আল্লামা শফী সম্পর্কে যা বললেন ফরহাদ মজহার
আল্লামা শফী সম্পর্কে যা বললেন ফরহাদ মজহার - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশে দ্বীনি ইসলামের দেওবন্দী ধারার বর্ষীয়ান মুরুব্বি আল্লøামা শাহ আহমদ শফী ইন্তেকাল করেছেন। আমরা আহমদ শফী সাহেবের রূহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লামা আহমদ শফী কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশে দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদান অসামান্য। দেশের সাধারণ মানুষ তার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে।
মানুষ ভুলে যায় এবং ভুলে থাকে যে, দ্বীন ও দুনিয়ার যিনি প্রভু তাঁর শর্ত মেনেই আমরা সবাই দুনিয়ায় আসি। অতএব মানুষের আয়ু কখনোই মহাকালে উত্তীর্ণ হতে পারে না। নিশ্চয় সত্য হচ্ছে বিশ্বাস, মতবাদ এবং আমল নির্বিশেষে সবারই সীমা মওতের দ্বারা মাপা; নির্দিষ্ট। মানুষ সেখানেই ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছে। ইন্তেকালের পর যার যার আমলটুকু শুধু রয়ে যায়। আল্লাহ যেন আল্লামা আহমদ শফীর সৎ আমল কবুল করে নেন এবং মাটিতে তৈরি মানুষের সীমাবদ্ধতা বুঝে সব দোষ ও অপরাধ মার্জনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রাহমানুর রাহিম। দয়ার দয়া। দয়াল।
আল্লামা আহমদ শফী দুরারোগ্য অসুখে অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। আল্লাহ তাকে অনেক হায়াত দিয়েছেন। তার অনুপস্থিতি তবুও তার আশেকান আলেম ওলামা, ভক্ত ও বিপুল সংখ্যক মাদরাসাছাত্রদের কষ্ট দেবে। এই দেশের দ্বীনি শিক্ষায় উজ্জীবিত তরুণদের প্রাণে তিনি স্মৃতি হয়ে থাকবেন। তিনি দেওবন্দী ঘরানার অত্যন্ত সম্মানিত এবং শ্রদ্ধাবান মানুষ। তাকে বিনম্র সালাম জানাই।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী মূলত ধর্মবেত্তা বা ধর্মতত্ত্বে আলেম। সমাজবিজ্ঞান তার বিষয় নয় এবং তিনি রাজনৈতিক নেতাও নন। কিন্তু বাংলাদেশের এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ তাকে একটি বিশাল জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে টেনে এনেছিল। ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আগ্রাসী আস্ফালনের বিপরীতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা গণমানুষের প্রতিরোধ আন্দোলনের তিনি অবিসংবাদী নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। দুর্নীতিবাজ, অসৎ, ক্ষমতালোভী ও গণবিরোধী জাতীয় রাজনৈতিক দলের বিপরীতে ‘অরাজনৈতিক’ (?) এবং ‘নির্দলীয়’ (?) হেফাজতে ইসলাম হয়ে উঠেছিল জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যম। কিন্তু তার জন্য আল্লামা আহমদ শফী কিম্বা হেফাজতে ইসলামের অন্যান্য নেতার কেউই প্রস্তুত ছিলেন না।
জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। ২০১৩ সালে ইসলামবিদ্বেষী এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিপরীতে গড়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামের প্রতিরোধ সংগ্রাম ও লড়াইয়ের চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ণয়ের মুহূর্ত ছিল শাপলা চত্বর। ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে জনগণের লড়াই নতুন রূপ ধারণ করেছিল। সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা শাপলা মঞ্চের তাৎপর্য আল্লামা আহমদ শফী ধরতে পারেননি। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার জন্য যে এলেম, হিকমত ও আমল জরুরি, তিনি সেই পথ ধরে বেড়ে ওঠেননি। ফলে জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি সরে এসেছেন। শাপলা চত্বরে তার হাজির থাকা এবং মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শেষ করার কথা থাকলেও তিনি যাননি। অর্ধ পথ এসে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশের জনগণকে ফ্যাসিস্ট শক্তি, দিল্লির আগ্রাসন এবং পরাশক্তির আধিপত্য থেকে মুক্ত করবার জন্য জনগণের অতি প্রত্যাশিত মোনাজাতটি তিনি আল্লাহর দরবারে হাত তুলে জানাতে পারেননি।
