আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ: কিছু কথা, কিছু ব্যথা
আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ: - ছবি সংগৃহীত
উপমহাদেশের বরেণ্য আলেমে দ্বীন, হেফাজতে ইসলামের আমীর চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলামের মহাপরিচালক শায়খুল ইসলাম হজরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ:-এর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে একটি শতাব্দীর যবনিকা ঘটল। রয়ে গেল ঘটনা পরম্পরা, একরাশ অম্লমধুর সুখস্মৃতি ও যন্ত্রণাদায়ক বৈরিতা যার রেশ চলবে অনেক দিন। ইসলামী সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ, বিদয়াত ও শিরকমুক্ত সমাজ গঠন, আত্মশুদ্ধি ও কওমি শিক্ষার উন্নয়নে তার অসামান্য অবদান ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে।
তিনি আগাগোড়া ছিলেন জ্ঞান গবেষক, হাদিসের ওস্তাদ ও আধ্যাত্মিক রাহবার। ১৯৪০ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফারিগ হওয়ার পর থেকে তিনি শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। এক দিনের জন্যও দারস ও তাদরিস থেকে দূরে থাকেননি। ৮০ বছর ইলমে দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, এর মধ্যে ৩৪ বছর তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব¡ পালন করেন, এমনকি অসুস্থ হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে বোখারি শরিফের পাঠদান করতেন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে আছে তার বিপুল খলিফা, শিষ্য, ছাত্র ও গুণগ্রাহী। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া ও কওমি মাদরাসা বোর্ডসমূহের সর্বোচ্চ পরিষদ হাইয়াতুল উলিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় দাওরায়ে হাদিসের সনদ রাষ্ট্রীয়ভাবে এমএ আরবি ও ইসলামের ইতিহাসের সমমান স্বীকৃতি লাভ করে। অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে কওমি অঙ্গনে এত জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি আর হয়নি।
১০৪ বছরের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পঠন পাঠন, লেখালেখি, জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণ, ওয়াজ ও নসিহতের বাইরে অন্য কোনো ক্ষেত্রে তার পদচারণা ছিল না বললেই চলে। রাজনীতি, কূটনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ও ম্যাকিয়াভেলিয়ান মারপ্যাঁচের ঊর্র্ধ্বে ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সাদাসিধে, আড়ম্বরবর্জিত, সহজ-সরল এক দরবেশ। সৌজন্যবোধের প্রাবল্য ও শান্ত সমাহিত মন মেজাজের কারণে তিনি মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়েন।
স্মর্তব্য, পাকিস্তান আমলে হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন মহাপরিচালক, হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ:-এর খলিফা হজরত আল্লামা আবদুল ওয়াহাব রহ: যখন জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হিসেবে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ঢাকা, করাচি ও লাহোরে তৎপর ছিলেন, তখনো হজরত আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে দলীয় রাজনীতি বা কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এমনকি উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খুল ইসলাম হজরত আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ:-এর যেসব খলিফা বাংলাদেশে ছিলেন কমবেশি সবাই জমিয়তে ওলামার প্লাটফর্মে সক্রিয় ছিলেন। তিনি তাদের সাথেও যুক্ত হননি। মূলত তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী জ্ঞানগবেষক, নীরব সাধক ও প্রচারবিমুখ এক বুজুর্গ। বোখারি শরিফের ভাষ্যসহ বড়-ছোট মিলিয়ে বাংলা ও উর্দু ভাষায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি গ্রন্থ রচনা করেন। কিতাব অধ্যয়ন, জিকির আজকার, অজিফা পাঠ, নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন ছিল তার দৈনন্দিনের আমল।
এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি কওমি অঙ্গনের আলেম-ওলামাদের নেতৃত্বে আসীন হন। বায়তুল মোকাররমের খতিব হজরত আল্লামা ওবায়দুল হক রহ:, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ: ও আল্লামা ফজলুল হক আমিনী রহ:-এর মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিবাদী আলেমদের ইন্তেকালের কারণে কওমি অঙ্গনের ওলামা-মাশায়েখদের নেতৃত্বের সঙ্কট দেখা দেয়। সরকারের শিক্ষা ও নারীনীতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে নাস্তিক্যবাদী শক্তির আস্ফালন, ব্লগার ও সুশীল নামে পরিচিত একশ্রেণীর সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর ইসলামবিরোধী বক্তব্য ও মন্তব্য যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন জন্ম হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামক অরাজনৈতিক সংগঠনের। সে সময় হজরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ:-এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী অন্য কোনো ব্যক্তি সামনে ছিল না। আন্দোলনকারীরা তাকেই আমীর হিসেবে বেছে নেন। তিনি হয়ে ওঠেন নবজাগরণের প্রতীক।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ: ২০১২-১৩ সালে ১৩ দফা দাবি নিয়ে যখন ময়দানে আসেন তখন তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, ‘আমার আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বা দলবিশেষের বিরুদ্ধে নয়। ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক্যবাদীদের বিরুদ্ধে আমার আন্দোলন। কোনো দলকে ক্ষমতা থেকে নামানো বা কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানো আমার অ্যাজেন্ডা নয়। রাস্তায় যেখানে সরকার বাধা দেবে সেখানে জায়নামাজ নিয়ে আপনারা বসে পড়বেন এবং তাসবিহ পাঠ করবেন।’
হেফাজতে ইসলামকে অরাজনৈতিক সংগঠন বলা হলেও কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল কোনো কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতা হেফাজতের নেতৃত্বের সামনের সারিতে চলে আসেন এবং হেফাজতের প্লাটফর্ম থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০১৩ সালের ৫ মে সন্ধ্যার আগেই যদি মুনাজাতের মাধ্যমে শাপলা চত্বরের জমায়েত শেষ করে দেয়া হতো, তাহলে ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। বার্গেনিং পাওয়ার হিসেবে হেফাজতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। ভয়ঙ্কর এক ট্র্যাজেডি এড়ানো যেত। নিরীহ মাদরাসার ছাত্র ও ঈমানদার মানুষদের প্রাণহানি বন্ধ করা যেত। মার খেল নিরীহ মানুষ। রক্তাক্ত হলো শাপলা চত্বর। হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দেয়া হলো মামলা। মামলাগুলো এতদিনেও প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর হেফাজত অনেকটা নীরব হয়ে গেল। ১৩ দফা দাবি আর জোরদার হলো না। মাঝে মধ্যে ইস্যুভিত্তিক বিবৃতি ও শানে রেসালত সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনের তৎপরতা সীমিত রাখা হলো।
শায়খুল ইসলাম হজরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ: তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান যেখানে তিনি যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব-বার্ধক্য উৎসর্গ করেন ইন্তেকালের মাত্র ২০ ঘণ্টা আগে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ভাঙচুর ও বিক্ষোভের মুখে তাকে মহাপরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করা হয়। ১০৪ বছর বয়সে মুমূর্ষু অবস্থায় ছাত্র আন্দোলনের ধকল সহ্য করার শারীরিক সক্ষমতা নিশ্চয় তার ছিল না। তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানের সন্তানতুল্য আদরের শিক্ষার্থীরা তার অব্যাহতি চাচ্ছে, ঘটনার এ আকস্মিকতার জন্য সম্ভবত তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। এর পর তিনি সম্বিত হারিয়ে ফেলেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ ঘণ্টা পর তিনি পার্থিব জীবন থেকে অব্যাহতি নেন। মৃত্যু নিশ্চিতভাবে অবধারিত, তবে তার বাহ্যিক কিছু কারণ থাকে। একটি অব্যক্ত বেদনা নিয়ে জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন তিনি। ক্ষমা করুন হে জাতির রাহবার।
আন্দোলন, বিক্ষোভ, ক্লাস বর্জন ও ভাঙচুরের সংস্কৃতির সাথে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা পরিচিত নয়। এগুলো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্য। কওমি ছাত্ররা সাধারণত বিনয়ী, ভদ্র ও ওস্তাদদের প্রতি নিবেদিত। কেন তারা হাটহাজারী মাদরাসায় একজোট হয়ে মাঠে নেমে এলো, বিক্ষোভ করল, এমনকি ভাঙচুর পর্যন্ত চালাল, এটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকের ধারণা, এটা দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। এটা একদিনে হয়নি। তিলে তিলে ক্ষোভ দানা বাঁধে। মাদরাসার শূরার (পরিচালনা পরিষদের) বিজ্ঞ সদস্যরা কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে আগেভাগে সতর্কতাসূচক সিদ্ধান্ত নিলে এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি এড়ানো যেত বলে অনেকে মনে করেন। হয়তো চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি।
হাটহাজারীর ঘটনাপরম্পরা থেকে শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে যেকোনো মাদরাসা ও মাদরাসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য। মাদরাসা ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি বলে মনে করেন কওমি ঘরানার অনেকে। এর মধ্যে রয়েছে- ক. মজলিসে শূরা শক্তিশালীকরণ, খ. চাকরিবিধি প্রণয়ন করে নিয়োগ-বিয়োগ, প্রমোশনের ও অবসরভাতার নিয়ম প্রবর্তন, গ. অভিযুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, ঘ. মুহতামিমদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সীমিতকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির আওতায় আনা, ঙ. শিক্ষক ও মুহতামিমের বয়সসীমা নির্ধারণ, চ. সরকারি অডিটের মাধ্যমে বার্ষিক আয়-ব্যয় হিসাব নিরীক্ষণ। অন্যথায় এ রকম আন্দোলন ও বিক্ষোভ চলতেই থাকবে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
শায়খুল ইসলাম হজরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ:-এর নামাজে জানাজায় সর্বস্তরের লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ তার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতা, ভারতের জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের আল্লামা আরশাদ মাদানী, মাওলানা মাহমুদ মাদানী, পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি আল্লামা মুফতি তকী ওসমানীসহ দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। সুন্নাতে রাসূলকে জিন্দা করার প্রয়াস, জনবান্ধব কর্ম, ইলমের খিদমত ও সমাজসংস্কারে তার অনবদ্য অবদানের জন্য জাতি তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। আল্লাহ তায়ালা হজরতের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করুন, আখিরাতে দারাজাত বুলন্দ করে দিন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে উচ্চ মাকাম নসিব করুন। তার প্রতি রইল আমাদের অনিঃশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।