করোনা সহজে যেভাবে জয় করা সম্ভব
করোনাভাইরাস - ছবি সংগৃহীত
বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশের মানুষ করোনাকে জনসমাবেশে ডেকে এনে খলনায়কের মতো বলছে, ভিড়ের মধ্যে এনে তোকে পায়ের নিচে পিষে মারব। বের হলে সাথে সিনেমার খলনায়ক ডিপজল বা মিশা সওদাগরের মতো পিস্তল নিয়ে বের হবেন। টঙঘর থেকে এককাপ লেবু চা পান করে করোনাকে গুলি করে মেরে ফেলবেন। জনগণের এমন ডায়ালগের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এটা শুধু করোনার ক্ষেত্রে ঘটছে, তা নয়। এটা অসাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটছে। অভিযোগ, কিছু দিন আগে ঋণের জন্য বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখাতে রাজি না হওয়ায় এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও অতিরিক্ত এমডিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন একটি শিল্প গ্রুপের দুই পরিচালক।
বন্ধকী সম্পত্তি অপর্যাপ্ত হওয়ায় মাত্র ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে রাজি না হওয়ার কারণে গুলি ছুড়ে সিকদার গ্রুপের এমডি নাকি বলেছেন, ‘তোর এত বড় সাহস আমাদের ঋণ দিবি না, তোকে গুলি করে সারা জীবনের জন্য খোঁড়া করে দেবো।’ আমরা বাংলা সিনেমার নাম, চিত্রনাট্য, সংলাপ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করি। কিন্তু এই সিনেমার সব কিছু যে বাস্তবে মঞ্চায়িত হয়, তা এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে গুলি করাকে কেন্দ্র করে আবার নতুন করে জানল দেশবাসী। তাই বলা হয়, বাংলাদেশের সিনেমার চিত্রনাট্য যারা লেখেন, তাদের দোষ দেয়া বোকামি। তারা বাস্তবের অভিজ্ঞতা থেকেই খলনায়কদের সংলাপ বা চিত্রনাট্য লিখে থাকেন।
এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে ফলাফলের আশা অত্যন্ত ক্ষীণ। কারণ করোনাকালে দেশ থেকে অন্য দেশে বহির্গমন নিষিদ্ধ থাকলেও ক্ষমতা খাটিয়ে আসামি ব্যক্তিগত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে থাইল্যান্ডের পাতাইয়া বিচে অবকাশ যাপন করছেন। তাদের এই গমনের পর মনে হচ্ছে- যারা পারে তারা সবসময় সব পরিস্থিতিতে সব কিছুই করতে পারে। যারা পারে না তারা সব সুবিধা বা অসুবিধা থাকার পরও পারে না। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিবিদ ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, একটি গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রাইভেট বিমানে লন্ডনে গমন করেছেন। জনগণ আশা করছে, করোনামুক্ত থাকতে বা উন্নত চিকিৎসা নিতে অন্তত লাখ খানেক লোক তাদের পথ অনুসরণ করবে। জনগণের মনে একটা ক্ষীণ আশা জেগেছিল, এবার হয়তো করোনাকে কেন্দ্র করে দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নতি হবে। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে দেশে এবার সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা সমৃদ্ধ হাসপাতাল গড়ে উঠবে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা উন্নত দেশের মতো না হোক, অন্তত ভারতের টাটা-বিড়লা বা কোকিলাবেনের মতো হাসপাতাল গড়ে উঠবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। যে দেশে রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ করিম, জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা চৌধুরীর মতো প্রতারকের অভাব নেই; সে দেশে সরকারপ্রধান হাজার চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন সাধন দুরূহ ব্যাপার।
