রাইস ব্রান অয়েলের অমিত সম্ভাবনা
রাইস ব্রান অয়েলের সম্ভাবনা - প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। আমাদের খাদ্যশক্তির ৭০ ভাগই আসে ভাত থেকে। এফএও’র রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে বিশেষ করে ধানের চাহিদায় স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু নয় বরং উদ্বৃত্ত অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টন ধান উৎপাদন হয় (সূত্র : কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৭-১৮)। এই উৎপাদিত ধানের একটি বাই-প্রডাক্ট হলো ব্রান বা কুঁড়া। কুঁড়া হলো ধানের হাস্ক বা তুষের নিচে ও চালের উপরে বাদামি রঙের আবরণ, যা ধানের ৮-১০ ভাগ। কুঁড়ায় প্রধান খাদ্য উপাদান যেমন- প্রোটিন ১৬-১৮ ভাগ, ফ্যাট ২২-২৭ ভাগ, কার্বোহাইড্রেট ৪৫-৫৫ ভাগ, ফাইবার ৭-১০ ভাগ এবং গৌণ উপাদানের মধ্যে ভিটামিন ও মিনারেল পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে কিন্তু কোলেস্টেরল নেই। এই ধানের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদন করা যায় বা কুঁড়ায় তেল আছে তা আমাদের দেশের মানুষের ধারণায় ছিল না। ফলে ধান ভাঙানোর সময় তুষ ও কুঁড়া আলাদা করা হতো না। এই কুঁড়া সাধারণত গৃহপালিত পশু বা হাঁস-মুরগির খাবার হিসেবে এবং রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তৎকালীন সময়ে ঢেঁকি বা এঙ্গেলবার হালার দ্বারা ধান থেকে চাল তৈরি করা হতো।
আমাদের দেশে বর্তমানে গড়ে মাথাপিছু দৈনিক ২৬.৬৭ গ্রাম বা বছরে ৯.৭ কেজি ভোজ্যতেল খাওয়া হচ্ছে যা ভারত (১৪ কেজি/বছর) বা পাকিস্তানের (১৩.৯২ কেজি/বছর) তুলনায় অনেক কম। এই হারে বছরে আমাদের ভোজ্যতেলের প্রয়োজন প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে বছরে ২.১৯ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্য তেল উৎপাদিত হয়, বাকি ১৩.৪৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে হয়, যা থেকে ১২.৯০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত তেলের মাধ্যমে আমাদের বার্ষিক চাহিদা মেটানো হয়।
বাংলাদেশে ২০২১ সালের মধ্যে মাথাপিছু ভোজ্যতেলের চাহিদার পরিমাণ ধরা হয়েছে বছরে ১৪.৬ কেজি (সূত্র : Bangladesh journal of tariff and trade, 2015)। তেলের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানোর জন্য চালের কুঁড়া থেকে উৎপাদিত তেল একটি মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে যদি গতানুগতিক হাস্কিং মিলগুলোকে সেমি অটো বা অটো মিলে পরিণত করা যায়। তবে ২০২১ সালের মধ্যেই প্রয়োজনীয় ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে পূরণের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমানো সম্ভব হবে। গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক শ’ অটো এবং সেমি অটো রাইস মিল স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৫ সালের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, ৫০০ অটো ও সেমি অটো রাইসমিলসহ প্রায় ১৭ হাজার হাস্কিং মিল বাংলাদেশে রয়েছে। যদি সব ধানই (পাঁচ কোটি টন) অটো বা সেমি অটো মিলে ভাঙানো যেত তবে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ টন ব্রান (৮ ভাগ ব্রান হিসেবে) এবং এই ব্রান থেকে আট লাখ টন তেল (২০ ভাগ তেল হিসেবে) উৎপাদন করা যেত।
মিলার্র্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদিত ধানের ৬০ ভাগ অর্থাৎ তিন কোটি টন ধান মিলে ভাঙানো হয়, যা থেকে প্রায় ২৪ লাখ টন ব্রান পাওয়া যায় এবং এ থেকে ৪.