস্তান। একইসাথে চীনের সাথে সমঝোতা গড়তে তালেবানকে রাজি করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তান।এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ের জন্যই ভয়াবহ বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কাশ্মির প্রশ্নের উদ্বেগের কারণে ভারত সবসময় আফগান তালেবানকে কোণঠাসা করে রাখতে চেয়েছে। ভারত ও চীন তাদের হিমালয় সীমান্তেও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কল্পনা করেছে যে তারা যখন আফগানিস্তান ত্যাগ করবে, তখন দেশটি ২০ বছর আগের চেয়ে বিধ্বস্ত হবে। কারণ আফগানদের মধ্যে কলহ একটি সাধারণ ব্যাপার। এতে করে আশরাফ গানির ‘সংরক্ষিত’ মার্কিন সরকার কাবুলের দ্বারপ্রান্তে থাকা আফগান তালেবানকে বিরত রাখতে পারবে।
আফগান তালেবানের সাথে চীনের লিয়াজোঁ
যুক্তরাষ্ট্র যখন তল্পিতল্পা গোছাচ্ছে, তখন ৮ সেপ্টেম্বর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন এখন আফগানিস্তানে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে আসছে। আর এর মানে হলো, বেইজিং আশা করছে যে তারা আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তারা মনে করছে, বিনিয়োগের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পর অস্থিতিশীলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানকে চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের পর তারা যদি আফগানিস্তানে শান্তি নিশ্চিত করে, তবে তাদের জন্য একটি সড়ক নেটওয়ার্ক নির্মাণ করে দেবে।
একই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত তিন মাস ধরে বেইজিংয়ে যে আলোচনা চলেছে, তাতে দেশটিতে জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে বেশ ভালো বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে চীনা সুরক্ষা
চীনারা আফগানিস্তান নিয়ে ভাবছে এবং ভবিষ্যতের জন্য পথ পরিষ্কার করে রাখছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের ওই প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেমস ডোরসে এ তথ্য জানান। বেলুচিস্তানে দ্বিতীয় উপজাতীয় নেতা পত্রিকাটিকে বলেন, আফগানিস্তানের প্রধান প্রধান নগরীকে সংযোগ করে একটি মোটরওয়ে নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্র এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে চীনের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) ধ্বংস করতে চায়।
কেন? চীন ও ইরান (যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দের দেশ) সম্প্রতি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও বাণিজ্য চুক্তি করেছে। আর এটাও অবাক করা ব্যাপার নয় যে ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান ও চীন আগের চেয়ে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
সিপিইসির সমাপ্ত স্থান হচ্ছে বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর। মালাক্কা প্রণালীতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে চীনকে উত্যক্ত করতে পারে ওই স্থান এড়াতে আশঙ্কায় চীন তার কাশগড় থেকে বেলুচিস্তান পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করতে শুরু করেছে।
চীন চায় গোয়াদর বন্দরকে ইরানের চাবাহার বন্দরের সাথে যুক্ত করতে।এই চাবাহার বন্দর থেকেই ভারতকে সম্প্রতি বিদায় করে দেয়া হয়েছে। গোয়াদর বন্দরের ওপর ইসরাইল নজর রাখছে। ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপে একটি গোয়েন্দা ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। এখান থেকে গোয়াদর দেখা যায়।
চীন ও আফগান তালেবানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আস্থা
চীন এখন আফগানিস্তানে তার ভবিষ্যত বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করছে। পাকিস্তান এ কাজে চীনকে সহায়তা করছে। আর আফগান তালেবানের সাথে চুক্তি করে বিদায় নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আবার পাকিস্তানকেও পরিত্যাগ করে ভারতকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে।
এদিকে কিছু কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্কও উষ্ণ হচ্ছে।
এর পর কী?
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীন তার মুসলিম উইঘুরদের ওপর নির্যাতন চালালেও তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান ও এমনকি মালয়েশিয়ার মতো মুসলিম দেশগুলো পর্যন্ত চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করছে। দেশটি এ নিয়ে হৈচৈ করছে। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মতো দেশে লাখ লাখ মুসলিমকে হত্যা করেছে।
ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।তবে আফগান তালেবানকে সাথে নিয়ে চীন আশ্বাস পাচ্ছে যে সিপিইসি বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) কাছ থেকে নিরাপদ থাকবে।
সূত্র : দি কুইন্ট