আসল আলোচনায় আসা যাক। করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমরা নাজেহাল। প্রতিনিয়ত হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা এবং লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। মন্ত্রী-এমপিসহ দেশবরেণ্য অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন করোনায়। কিন্তু এত নাজেহাল বা হতোদ্যম হওয়ার কিছু আছে কি? একবার লক্ষ করুন- করোনা কিন্তু বিআরটিএর মতো মানুষের ফিটনেস টেস্ট করতে আসছে। তবে করোনা এবং বিআরটিএর মধ্যে পার্থক্য হলো, করোনা টাকা নিয়ে আনফিট শরীরকে চলার জন্য ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় না। কিন্তু বিআরটিএ টাকার মাধ্যমে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িরও ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। তাহলে যারা করোনায় মারা গেছেন, তাদের বেশির ভাগের কি ফিটনেস ছিল না? তাদের অনেকের অ্যাজমা, হাঁপানি বা স্পেরিটরি ডিজিজ, কিডনি, লাংস, হার্টের সমস্যা ছিল। আর যারা শারীরিকভাবে ফিট থাকার পরও মারা গেছেন সেটা নিছক দুর্ঘটনা।
যেমন অনেক সাবধানতার পরও মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তাই হয়তো এটাকে একটা ‘সাধারণ ফ্লু’ বলা যায়। এমতাবস্থায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করার কোনো বিকল্প নেই। নিয়মমাফিক নিয়মিত এগুলো করতে পারলে করোনা বড় কোনো সমস্যা হয়তো হবে না। আর যারা শারীরিকভাবে বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন বা বয়স হয়ে গেছে তারা সাবধানে চলাচল করবেন। করোনা প্রাকৃতিকভাবে এসেছিল, আশা আছে- প্রাকৃতিকভাবেই চলে যাবে। অন্তত বাংলাদেশের মানুষের জন্য করোনা খুব বড় ব্যাপার নয়। এ ধরনের ভাইরাস নিয়ে প্রতিনিয়ত ওঠাবসা করি আমরা।
গ্রামের মানুষ সকালে যে কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পান্তাভাত খায় তাতে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া ও রোগজীবাণু থাকে। কিন্তু তাদের পাকস্থলি খুব সহজে তা হজম করে ফেলে এবং কায়িক শ্রমের ক্যালরি সংগ্রহ করে। এই পান্তাভাত যদি ইউরোপ-আমেরিকার বা উন্নত বিশ্বের কোনো লোক খায় হয়তো সপ্তাহ খানেক ফুড পয়জনিংয়ের পাশাপাশি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়বে।
অনেকে মাছ পচে গেলে তা গ্রামের বিশেষ শাক (পেপলি) দিয়ে চচ্চড়ি করে বা বেশি জ্বালিয়ে রান্না করে খায়। হাঁস-মুরগির কোনো রোগ হলে তা জবাই করে খায়। আর উন্নত বিশ্বে হাঁস-মুরগির সামান্য ফ্লু জাতীয় কিছু হলেই হাজার হাজার পশু-পাখি পুড়িয়ে বা মেরে ফেলে এবং মাটিতে পুঁতে ফ্লু সংক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করে। আসলে আমাদের সাথে করোনায় মৃতের সংখ্যায় ইউরোপ-আমেরিকার পার্থক্যের মূলে এটাই। তার সাথে রোদ ও গরমের তীব্রতা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। তা না হলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা থাকার পরও ইউরোপ-আমেরিকায় করোনায় এত লোক মারা যাবে কেন? আর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা থাকার পর মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম কেন!
আমরা অনেক আগে থেকেই শুনে আসছি- করোনা মহামারীর জন্য আগামী এক সপ্তাহ খুব বিপজ্জনক। সেই ‘সপ্তাহ’ আর এলো না। একই সময় ইউরোপ-আমেরিকায় হাজার হাজার লোক মারা গেছে। আরেকটা কথা- করোনার গন্তব্য যদি ফুসফুস না হয়ে আমাদের পাকস্থলি হতো; তবে এত দিনে দেশ থেকে করোনা সম্ভবত বিদায় নিত। একটা গবেষণায় দেখা গেছে- করোনায় এ পর্যন্ত যারা মারা গেছে, তাদের বেশির ভাগেরই হার্ট বিকল হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তারা মনে করছেন- এই বুঝি শেষ। আমার নিজেরও এমন অনুভূতি হয়েছে বেশ কয়েকবার। হয়তো করোনা জয় করেছি, কিন্তু অনেকে এভাবেই হার্ট ফেল করে মারা গেছেন। তবে এই সংখ্যা ক্রমেই কমছে। মাস তিনেক আগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
এক সময় ৪০০-৫০০ রোগী আক্রান্ত হতো, কিন্তু মারা যেত ১৫-২০ জন। এখন আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৫০০-এর মধ্যে। মারা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪৫ জনের মধ্যে। জনগণের অনাস্থা ও অনীহার কারণে নমুনা পরীক্ষাও অনেক কমে গেছে। তার মানে, মানুষ এখন মানসিকভাবে শক্তপোক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা ও আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে- ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এই হিসাবে দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বিপুল হওয়ার সম্ভাবনা। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডা: বিজন কুমার শীল বেশ কিছু দিন আগে বলেছেন, ‘দেশে ইতোমধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত।’ তার হিসাবে, বাংলাদেশে এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক কোটি। যাদের বেশির ভাগ ‘এমনি এমনি’ করোনা থেকে সেরে উঠেছে। যা তারা বুঝতেই পারেনি।
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা, ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই বলছেন, এটা ‘নরমাল ফ্লু’-এর মতো। অনেকেই বলছে, করোনা কোনো ব্যাপারই না!’ কিন্তু এটা যদি আস্তে আস্তে একটা সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে যায়? সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সক্ষমতা কি আমাদের আছে? আপনি আপনার পরিবারের কাছে অনেক কিছু। কিন্তু সরকারের কাছে শুধু একজন নাগরিক। সরকার আপনার জন্য সম্ভব সব করবে। মারা গেলে একটা সংখ্যা হিসাবে পরিসংখ্যানে যুক্ত করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দেবে। তাই করোনাজয়ী একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলব, করোনা কোনো ব্যাপার না, এটা আমিও মনে করি। আবার এটাও বলব, যে করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয় তার কাছে এটা শারীরিক ও মানসিক যুদ্ধ। যখন কোভিড-১৯ টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এলো তখন আমাকে একটা রুমে বন্দী করা হলো। করোনার প্রভাব যখন আমার শরীরে জেঁকে বসে তখন মনে হতো- আমার রুমটা ইহলোক সাঙ্গ করে পরলোকে যাওয়ার সেতুবন্ধন। অস্থিরতায় চার-পাঁচ দিন রাতে ঘুম হয়নি। যারা করোনায় আক্রান্ত হননি তাদের কাছে কথাগুলো আজগুবি শোনাতে পারে। কিন্তু এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা।
এটা অনুধাবন করতে পারবেন শুধু তারাই যারা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে অনেক সাহস নিয়ে হরহামেশা বলা যায়- ‘করোনা কোনো ব্যাপারই না।’ কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পর বেশির ভাগের মানসিকতা পুরোপুরি বদলে যায়। কারণ মৃত্যুভয় তাড়া করে সবসময়। মনে রাখবেন, নিজের জীবন একান্ত নিজের কাছে। নিজের, পরিবারের ও আশপাশের লোকের জীবনের স্বার্থে আপনি সচেতন হোন, সারা দেশ সচেতন হয়ে যাবে। সাহস দেখিয়ে করোনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে স্বাস্থ্যবিধি পুরো মেনে চলুন।
অনর্থক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি কেন হবেন? আশা করি খুব দ্রুত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন চলে আসবে। তখন বেশি টাকা খরচ করে হলেও কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন নিয়ে নেবেন। এই খরচ নিশ্চয়ই একটা জীবনের চেয়ে বেশি নয়, বরং ঢের কম। তাই সবার উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ মেনে চলে- স্বাস্থ্যসচেতন ও মানসিকভাবে শক্ত-বলিষ্ঠ হওয়া। সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা আমাদের তেমন কিছুই করতে পারবে না। এত কিছুর পরও যদি কেউ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যান, তবে তার সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে তাকে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। তার সাথে গল্প করতে হবে, কুশল বিনিময় করতে হবে। করোনা আক্রান্ত রোগী কখনো যেন মনে না করেন তিনি একা। আমি মনে করি, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে মানসিক শক্তি ও মনোবল বাড়িয়ে দেয়া ওষুধের চেয়ে বহুগুণ বেশি কার্যকর।
এখন আমিসহ সবার সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা- করোনামুক্ত হয়ে আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাক দেশ। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সার্বিক পরিমণ্ডলে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসুক। অসুস্থ, পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক।
লেখক : এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।