রাখাইনে অস্থিরতা : নেপথ্যে ভূ-রাজনীতির সমীকরণ
রাখাইনে অস্থিরতা : নেপথ্যে ভূ-রাজনীতির সমীকরণ - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সীমান্ত ঘেঁষে অস্থিরতা ক্রমেই ঘনিয়ে উঠছে। মিয়ানমার রাখাইন স্টেটে নজিরবিহীন সমরসজ্জা করছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের জন্য বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। আরাকান আর্মির সাথে সেনাবাহিনীর সঙ্ঘাতও উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাক্ষয় এখন রাখাইন স্টেটে নিত্যকার ঘটনা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে গণহত্যার যে অভিযোগ আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রয়েছে তা নিয়ে চাপে রয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী ও সু চির সরকার। সামনের নভেম্বরে রয়েছে জাতীয় নির্বাচন।
সব মিলিয়ে অস্থির মিয়ানমার। এর প্রভাবে পুরো অঞ্চলে অস্তিরতা ছড়িয়ে পড়ার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অস্থিরতার এই চাপকে কাজে লাগিয়ে ভারত এখন রাখাইনে চীনের বিপরীতে একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে চাইছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণ।
কেন সমরসজ্জা?
হঠাৎ করে রাখাইন স্টেটে মিয়ানমার কৌশলগত সমরাস্ত্র ও সেনা সমাবেশ কেন ঘটাচ্ছে? দেশটির বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও গণমাধ্যমের খবর অনুসারে উত্তর কোরিয়া থেকে সংগৃহীত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, চীন থেকে পাওয়া জেএফ ১৭ থান্ডার বিমান, ভারত থেকে পাওয়া সাবমেরিন এবং রাশিয়া থেকে সু ৩০ ও মিগ ২৯-এর মতো বিমান রাখাইনের সেনা, নৌ ও বিমানঘাঁটিতে নিয়ে আসা হয়েছে।
সাধারণভাবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাখাইনে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা আরাকান আর্মি ও আরসার তৎপরতা দমনে এসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছে। তবে বাস্তবে এই সমরসজ্জার বাইরে আরো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
সে উদ্দেশ্যের একটি হতে পারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ যাতে বিশেষ কোনো সক্রিয় ভূমিকা না রাখে তার জন্য সামরিক চাপ সৃষ্টি করা।
রাখাইনে আরাকান আর্মির বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পক্ষে রাজ্যের নাগরিকদের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তাদের আন্দোলনে ভ্যাটিকানের সমর্থন রয়েছে বলেও মনে করা হয়। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার এবং তাদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়নের মতো ঘটনা রাখাইনবাসীর ওপর সেভাবে ঘটানো সম্ভব না হলেও তাদের ওপরও নিপীড়ন চলছে। জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে চলতি মাসে রাখাইন গ্রামগুলোতে পুরনো স্টাইলে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে রাখাইনে স্বাধীনতা আন্দোলন একটি বড় অবয়ব নিতে পারে। আর তা প্রতিরোধের জন্য এই রাজ্যে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, জাতিগত নিপীড়নের মাধ্যমে দফায় দফায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার বিষয়টি বিশ্ব আদালত ও জাতিসঙ্ঘে যেভাবে আলোচিত হচ্ছে তাতে একপর্যায়ে গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে পারে। আর গণহত্যা কোনো জাতির ওপর চালানো হলে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনও একধরনের আন্তর্জাতিক বৈধতা পেয়ে যায়। এ কারণে মিয়ানমারের বাইরে থাকা রোহিঙ্গারাও মিয়ানমারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাক ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে আরাকানের রাখাইন রোহিঙ্গা নির্বিশেষে সব মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে বর্মী আক্রমণ প্রতিহত করত। এখন রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে এমন একটি পৃথক নিরাপদ অঞ্চল গঠনের দাবি জোরালো হচ্ছে যেখানে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর পাহারা নিশ্চিত করা হবে। এর পাশাপাশি রাখাইনদের পৃথক রাষ্ট্র দাবি একই ধারায় চলতে থাকলে রাখাইন রাজ্যকে মিয়ানমারের সাথে যুক্ত রাখা হয়ে উঠতে পারে কঠিন। সর্বশেষ যে সেনা সমাবেশের খবর পাওয়া যাচ্ছে, এ ধরনের সেনা সমাবেশের সময়ই রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়। একই ধরনের গণহত্যা, রাখাইনদের ওপর চললে মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
