যুক্তরাষ্ট্র-মালদ্বীপ চুক্তি : চীনা পত্রিকার বিশ্লেষণ
যুক্তরাষ্ট্র-মালদ্বীপ চুক্তি : চীনা পত্রিকার বিশ্লেষণ - ছবি : সংগৃহীত
কিছু কর্তৃত্বপরায়ণ ভারতীয় মিডিয়া সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মালদ্বীপের মধ্যকার সহযোগিতা চুক্তিকে জোর করে চীনের সাথে সম্পর্কিত করে ফেলছে। তারা বলছে, সম্পদ-সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক এই অঞ্চলে চীন তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে ভারতকে আরো বৃহত্তর ভূমিকা দিতে। ভারতীয় আউটলেটগুলো পরোক্ষভাবে বলছে যে সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র-মালদ্বীপ চুক্তির টার্গেট হলো ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।
মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জলদস্যূতা, সহিংস চরমপন্থাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ মানবপাচারের মতো আন্তঃজাতি হুমকির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও মালদ্বীপ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা চুক্তি করেছে।
চুক্তির বিষয়বস্তু ও দুই দেশের কর্মকর্তাদের করা মন্তব্যের আলোকে বলা যায়, এটি একটি স্বাভাবিক সহযোগিতা। এটি যত দিন এই অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতে ভূমিকা রাখবে, এই অঞ্চলের সব দেশ ও বিশ্বের উচিত এর প্রতি সম্মান জানানো ও একে স্বাগত জানানো।
এই চুক্তির সত্যিই যদি কোনো টার্গেট থাকে তবে তা হওয়া উচিত চীন নয়, বরং ভারত।ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে ভারত এই অঞ্চলকে সবসময়ই নিজস্ব প্রভাব-বলয় মনে করে এবং এই অঞ্চলের বাইরের কোনো দেশের উপস্থিতির বিরুদ্ধে খুবই সতর্ক।
মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব সবসময়ই বেশি ছিল। মালদ্বীপের জাতীয় নিরাপত্তার অনেকটাই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে ভারত। ফলে অন্যান্য দেশ যখন মালদ্বীপে বিনিয়োগ করে ও অবকাঠামো খাতে সহায়তা করে, তখন নয়া দিল্লি খুবই সতর্ক থাকে।
মালদ্বীপের সাথে চীন পারস্পরিকভাবে কল্যাণকর ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতায় সম্পৃক্ত রয়েছে। অবশ্য, অন্যান্য দেশের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ক নিয়ে চীনের বিশেষ কোনো অবস্থান নেই। মালদ্বীপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিরক্ষা চুক্তিটি এই এলাকায় ভারতের একচ্ছত্র অবস্থানকেই কার্যত ভেঙে দিয়েছে। ভারত যদি উদ্বিগ্ন না হয়, তবে চীন কিসের জন্য হবে?
মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের সাথে চীনা বাণিজ্যের বেশির ভাগই হয়ে থাকে ভারত মহাসাগর দিয়ে। আর চীন আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে তার সহযোগিতা জোরদার করছে। জলদস্যূতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভারত মহাসাগরের নানা অনিরাপদ অবস্থা বিবেচনা করে নৌচলাচলের স্বাধীনতা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চীনের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ভারত মহাসাগরের দেশগুলোর জন্য এটি একটি অভিন্ন উদ্বেগ।
ভারত মহাসাগরের কোনো দেশের সাথে চীনের কোনো ভূখণ্ডগত বা সামুদ্রিক বিরোধ নেই। বরং চীন তার পিএলএ নৌবাহিনীকে ইডেন উপসাগরে পাঠিয়েছে, জিবুতিতে সাপোর্ট বেইজ প্রতিষ্ঠা করেছে। চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে আসছে।
ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে চীনের অস্তিত্বকে হুমকি মনে করে ভারত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই অঞ্চলে ভারতের চেয়ে দুর্বল দেশগুলো চীনকে মনে করে গঠনমূলক শক্তি এবং সক্রিয়ভাবে দেশটির সাথে সহযোগিতা করছে। তারা ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতিকে স্বাগত জানায়, অনক দেশ সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার জন্য এমনকি চীনকে আমন্ত্রণও জানায়।
বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার কারণ ভারত মহাসাগরকে ভারত নিজের প্রভাব-বলয় মনে করে। অতীতে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে ভারত হুমকি মনে করত। এখন চীনকে তারা কৌশলগতভাবে সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে ভারত এবং এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে ইতিবাচক বলে দেখে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও ভারত যোগ দিয়েছে চীনকে সংযত করার জন্য।
ভারতের কোনো কোনো মিডিয়া, স্কলার ও কর্মকর্তরা মনে করছে, অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ অবধারিতভাবেই ভারতের মতো করেই চীনের সাথে আচরণ করবে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাথে ওইসব দেশের সাথে যতক্ষণ সহযোগিতা থাকবে, সেটাকে ভারতীয়রা চীনা প্রভাব প্রতিরোধ হিসেবেই মনে করবে।
কিন্তু বাস্তবে ভারত মহাসাগরের দেশগুলো বিশ্বের সব দেশের সাথে সহযোগিতা করতে আশা করে। তারা ভারত মহাসাগরে একটি বা দুটি পরাশক্তির শাসন দেখতে চায় না। ২১ শতকে দেশগুলো স্বাধীন, সমান ও পারস্পরিক কল্যাণকর সহযোগিতা কামনা করে। পরাশক্তিগুলোর উচিত হবে না তাদের প্রভাব-বলয় বাড়ানো। ভারতের সাথে কোনো বন্ধুপ্রতীম দেশের সহযোগিতার বিরোধিতা করে না চীন। চীন আশা করে, ভারত সুষ্ঠু মনোভাব প্রদর্শন করবে, চীনের সাথে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক কল্যাণকর সহযোগিতায় হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করবে।
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস