স্ত্রীর প্রতি জিন্নাহর ভালোবাসা
স্ত্রীর প্রতি জিন্নাহর ভালোবাসা - ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন সৌভাগ্যের বরপুত্র। তবে তাঁর ব্যক্তিজীবন ছিল ট্র্যাজেডির উপাখ্যান। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় সুনামের অধিকারী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর সাফল্য অহংকার করার মতো। মিস্টার জিন্নাহর রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যে কারোরই দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর যোগ্যতা ও সাফল্য সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ কম। জিন্নাহর পেশাগত ও রাজনৈতিক জীবন সাফল্যের সোনালি ফ্রেমে আবদ্ধ থাকলেও ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন ছিল ট্র্যাজেডিতে ভরা। মধ্যবয়সে নিজের চেয়ে ২৪ বছরের কম বয়সী বন্ধুকন্যার সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে তাঁকে বিয়ে করলেও সে বিয়ের জীবন সুখের হয়নি। তাঁর স্ত্রী রতনবাই বা লেডি রতি বিয়ের ১০ বছর ১০ মাস পর মারা যান। সে মৃত্যুর স্বাভাবিকতা নিয়ে সে সময় কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু জিন্নাহ ও লেডি রতি দুজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাঞ্জি দ্বারকাদাস বহু পরে পাকিস্তানি সাংবাদিকদের বলেন, লেডি রতির মৃত্যু হয়েছিল বেশ কয়েকটি ঘুমের বড়ি খাওয়ার কারণে। ২০১৮ সালে জিন্নাহ ও লেডি রতির বিয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে বিবিসির হিন্দি প্রতিবেদনেও এটি উল্লেখ করা হয়।
লেডি রতি মৃত্যুর আগে হতাশায় ভুগছিলেন এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। তিনি দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে অসুস্থও ছিলেন। কাঞ্জি দ্বারকাদাসের প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্য লেডি রতির মৃত্যুর স্বাভাবিকতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করলেও তিনিও তাঁর লেখায় স্ত্রীর প্রতি জিন্নাহর গভীর ভালোবাসার চিত্রই তুলে ধরেছেন। লেডি রতি আত্মহত্যা করলে তা সে সময়ের রাজনীতিতে যাঁরা জিন্নাহর প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁরা এটিকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিতেন। কিন্তু তা নেননি। এমনকি লেডি রতির বাবা স্যার দিনশাহ পেটিট কিংবা জিন্নাহ-কন্যা দিনা এ বিষয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেননি।
অবিভক্ত ভারতের সবচেয়ে ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে লেডি রতি প্রেমিক জিন্নাহকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন বাবা-মায়ের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে। জিন্নাহও রতিকে ভালোবাসতেন গভীরভাবে। প্রেমিকস্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিখাদ। কিন্তু ওই ভালোবাসায় ঘুণ ধরে অনিবার্যভাবে। জিন্নাহ আইন পেশা ও রাজনীতি নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে স্ত্রী ও সন্তানকে সময় দেওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বোম্বের বিশাল জিন্নাহ হাউসে লেডি রতির একাকী দিন কাটত সীমাহীন বিষণ্নতায়। ফলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি; যা শারীরিক অসুস্থতারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মিস্টার জিন্নাহ ও লেডি রতির সাড়া জাগানো রোমাঞ্চ এবং বিয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিবিসি হিন্দি সার্ভিসের জন্য প্রচারিত রেহান ফজলের প্রতিবেদনে লেডি রতির মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে হৃদয়স্পর্শী বর্ণনায়। এতে বলা হয়, মিস্টার জিন্নাহ সেদিন দিল্লিতে ওয়েস্টার্ন কোর্ট ভবনে ছিলেন। তখনই একটা ট্রাঙ্ক কল আসে তাঁর কাছে। ফোনের অন্য প্রান্তে ছিলেন শ্বশুর দিনশাহ পেটিট। ১০ বছরের মধ্যে সেই প্রথমবার দুজনের কথা হয়। মেয়ে যে খুব অসুস্থ, সে খবরটা জিন্নাহকে জানান মিস্টার দিনশাহ। সঙ্গে সঙ্গেই জিন্নাহ ট্রেনে করে মুম্বাইয়ে রওনা হন। পথেই ভাইসরয় আর অন্য মান্যগণ্যদের শোক জ্ঞাপন করা টেলিগ্রাম আসতে থাকে। জিন্নাহ বুঝতে পারেন, রতি আর এ পৃথিবীতে নেই। স্টেশন থেকে সোজা কবরস্থানে যান তিনি। সেখানে তাঁর জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল।
সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসেবে যখন অনুরোধ করা হলো কবরে মাটি দিতে তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন জিন্নাহ। সেই প্রথম আর শেষবার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জনসমক্ষে নিজের ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশ করতে দেখা গেল। রতনবাই মৃত্যুর সময় রেখে যান একমাত্র কন্যা দিনাকে। তাঁর বয়স তখন মাত্র সাড়ে নয় বছর। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে জিন্নাহ কতটা শোকাহত ছিলেন তা উভয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাঞ্জি দ্বারকাদাসের লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর আগের দিনগুলোয় রতিকে দ্বারকাদাস সময় দিয়েছেন অকৃপণভাবে। তাঁর হতাশা কাটানোর চেষ্টাও করেছেন সুবন্ধু হিসেবে। কিন্তু অসম্ভব জেদি লেডি রতির মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেননি তিনি।
লেডি রতির মৃত্যুর পরদিন কাঞ্জি দ্বারকাদাস যান জিন্নাহ হাউসে। বিশাল এ ভবনে তাঁর ছিল অবাধ প্রবেশাধিকার। তিনি জিন্নাহর শয়নকক্ষেও যান। দেখেন জিন্নাহ ওয়ার্ডরোব থেকে লেডি রতির কাপড়-চোপড় বের করে সেগুলো ঘরের মধ্যে সাজিয়েছেন খেয়ালিপনার সঙ্গে। স্ত্রীর পোশাকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন এক দৃষ্টিতে। দ্বারকাদাসের ভাষ্য, এ সময় জিন্নাহর দুই চোখে ছিল অশ্রু।
আইনজীবী ও রাজনীতিক জিন্নাহকে কঠিন হৃদয়ের মানুষ হিসেবে ভাবা হতো। তাঁর চোখে এমন অশ্রু ছিল সত্যিকার অর্থেই বেমানান। কিন্তু আবেগহীন জিন্নাহ রতিকে যে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এ ছিল তারই উদাহরণ।
১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ২৯ বছর বয়সে রতি মারা যান। জিন্নাহর বয়স তখন ৫৩। মুসলিম লীগের শীর্ষনেতা ও উপমহাদেশের সবচেয়ে দাপুটে আইনজীবী তাঁর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বিপাকে পড়েন। এ সময় ভাইয়ের পাশে দাঁড়ান জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ। বলা যায়, পরের এক দশক দিনার মায়ের অভাব বুঝতে দেননি এই মহীয়সী নারী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরা ছিলেন সাত ভাইবোন। অন্য ছয় ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা জিন্নাহ ছিলেন ব্যাপকভাবে পরিচিত। ডেন্টাল সার্জন ফাতিমা জিন্নাহ ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় নারীকর্মী। সুন্দরী বিদুষী এ বোনটিকে জিন্নাহ বেশ পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন চিরকুমারী। জিন্নাহর একমাত্র মেয়ে দিনাকে তাঁর নানি মিসেস দিনশাহ পেটিটও সময় দিয়েছেন উদারভাবে। জিন্নাহকে বিয়ের কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে লেডি রতির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও রতিকন্যা দিনার ব্যাপারে তাঁদের স্নেহ ছিল অফুরন্ত।