রাখাইনে প্রলুব্ধতা
রাখাইন খনিজসম্পদের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ হিসেবে পরিচিত। অথচ সেই তুলনায় জনসংখ্যা একেবারে কম। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত রাখাইন রাজ্যেরও জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ জনসংখ্যা রয়েছে। এখন এর বেশির ভাগ মানুষ জাতিগত রাখাইন বৌদ্ধ (প্রায় ৬০ শতাংশ)। রোহিঙ্গা মুসলমান (৪০ শতাংশের কমবেশি) এবং চিন, ম্রো, খামি, দাইনেট, মারামায়গি এবং কামানসহ বেশ কয়েকটি ছোট সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী এখানে রয়েছে।
এখনকার উত্তেজনা
গত এক দশক ধরে রাখাইনে জাতিগত, সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য ধারায় উত্তেজনা চলে এসেছে। সর্বশেষ সামরিক নেতৃত্বাধীন অভিযানে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার বেশির ভাগ দেশ থেকে পালিয়ে চলে গেছে। এর পরও সঙ্ঘাত চলমান রয়েছে। নিয়মিত সংঘর্ষ, ভারী ফায়ারপাওয়ার মোতায়েন করা এবং হতাহতের পরিমাণ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বটি ২০১৯ এর প্রথম দিক থেকে মোটামুটি উচ্চ তীব্রতার একপর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
রাজ্যের সবচেয়ে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ হলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর (তাতমাদো) এবং জাতিগত রাখাইন বৌদ্ধদের সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র দল আরাকান আর্মির মধ্যে সশস্ত্র সঙ্ঘাত।
গত আঠার মাস ধরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটনা। আর এর তীব্রতা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় পক্ষের উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি সত্ত্বেও তাতমাদো আরাকান আর্মিকে দমন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। যদিও আরাকান আর্মি যুদ্ধের ময়দানে স্বাধীনতা বা বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে বলেও বিশ্বাস করার কারণ নেই। এখানকার নাগরিকরাই এর ক্রসফায়ারে পড়ছে। আরাকান আর্মির অংশীদার হিসেবে অথবা তাদের গ্রামে যোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তারা ভারী মূল্য দিচ্ছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে নতুন মাত্রা?
আগের প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কয়েকবারই তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। মিয়ানমারের দুই সৈন্য হেগে গিয়ে উত্তর রাখাইনে গণহত্যা ও গণকবর দেয়ার কথা স্বীকার করার প্রেক্ষাপটে দেশটির সামরিক বাহিনীর এ অবস্থান দেখা যায়।
গত জুনে উত্তর শান রাজ্যের একটি গ্রামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী লোন নামের ৬০ বছর বয়স্ক এক চাষিকে হত্যা ও তার স্ত্রীকে আহত করে। এর প্রতিবাদে কিয়াকমে টাউনশিপে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু প্রতিবাদে সাড়া দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘোষণা করে যে, বিনা অনুমতিতে বিক্ষোভ আয়োজনকারী তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। কিন্তু গত মাসের শেষ দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে স্বীকার করে যে, তাদের এক সৈন্য ওই কৃষকের মৃত্যুর জন্য দায়ী। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন আরো বলেন, প্লাটুন কমান্ডারকেও দায়ী করা হবে। কারণ তিনিও ওই ঘটনার জন্য দায়ী।
পৃথক এক ঘটনায় রাথেদং টাউনশিপের এক স্থানীয় রাখাইন নারীকে তিন মিয়ানমার সৈন্য ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জুলাই মাসে সামরিক বাহিনী তা অস্বীকার করে। কিন্তু দুই মাস পর মিয়ানমার সৈন্যরা হঠাৎ করে তার সৈন্যদের দায়ের কথা স্বীকার করে। তবে সামরিক বাহিনী জানায়, অপরাধীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।
এই দুই ঘটনা আসলে একই ধরনের শত শত ঘটনার ইঙ্গিত মাত্র। এতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবে দেখা যায়। প্রথমে অপরাধের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়। পরে স্বীকার করা হলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না।
এর আগে রাখাইনে গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধ আবারো সংঘটিত হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশিলে। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান এবং নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ব্যাপারে মিয়ানমার বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু উপগ্রহ চিত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতেও মিয়ানমার উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
নিরাপত্তা পরিষদে চিঠি
নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন থেকে সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের কাছে দেয়া এক চিঠিতে রাখাইনের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে যেকোনো নিরাপত্তা অভিযানের সময় বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিয়ানমারের দায়-দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। চিঠিতে রাখাইনের পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজনাকর করা থেকে মিয়ানমারকে বিরত রাখতে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।
ইসরাইল, হারানো ট্রাইব ও আঞ্চলিক উত্তেজনা
এখানকার উত্তপ্ত পরিস্থিতি থেকে অন্য কেউ কি ফায়দা তুলতে চায়? এই প্রশ্নটিও আলোচনায় রয়েছে। যেকোনো অঞ্চলে বৈশ্বিক খেলোয়াড়রা তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে কর্তৃপক্ষকে বাড়াবাড়ি করার জন্য প্রলুব্ধ করে তোলে। এরপর এই অপরাধের ব্যাপারে এমন চাপ তৈরি করা হয় যাতে নতি স্বীকারে সরকার বাধ্য হয়।
এই অঞ্চলের উত্তেজনার সাথে সাধারণভাবে ইসরাইলকে টেনে আনতেন না বিশ্লেষকরা। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরাইলের গোপন সম্পৃক্ততা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ, ভারতের সাথে বিশেষ কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণ ও কাশ্মির পরিস্থিতিতে সম্পৃক্ত হওয়া এবং মিয়ানমারের সাথে সামরিক সম্পর্ক আর উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে হারানো ইহুদি ট্রাইব হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ও ইসরাইলের নাগরিকত্ব প্রদান পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল দি ওয়্যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত সেপ্টেম্বর ১৯ ডেইলি ওয়্যার.কম এ লেখা হান্ক বেরিয়েনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ২,৭০০ বছর আগে, বাইবেলের ১২টি উপজাতি নিয়ে গঠিত ইসরাইলের দু’টি রাষ্ট্র পরিণত হওয়ার পরে, ইসরাইলের উত্তরে ১০টি উপজাতি এবং দক্ষিণে দু’টি উপজাতি যিহূদা ছিল। আসিরীয় সাম্রাজ্য জাতির দশটি উপজাতি নির্বাসিত করেছিল ইসরাইলে। বাকি দু’টি তখন পাওয়া যায়নি। ইসরাইলি সরকার এর একটির অংশ হিসেবে ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার জন্য উত্তর ভারত থেকে আরো কয়েক শতাধিক লোককে সাহায্য করছে। তারা নিজেকে ‘বেনি মেনাসে’ হিসেবে বর্ণনা করে। মেনাসের উপজাতি ছিল হারানো উপজাতির মধ্যে একটি।
ইসরাইলের নেসেট সদস্য পেনিনা তামানু-শাতা এই মাসে ঘোষণা করেন যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সহযোগিতায় তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের বেনি মেনাস সম্প্রদায়ের ৭২২ সদস্যের অভিবাসনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম দলটি অক্টোবরের পরে ইসরাইলে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেনি মেনাসের ৪,০০০ সদস্যকে এর মধ্যে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারতে আরো সাড়ে ছয় হাজার বেনি মেনাস ইহুদি ইসরাইলে আসার অপেক্ষায় আছেন। আগামী বছরগুলোতে আরো যারা ফিরে আসতে ইচ্ছুক তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনা হবে। উল্লেখ্য, এই গোষ্ঠীটি একসময় মনিপুর মিজোরামে ‘সিংল্যাং ইসরাইল’ গঠনের দাবি করার হুমকি দিয়েছিল।
বেনি মেনাসের বিষয়ে বলা হয়েছে, তাদের পূর্বপুরুষরা বার্মা, বাংলাদেশের সীমান্তে ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বসতি স্থাপনের আগে কয়েক শতাব্দী ধরে মধ্য এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন।
ডেইলি ওয়্যার আমেরিকার অন্যতম দ্রুত বর্ধমান রক্ষণশীল মিডিয়া সংস্থা। এতে প্রকাশিত এই লেখায় বাইবেলসহ বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শিন ও রাখাইনের বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীকে হারানো ইহুদি গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইন্টারনেটে এ সংক্রান্ত বহু গবেষণাধর্মী লেখা পাওয়া যায়।
তিন দেশের সংযোগস্থলে এখন যে উত্তপ্ত অবস্থা দেখা যাচ্ছে তার সাথে এর সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না তা নিয়ে অনেকের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। কেউ কেউ আফ্রিকার ইথিওপীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ইহুদিদের ভিন্ন দু’টি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন।
চীন-ভারত স্বার্থদ্বন্দ্ব রাখাইনেও
রাখাইন প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে এতটাই সমৃদ্ধ এবং এর কৌশলগত অবস্থান এত গুরুত্বপূর্ণ যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সব শক্তিরই এক ধরনের প্রলুব্ধকর দৃষ্টি রয়েছে এখানে। এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমাকে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে এখন যে উত্তোলনযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে তার অর্ধেক পরিমাণ রাখাইনের একটি গ্যাস ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে।
রাখাইনের আন্তর্জাতিক পানিপথটি চীন ও ভারত দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন যেখান থেকে ইউনান হয়ে জিংজিয়াং অঞ্চলের সাথে মহাসড়ক সংযোগ ও জ্বালানি সরবরাহ পাইপলাইন করছে; এটিকে কেন্দ্র করে পুরো অঞ্চলটিতে একটি অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার কাজ হচ্ছে। এই পাইপলাইন চীনের জন্য সংবেদনশীল মালাক্কা প্রণালীর একটি বিকল্প জ্বালানি রুট হতে পারে। চীন এ বিষয়টি বিবেচনা করে রাখাইনে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে।
অন্য দিকে, ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সাথে বাংলাদেশের বাইরে দিয়ে যোগাযোগের জন্য ভারত বহুল আলোচিত কালাদান নদী প্রকল্প অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই প্রকল্পের অধীনে রাখাইন উপকূল থেকে মিজোরাম পর্যন্ত স্থল ও পানিপথের সমন্বিত রুট ও অর্থনৈতিক করিডোর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে দিল্লির, যাতে ভারত ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এ কারণে ভারত ও চীনের দুই দেশেরই রাখাইনের প্রতি বিশেষ নজর রয়েছে।
চীনের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিক ইয়াং জিয়েশির সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফর হলো করোনাভাইরাস মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর মিয়ানমারে চীনের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর। সময়ের বিবেচনায় এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিয়ানমার নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে যে, অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি ক্ষমতায় আবার ফিরে আসবে।
মিয়ানমারের কাছে চীন সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার, বিদেশী বিনিয়োগ ও সহায়তার প্রধান উৎস শুধু নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কূটনীতিক আশ্রয়ের জায়গাটাও হলো চীন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের যে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, চীন আর রাশিয়ার তৎপরতার কারণে সেটা হতে পারেনি।
চীনও এই সম্পর্ক থেকে উপকৃত হয়। মিয়ানমার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পকে সহায়তা করে এবং এর অংশ হিসেবে দুই দেশ চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর (সিএমইসি) প্রকল্প নিয়ে সহযোগিতা করছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে বেইজিংয়ের ‘এক চীন’ নীতির প্রতি সমর্থনও জানিয়েছে মিয়ানমার। শি’র সফরের সময় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উ উইন মিন্ত বলেছেন, তার দেশ সবসময় তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। হংকং ও ম্যাকাউয়ের জন্য চীন যে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেটিরও স্বীকৃতি দিয়েছে মিয়ানমার।
চীন আর মিয়ানমারের সম্পর্কের এই অগ্রগতি তাদের আরেক শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হচ্ছে। ভারত মহাসাগরে মিয়ানমারের সাথে নৌ সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে ভারতের। নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরুর সময় থেকেই তাদের বেইজিং থেকে দূরে রাখার জন্য ভারত মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে, যৌথ সামরিক মহড়া এবং সামরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নৌ সহযোগিতা জোরদার করে এসেছে।