৮ লাখ টন তেল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশের উৎপাদিত ব্রানের ২৫ ভাগ তেলের মিলে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের রাইস মিলে ২৫ লাখ টন ব্রান উৎপাদন হয়, যার পাঁচ লাখ টন ব্রান মাত্র ভোজ্যতেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। বিটিসির মতে, প্রচুর ব্রান বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে। শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের ২০১৮-১৯ সালের জরিপ থেকে দেখা যায়, ফিড মিলে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার তৈরিতে প্রচুর রাইস ব্রান সরাসরি ব্যবহার করা হয়। কারণ হিসেবে জানা গেছে, রাইস ব্রানে মুখ্য খাদ্য উপাদান (শর্করা, চর্বি, আমিষ) প্রচুর পরিমাণে আছে। রাইসমিল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক আবদুর রশিদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫টি রাইস ব্রান অয়েল (আরবিও) মিল আছে, যেগুলোর দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাত হাজার টন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই মিলগুলো থেকে দৈনিক ৫০০ টনেরও কম তেল উৎপন্ন হচ্ছে (সূত্র : নিউ নেশন ৪ নভেম্বর ২০১৫)। বিটিসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মিলগুলোকে চালু রাখতে হলে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টন ব্রান প্রয়োজন। কিন্তু পাশের দেশে রফতানি এবং ফিড ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার জন্য তা সম্ভব হয় না। অর্থবছর ২০১৭-১৮ এ শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের জরিপ থেকে দেখা গেছে, আরবিও মিলগুলোতে ব্রান সরবরাহের স্বল্পতার কারণে বছরে প্রায় তিন থেকে চার মাস উৎপাদন বন্ধ থাকে। আরবিও ইন্ডাস্ট্র্রিগুলোর ব্রান সংগ্রহের নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় ব্রোকার বা এজেন্টের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
সাধারণত ফ্রেশ ব্রানে ৩ থেকে ৬ ভাগ ফ্রি ফ্যাটি এসিড (এফএফএ) থাকে, কিন্তু সরবরাহকৃত ব্রানে এর পরিমাণ ১০ থেকে ১৩ ভাগ, কখনো কখনো আরো বেশি হয়। মিলাররা ফ্রেশ ব্রান সংগ্রহের বেলায়ও কৃত্রিম সঙ্কটের কারণে এবং অপরিকল্পিতভাবে ব্রান পাশের দেশে রফতানির কারণেও মাঝে মাঝে সমস্যার সম্মুখীন হয়। ব্রানের প্রাপ্যতার চেয়ে ব্রান সরবরাহের পদ্ধতিটি এখনো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে এক ট্রাক ব্রান (১৫ টন) সংগ্রহ করতে প্রায় তিন থেকে পাঁচ দিন এবং কখনো আরো বেশি সময় লাগে; ফলে ব্রানের গুণগত মানও খারাপ হতে থাকে। এত সব সমস্যার মধ্যেও এক দশক আগে যে উৎপাদন খাতটির যাত্রা শুরু হয়েছে তা বর্তমানে প্রায় এক ডজন দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্রান অয়েল রফতানি করছে। উদাহরণস্বরূপ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫১৫ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৫ হাজার ৩৭১ টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ হাজার ৪৬৪ টন রফতানি করা হয়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে (সূত্র : এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো)।
কিছু কিছু কারণে সংগৃহীত ব্রানের গুণগতমান খারাপ হয়, যেমন- ইমপ্রপার হেন্ডেলিং, লেক অফ স্টোরেজ, তুষের সংমিশ্রণ এবং লাইপেজ এনজাইমের ক্রিয়ার ফলে এফএফএ বেড়ে যাওয়া (+৬ ভাগ)। লাইপেজ এনজাইমের ক্রিয়ার মাধ্যমে ট্রাই এসাইল গ্লিসারলের জলীয় বিয়োজনের ফলে এফএফএ তৈরি হয় এবং ব্রানের স্থায়িত্বকাল কমে যায় এমনকি দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। লাইপেজ এনজাইমের ক্রিয়ার ফলে দৈনিক ১০ থেকে ১২ ভাগ এমনকি মাসে ৮০ ভাগ পর্যন্ত এফএফএ তৈরি হয়। এফএফএ’র পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে ব্রানে তেলের পরিমাণ কমতে থাকে। এনজাইম লাইপেজের ক্রিয়া স্থগিতের মাধ্যমে ব্রানের গুণগত মান ভালো রাখা যায় যা ব্রির শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের ২০১৭-১৮ সালের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, আনট্রিটেড ব্রান রুম তাপমাত্রায় রেখে দিলে এফএফএ’র পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে এবং সেই সাথে ব্রানে তেলের পরিমাণ কমতে থাকে। ভৌত তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ২৮ দিন পর্যন্ত ব্রানে এফএফএ’র পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে না এবং ব্রানে তেলের পরিমাণও কমে না। আমাদের সমীক্ষার ফলাফল থেকে আরো দেখা গেছে, আতপ চালের কুঁড়ার চেয়ে সিদ্ধ চালের কুঁড়ায় তেলের পরিমাণ বেশি এবং এফএফএ’র পরিমাণ কম থাকে। এমনকি কুঁড়ায় তেলের মাত্রা ধানের জাত ভেদে ভিন্ন হয় (সূত্র : Post harvest loss minimization of rice bran for quality rice bran oil, ব্রি প্রকাশনা নং-২৬১, ২০১৮ খ্রি.)। উদাহরণস্বরূপ তেলের পরিমাণ বিআর ১৬ এ ১৮.৪ ভাগ এবং ব্রি ধান ২৮ এ ২৫.৬ ভাগ (গবেষণালব্ধ ফলাফল)।
তেলের গুণগত মান নির্ণায়কের মধ্যে এসিড ভ্যালু, এফএফএ, পার-অক্সাইড ভ্যালু, আয়োডিন ভ্যালু ইত্যাদি হিটট্রিটেড ব্রানের তুলনায় আনট্রিটেড ব্রানে বেশি থাকে বিধায় তেলের গুণগতমান খারাপ হয়ে যায়। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, হিটট্রিটেড ব্রান থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো মানের তেল পাওয়া সম্ভব। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ব্যালান্সড ফ্যাটে প্রায় সেচুরেটেড ফ্যাট ৩০ ভাগ, মনো-আনসেচুরেটেড ফ্যাট ৩৭ ভাগ এবং পলি-আনসেচুরেটেড ফ্যাট ৩৩ ভাগ থাকবে যা আমাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের কাছাকাছি। তাই অন্যান্য ভোজ্যতেলের তুলনায় আরবিও’র গুণগতমান ভালো।
পুষ্টিমানের দিক থেকেও আরবিও অনেক সমৃদ্ধ। কারণ এতে গামাওরাইজানল (দুই হাজার পিপিএম) নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা অন্যকোনো ভোজ্যতেলে নেই। তা ছাড়া এতে এন্টি অক্সিডেন্ট যেমন- টকোট্রাইনল ও টোকোফেরল অন্যান্য তেলের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। অর্থবছর ২০১৮-১৯ এর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যায়, পরিশোধিত ব্রান অয়েলে ক্ষতিকর আফলা টক্সিন নেই এমনকি হেভি মেটাল যেমন- আর্সেনিক, লেড, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম বা নিকেলের মাত্রা অতি নগণ্য (সূত্র : Detection and quantification of heavy metals and toxins in rice bran related products, ব্রি প্রকাশনা নং-২৭৮, ২০১৯ খ্রি.)। উচ্চ স্মোকিং পয়েন্ট (২৫৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) থাকায় আরবিও-কে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না যেমন- ডিপ ফ্রাইং ও স্টাইর ফ্রাইংয়ে ব্যবহার করা যায়।
নিউ ইয়র্কের রোচেস্টার ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, আরবিও’র এন্টি-অক্সিডেন্টগুলো কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে শরীরের ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায়, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই এককথায় বলা যায়, রাইস ব্রান অয়েল নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর।
সুতরাং মাত্র এক দশক আগে যে ভোজ্যতেলটি বাংলাদেশের বাজারে এসেছে তার অনেক পুষ্টিগুণ থাকা সত্ত্বেও গ্রামগঞ্জে এখনো জনপ্রিয় হয়নি। একে জনপ্রিয় করতে হলে এর পক্ষে প্রচার চালানোসহ আরবিও ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে পর্যাপ্ত ব্রান সরবরাহের ব্যবস্থা এবং ব্রান প্রাপ্তি সহজলভ্য হতে হবে। ব্রানে তেলের গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখতে হলে অবশ্যই ভৌত তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে এনজাইমের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। রাইস ব্রান আমদানি ও রফতানি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বত্র আধুনিক চালের অটো মিল স্থাপনের মাধ্যমে এই শিল্পের উদ্যোক্তারা এ দেশের ভোজ্যতেলের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করতে সক্ষম হবেন।
লেখক : ড. মো: আনোয়ারুল হক, প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার, ড. নিলুফা ফেরদৌস ও ড. হাবীবুল বারী সজিব সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার, শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর