কয়েকজন সাহাবার অসীম বীরত্ব
কয়েকজন সাহাবার অসীম বীরত্ব - প্রতীকী
মহানবী সা: ছিলেন সত্যের ব্যাপারে আপসহীন। হক কথা বলতে, হক প্রচার করতে হক অনুযায়ী আমল করতে কারো পরোয়া করতেন না। ভয় করতেন না আল্লাহ ছাড়া কাউকে। কাফিররা তাঁকে দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য সম্পদ, নারী, ক্ষমতা ইত্যাদির লোভ দেখিয়েছে। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি এ দাওয়াত থেকে বিরত থাকব না। তিনি আল্লাহর শিখানো বাণীই বলতেন- বলুন! এই আমার পথ, আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই (সূরা ইউসুফ- ১০৮)। তিনি দাওয়াত ও দ্বীন প্রচারের জন্য এক দল এমন একজন লোক গঠন করেন, যারা ছিলেন তার আদর্শে আদর্শবান এবং তার পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। তাঁরা ছিলেন সত্য পালনেও সিদ্ধান্তে অটল। যাদের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা- মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর সাথীগণ কাফিরদের ক্ষেত্রে বজ্রকঠোর এবং নিজেদের বেলায় রহমতস্বরূপ। (সূরা আল ফাতহ- ২৯)
সাহাবায়ে কিরামের বীরত্ব : সাহাবায়ে কিরাম সবাই ছিলেন বীর। তাঁদের বীরত্ব প্রকাশ পেয়েছে কেবল দ্বীনের স্বার্থে, ব্যক্তি স্বার্থে নয়। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন-
১. হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা: : হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা: মুসলমান হওয়ার পর হতে সব জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। তাবুক যুদ্ধে তিনি মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন। খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর একদল মুসলমান জাকাত দিতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। হজরত ওমর রা: বললেন- আপনি তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করবেন যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা: বলেন- যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব। পরে হজরত ওমর রা: নিজের ভুল বুঝতে পারেন।
হজরত ওমর ফারুক রা: : মহানবী সা: দোয়া করেছিলেন- হে আল্লাহ! ওমর ইবন খাত্তাব এবং আবু জেহেলের মধ্যে আপনার কাছে যে অধিক পছন্দনীয় তাকে মুসলমান করে ইসলামকে শক্তিশালী করুন। আল্লাহ তায়ালা ওমর ইবন খাত্তাবকে কবুল করেন। তিনি মুসলমান হওয়ার পর কুরাইশদের নিকট তা ব্যক্ত করলে তারা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনিও তাদেরকে প্রহার করেন এবং বলেন, আল্লাহর শপথ! যদি আমরা সংখ্যায় তিন শ'জনও হতাম, তাহলে মক্কায় হয় তোমরা থাকতে অথবা আমরা থাকতাম (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড-পৃ: ৩৪৮)। তাঁর তিন দিন আগে মুসলমান হন হামযা রা:। উভয়ই ছিলেন বীর। হজরত ওমর ফারুক রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর নিকট গিয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! আপনি কী সত্য নবী নন? রাসূল সা: বলেন, অবশ্যই সত্য নবী। ইসলাম কী সত্য দ্বীন নয়? রাসূল সা: বলেন, অবশ্যই সত্য দ্বীন তা হলো গোপনীয়তা কেন? আমরা প্রকাশ্যে তাওয়াফ করব, প্রকাশ্যে নামাজ পড়ব। অতঃপর মুসলমানগণ দু’কাতারে বিভক্ত হলেন, এক কাতারের সামনে হজরত ওমর রা:, অপর কাতারের সামনে হজরত হামযা রা:, আর মাঝখানে মহানবী সা: দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে তাওয়াফ করেন। প্রকাশ্যে আজান ও দ্বীন প্রচারে হজরত ওমর রা:-এর অগ্রণী ভূমিকার কারণে মহানবী সা: তাঁকে ফারুক উপাধি দান করেন।
হজরত আলী রা: : তাঁর উপাধি হলো- হায়দার (সিংহ), আসাদুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি), শের-ই যায়দান (আল্লাহর সিংহ) ইত্যাদি। তিনি বদর, উহুদ, খন্দক ইত্যাদি বহু যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি ষোলোটি আঘাতপ্রাপ্ত হন। উহুদের মাঠে এমন বীরত্ব দেখিয়ে ছিলেন যে, হজরত জিবরাঈল আ:- তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করেছেন। হজরত আলী রা: কোনো কাফিরকে মহানবী সা:-এর কাছে আসতে দেননি। রাসূল সা: তাঁকে লক্ষ করে বলেন- ‘অবশ্যই আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে।’ হজরত জিবরাঈল আ: এ কথা শুনে বলেন, আর আমি আপনাদের উভয় থেকে (কুররাতুল আইন)।
হজরত হামযা : স্নেহের ভাতিজাকে আবু জেহেল গালি দেয়ায় তিনি ধৈর্যহারা হন। পরে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের জন্য তাঁকে কবুল করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ ইসলামকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। সাহসিকতার জন্য তিনি আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ উপাধি লাভ করেন। তিনি বদরের যুদ্ধে উতবাকে হত্যা করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়ে সাইয়্যেদুশ শোহাদা (শহীদদের সর্দার) উপাধি লাভ করেন।