ভারতের কৌশলবিদরা মনে করেন, চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে সুদান পর্যন্ত যে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ গড়ে তুলেছে বেইজিং, ভারতকে চার পাশ থেকে ঘিরে ফেলার জন্যই সেটি করা হয়েছে। এই চক্রটা আরো শক্তিশালী হয়েছে পূর্বে মিয়ানমার আর পশ্চিমে পাকিস্তানের সহযোগিতায়।
সিএমইসি এবং সিপিইসি দুটোকেই নয়াদিল্লি চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ বাস্তবায়নের অংশ মনে করে। এগুলো নিয়ে ভারত শঙ্কিত, কারণ নয়াদিল্লি মনে করে এর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অরুণাচল প্রদেশের কাছে এবং উত্তর-পশ্চিমে কাশ্মিরের কাছে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব আরো বেড়ে যাবে।
নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগের কারণ হলো দুটো প্রকল্পের কাজই দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। প্রেসিডেন্ট উ উইন মিন্ত এবং স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির সাথে ইয়াংয়ের বৈঠকে সিএমইসি’র গতি বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ইয়াংয়ের মিয়ানমার সফরের মাত্র ১০ দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা শিগগিরই মিয়ানমার সফর করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
দুই বছর আগে, চীন প্রতিবেশী এলাকাগুলোতে ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য তারা ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ফর্মুলা দিয়েছিল। এতে বলা হয়, চীন, ভারত আর মিয়ানমারের মধ্যে অথবা চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিকট ভবিষ্যতে একটা সমন্বয়ের সম্পর্ক হতে পারে। যদি না হয়, তাহলে প্রতিবেশী এলাকাগুলো বেইজিং আর নয়াদিল্লির মধ্যে একটা তীব্র ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা অপেক্ষা করছে। চীন মনে করে এর পুরোটাই নির্ভর করছে ভারতের ওপর। ভারত চীনের এই পথে এগোচ্ছে বলে মনে হয় না।
ডি-এসকালেশনের কোনো সম্ভাবনা নেই!
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ মনে করছে, নিকট-মেয়াদে ডি-এসকালেশনের কোনো সম্ভাবনা নেই রাখাইনে। আরাকান আর্মি মনে করে যে, সুবিধাজনক অবস্থানের মধ্যে থেকে তারা সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তাতমাদো স্বীকার করবে না যে তারা রাখাইনে জিতছে না আর তারা লড়াইয়ে আরো সেনা, ভারী অস্ত্র এবং বিমানবাহিনীর শক্তি নিয়ে আসছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, মিয়ানমারকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে অনেক রাখাইন মানুষ গভীর বিভ্রান্তি সত্ত্বেও সশস্ত্র সংগ্রামে সমর্থন দিচ্ছে এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য তাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই অবস্থায় সরকারের এমন একটি কৌশল দরকার যা রাখাইনের জনগণের অভিযোগগুলোর স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের লক্ষ্যগুলো শান্তিপূর্ণভাবে অনুসরণ করার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং কার্যকর পথের প্রস্তাব দেয়। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি পরিচালনায় সামরিক বাহিনীকে প্রধান ভূমিকা দেয়ার সরকারের বর্তমান পদ্ধতির সম্ভাবনা, আশা বা প্রত্যাশা নিয়ে, সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি আরো উন্নত হবে, এমনটি গভীর সঙ্কটের প্রতিকারের মতো কৌশল নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো নিষ্পত্তি না হলে রাখাইন রাজ্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকারই দেখা যাবে। ইসরাইল-ভারত এখানে সমন্বিত কৌশল নিলে চীনের সাথে সঙ্ঘাত বাড়বে। আর এতে সঙ্কট মোকাবেলা করা আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
ফলে যুদ্ধের ময়দানে বিরোধের সমাধান হতে পারবে না। রাখাইনের অভিযোগগুলোর সুরাহা এবং জনগোষ্ঠীকে নতুন আশা দেয়ার জন্য সরকারের একটি রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োজন। এটি নির্বাচনী গণতন্ত্র এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা অর্জনে সহায়তা করতে পারে। রোহিঙ্গাদের নির্মূলের চিন্তা না করে তাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে সমন্বয়ের কার্যকর চেষ্টা নিতে হবে একই সাথে। তা না হলে এখানকার পরিস্থিতি সবপক্ষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
mrkmmb@gmail.com