আল্লামা আহমদ শফীর আধ্যাত্মিক জীবনের তুঙ্গ মুহূর্তে এটা ছিল, করুণ পিছু হটে আসা। এর পরের ঘটনা আমরা জানি। শাসনব্যবস্থা ও শাসক শ্রেণী অক্ষত রয়ে গেল, বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলো। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে সবাই বিস্মিত হয়ে দেখল আল্লামা আহমদ শফী তাদের কাছ থেকেই কওমি মাদরাসার সনদ নিচ্ছেন, যাদের গণবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই হেফাজতে ইসলাম গড়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষ এবং মাদরাসার তরুণ ছাত্ররা এই আপস মেনে নেয়নি। না মেনে নেয়াটা বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত ইতিবাচক।
আগামী দিনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখবে কি না বলা মুশকিল। কিন্তু তরুণ ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলামী আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা ও কর্মী এবং মাদরাসার তরুণ ছাত্রদের বড় একটি অংশ সামনের কাতারে চলে আসবে যারা জাতীয় রাজনীতির নির্ধারক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। ইসলামের ইতিহাসে রাজতন্ত্র এবং জালিম শাহীর সাথে আলেম ওলেমার হাত মেলানো এবং ইসলামকে জালিমদের হাতিয়ারে পরিণত করা নতুন কিছু নয়। সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ইসলামও বাংলাদেশে কম শক্তিশালী নয়। জনগণের সাথে বেঈমানি ও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসও দীর্ঘ। বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু নয়। জালিম শাহী ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বহাল রাখবার জন্য কুরআনের তাফসির এবং হাদিসের অপব্যাখ্যারও কমতি নাই। নানান কিসিমের মতবাদী ও মজহাবি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ধারাও কম নয়। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, যে ধারাটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে সেটা হলো জালিম ফ্যাসিস্ট শাসক এবং ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ধারা। তরুণ আলেমসমাজ এবং মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে ইসলামকে মানবেতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবার প্রেরণা হিশাবে ভাববার ঐতিহ্য ও চর্চা বেড়েছে। পাশ্চাত্যের গোলামির দিন দ্রুত বাংলাদেশে শেষ হয়ে যাচ্ছে কি? আগামি ইতিহাসই তা প্রমাণ করে ছাড়বে।
জীবনের শেষ মূহূর্তে এসে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম পদ থেকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াতে হলো; তিনি একই সাথে ছিলেন হেফাজতে ইসলামের আমীর। ফলে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের মধ্যেও পরিবর্তন অনিবার্য। ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে হাটহাজারী শূরার বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফী মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তার নিজের কক্ষেই সভা হয়েছিল।
মজলিসে শূরাকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। তারা আরো দুটো ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লামা শফীকে ‘সদরুল মুহতামিম’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তরুণ ছাত্রদের গুরুতর অসন্তোষ ও ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও মজলিসে শূরা এই বর্ষীয়ান আলেমের অমর্যাদা করেনি। দ্বিতীয়ত তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তাদেরই। কিন্তু আফসোস, আল্লামা শফী সবাইকে ছেড়ে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় তরুণ ছাত্রদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের তাৎপর্য অনেক ব্যাপক। পরস্পর বিপরীতমুখী নানান ধারা ও স্রোত অতিক্রম করে ধর্মকে জালিম শাহীর হাতিয়ার থেকে মুক্ত করে ইসলামকে গণমানুষের মুক্তি সনদ হিশাবে হাজির করবার কর্তব্যের কথাই তারা স্পষ্ট করে তুলছেন। সাধারণ মানুষের প্রাণে তা বিপুল আশার সঞ্চার করবে, সেটা পরিষ্কার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফীর নাম বারবারই উঠে আসবে। আমরা কেউই ভালোমন্দ বিচারের ঊর্র্ধ্বে নই। তাকে আবারো শ্রদ্ধা।