হজরত খালেদ ইবন অলীদ : মুতার যুদ্ধে যায়েদ রা:, হজরত জাফর ইবন আবু তালেব রা: এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রা: এর শাহাদাতের পর হজরত খালেদ ইবন অলীদ রা: সেনা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই যুদ্ধে তাঁর হাতে ৯টি তরবারি ভেঙে ছিল (সহিহ বুখারী ২য় খণ্ড পৃ: ৬১১)। তাঁর নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ কাফিরের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি জীবনে কোনো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেননি। তিনি সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি) হিসেবে সুপরিচিত।
হজরত আবুদল্লাহ ইবন জাহস ও হজরত সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস রা: : তাঁরা উভয়ে উহুদের যুদ্ধের প্রাক্কালে একত্রে দোয়া করেছিলেন। হজরত সা’দ রা: দোয়া করেন- হে আল্লাহ! আগামীকাল যুদ্ধে আমি যেন শত্রুকে পরাজিত হত্যা করে তার ধন-সম্পদ লাভ করতে পারি। হজরত আবদুল্লাহ বলেন আমিন। হজরত আবুদল্লাহ ইবন জাহস দোয়া করেন, হে আল্লাহ! আগামীকাল যুদ্ধে আমি যেন শহীদ হই এবং তারা যেন আমার নাক, কান কেটে নেয়। বিচার দিবসে আমি যেন আল্লাহর দরবারে এ অবস্থায় হাজির হতে পারি। হজরত সা’দ রা: বলেন- আমিন। আল্লাহ তায়ালা উভয়ের দোয়া কবুল করেন (ইসাবা, সাহাবা রচিত)।
হজরত হানযালা রা: : তিনি নতুন বিয়ে করেছেন। নববধূর সাথে রাত যাপন করেন। হঠাৎ উহুদ যুদ্ধের ঘোষণা শুনতে পান। রাসূল প্রেম ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণের প্রেরণা তাঁর এত তীব্র ছিল যে, ফরজ গোসলের কথা ভুলে যান। নাপাক শরীরে যুদ্ধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে শাদ্দাদ ইবনে আওসের তরবারির আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন। এ বীর যোদ্ধাকে ফেরেশতারা জমজমের পানি দ্বারা গোসল করান।
হজরত আমর ইবন জুমুহ : তিনি ছিলেন খোঁড়া। ঠিকভাবে হাঁটতে পারতেন না। তাই রাসূল সা: তাঁকে প্রথমে উহুদ যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন নাছোড় বান্দাহ, যুদ্ধে যাবেনই। পরে মহানবী সা: যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। অতপর তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার সময় বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি জান্নাত লাভের আশা করি। অতপর উহুদের যুদ্ধে তিনি ও তাঁর এক পুত্র শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর স্ত্রী স্বীয় স্বামী ও পুত্রের লাশ উটের পিঠে করে মদীনায় আনতে চাইলেন কিন্তু উটটি হঠাৎ বসে পড়ে। বহু প্রচেষ্টার পরেও একে উঠানো সম্ভব হয়নি। পরে উহুদের মাঠেই তাদের সমাহিত করা হয় (সাহাবা চরিত্র)।
হজরত মুসআব ইবন উমাইর রা: : তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। তিনি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই সুন্দর ও সুঠাম দেহের অধিকারী। মহানবী সা: তাঁর শরীরের যথেষ্ট মিল ছিল। তাই তাঁর শাহাদাতের পর কাফেররা মহানবী সা:-কে শহীদ করেছিল বলে প্রচার করেছিল। তিনি সদা মূল্যবান পোশাক পরতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করার পর তার জীবন কাটে জীর্ণশীর্ণ ও তালি দেয়া জামা কাপড়ে। উহুদ যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা ছিল তাঁর হাতে। যুদ্ধে তিনি আবদুল্লাহ ইবন কোম্মার আসাতে শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর হজরত আলী রা: পতাকা ধারণ করেন। উহুদ যুদ্ধে তিনি অসাধরণ বীরত্ব সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি ইবনে কোম্মা ও অন্যদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে মহানবী সা:-কে হেফাজত করেন। তাঁকে কাফন পরানোর জন্য যে কাপড় ছিল তা যথেষ্ট ছিল না। কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে পা ইজখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়।
হজরত তালহা রা: : হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা: উহুদের যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেছেন, সে দিনের যুদ্ধের একক কৃতিত্ব ছিল তালহার। মহানবী সা:-কে রক্ষা করার দায়িত্ব তিনি সর্বাধিক পালন করেন। উহুদ যুদ্ধে তাঁর দেহে ঊনচল্লিশটি আঘাত লেগেছিল। তাঁর শাহাদাত আঙ্গুলসহ দু’টি আঙ্গুল নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল (ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬১)।
হজরত ওহাব ইবন কাবুস রা: : তিনি ছিলেন একজন গ্রাম্য সাহাবি। তিনি ছাগল চরাতেন। একদিন ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ছাগল নিয়ে মদিনা আসেন। সেখানে তিনি জানতে পান যে, রাসূল সা: উহুদে গমন করেছেন। অতঃপর তিনি রাসূল সা:-এর সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেখা করেন। ঠিক এ সময় একজন কাফের রাসূল সা:-কে আক্রমণ করতে অগ্রসর হলে রাসূল সা: বলেন- যে ব্যক্তি এদের তাড়িয়ে দিতে পারবে সে আমার সাথে জান্নাতে যেতে পারবে। অতঃপর হজরত ওহাব রা: তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কাফেরদের প্রতিহত করে তিনিও শহীদ হন (সাহাবা চরিত)।
লেখক : প্রধান ফকিহ্, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী।