রাখাইনে চীন-ভারত স্বার্থদ্বন্দ্ব
রাখাইনে চীন-ভারত স্বার্থদ্বন্দ্ব - ছবি সংগৃহীত
রাখাইন প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে এতটাই সমৃদ্ধ এবং এর কৌশলগত অবস্থান এত গুরুত্বপূর্ণ যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সব শক্তিরই এক ধরনের প্রলুব্ধকর দৃষ্টি রয়েছে এখানে। এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমাকে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে এখন যে উত্তোলনযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে তার অর্ধেক পরিমাণ রাখাইনের একটি গ্যাস ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে।
রাখাইনের আন্তর্জাতিক পানিপথটি চীন ও ভারত দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন যেখান থেকে ইউনান হয়ে জিংজিয়াং অঞ্চলের সাথে মহাসড়ক সংযোগ ও জ্বালানি সরবরাহ পাইপলাইন করছে; এটিকে কেন্দ্র করে পুরো অঞ্চলটিতে একটি অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার কাজ হচ্ছে। এই পাইপলাইন চীনের জন্য সংবেদনশীল মালাক্কা প্রণালীর একটি বিকল্প জ্বালানি রুট হতে পারে। চীন এ বিষয়টি বিবেচনা করে রাখাইনে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে।
অন্য দিকে, ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সাথে বাংলাদেশের বাইরে দিয়ে যোগাযোগের জন্য ভারত বহুল আলোচিত কালাদান নদী প্রকল্প অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই প্রকল্পের অধীনে রাখাইন উপকূল থেকে মিজোরাম পর্যন্ত স্থল ও পানিপথের সমন্বিত রুট ও অর্থনৈতিক করিডোর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে দিল্লির, যাতে ভারত ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এ কারণে ভারত ও চীনের দুই দেশেরই রাখাইনের প্রতি বিশেষ নজর রয়েছে।
চীনের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিক ইয়াং জিয়েশির সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফর হলো করোনাভাইরাস মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর মিয়ানমারে চীনের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর। সময়ের বিবেচনায় এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিয়ানমার নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে যে, অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি ক্ষমতায় আবার ফিরে আসবে।
মিয়ানমারের কাছে চীন সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার, বিদেশী বিনিয়োগ ও সহায়তার প্রধান উৎস শুধু নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কূটনীতিক আশ্রয়ের জায়গাটাও হলো চীন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের যে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, চীন আর রাশিয়ার তৎপরতার কারণে সেটা হতে পারেনি।
চীনও এই সম্পর্ক থেকে উপকৃত হয়। মিয়ানমার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পকে সহায়তা করে এবং এর অংশ হিসেবে দুই দেশ চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর (সিএমইসি) প্রকল্প নিয়ে সহযোগিতা করছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে বেইজিংয়ের ‘এক চীন’ নীতির প্রতি সমর্থনও জানিয়েছে মিয়ানমার। শি’র সফরের সময় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উ উইন মিন্ত বলেছেন, তার দেশ সবসময় তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। হংকং ও ম্যাকাউয়ের জন্য চীন যে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি গ্রহণ করেছে, সেটিরও স্বীকৃতি দিয়েছে মিয়ানমার।
চীন আর মিয়ানমারের সম্পর্কের এই অগ্রগতি তাদের আরেক শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হচ্ছে। ভারত মহাসাগরে মিয়ানমারের সাথে নৌ সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে ভারতের। নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরুর সময় থেকেই তাদের বেইজিং থেকে দূরে রাখার জন্য ভারত মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে, যৌথ সামরিক মহড়া এবং সামরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নৌ সহযোগিতা জোরদার করে এসেছে।
ভারতের কৌশলবিদরা মনে করেন, চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে সুদান পর্যন্ত যে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ গড়ে তুলেছে বেইজিং, ভারতকে চার পাশ থেকে ঘিরে ফেলার জন্যই সেটি করা হয়েছে। এই চক্রটা আরো শক্তিশালী হয়েছে পূর্বে মিয়ানমার আর পশ্চিমে পাকিস্তানের সহযোগিতায়।
সিএমইসি এবং সিপিইসি দুটোকেই নয়াদিল্লি চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ বাস্তবায়নের অংশ মনে করে। এগুলো নিয়ে ভারত শঙ্কিত, কারণ নয়াদিল্লি মনে করে এর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অরুণাচল প্রদেশের কাছে এবং উত্তর-পশ্চিমে কাশ্মিরের কাছে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব আরো বেড়ে যাবে।
নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগের কারণ হলো দুটো প্রকল্পের কাজই দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। প্রেসিডেন্ট উ উইন মিন্ত এবং স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির সাথে ইয়াংয়ের বৈঠকে সিএমইসি’র গতি বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ইয়াংয়ের মিয়ানমার সফরের মাত্র ১০ দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা শিগগিরই মিয়ানমার সফর করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
দুই বছর আগে, চীন প্রতিবেশী এলাকাগুলোতে ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য তারা ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ফর্মুলা দিয়েছিল। এতে বলা হয়, চীন, ভারত আর মিয়ানমারের মধ্যে অথবা চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিকট ভবিষ্যতে একটা সমন্বয়ের সম্পর্ক হতে পারে। যদি না হয়, তাহলে প্রতিবেশী এলাকাগুলো বেইজিং আর নয়াদিল্লির মধ্যে একটা তীব্র ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা অপেক্ষা করছে। চীন মনে করে এর পুরোটাই নির্ভর করছে ভারতের ওপর। ভারত চীনের এই পথে এগোচ্ছে বলে মনে হয় না।