বিরোধী দলে 'যদি লাইগা যায়?
বিরোধী দলে 'যদি লাইগা যায়? - প্রতীকী ছবি
‘বাণিজ্য’ পৃথিবীর একটি আদি পেশা, এ বাণিজ্যের কারণেই পৃথিবীতে ইতঃপূর্বে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র দখল করে নিয়েছে। তবে এখন বাণিজ্যের কারণে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে দখল করার পরিবর্তে পণ্যের বাজার অর্থাৎ অর্থনৈতিক বাজার দখল করে নিচ্ছে। এ অর্থনৈতিক বাজার দখল করতে বৈধ/অবৈধ পণ্যের কোনো তফাৎ নেই। কারণ বিশ্বে বড় রাষ্ট্রগুলো নিজেরাও অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় জড়িত এবং এ জন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে।
সম্প্রতি বাণিজ্যের সাথে কিছু শব্দ যোগ হয়েছে। যেমন- সরকারি দলের টেন্ডার বাণিজ্য, আমলাদের ঘুষ বাণিজ্য, রাজনীতিবিদদের কমিটি বাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত হয়েছে নমিনেশন বাণিজ্য, যা স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুরু হলেও এখন প্রকট আকার ধারণ করে চায়ের দোকানে আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছে।
রাজনীতিতে তিনটি শব্দ খুবই জোরেশোরে প্রবেশ করেছে, যথা- ১. সুবিধাবাদী; ২. সুবিধাভোগী ও ৩. সুযোগসন্ধানী। এই তিনটি শ্রেণী রাজনৈতিক ‘মালাই’ (দুধের সর) খাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধহস্ত বিধায় তৃণমূল এখন হতাশায়, ফলে শত চেষ্টা করেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জন্য মাঠ গরম হচ্ছে না। প্রবাদ রয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের ‘মালাই’ খাওয়ার ‘মজনু’ এবং ‘রক্ত’ দেয়ার ‘মজনু’ এক নয় (‘মজনু’ বলতে এখানে দলপ্রেমিককে বোঝানো হয়েছে)। অর্থাৎ একশ্রেণীর রাজনীতিক রয়েছেন যারা সুসময়ে দলের সম্মুখভাগে থাকেন, অন্য একশ্রেণী রয়েছে যারা দলের দুঃসময়ে দলকে আষ্টেপৃষ্ঠে বুকে ধারণ করে দলের জন্য যেকোনো ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে তৃণমূল হারিয়ে যায় অতল গহ্বরে যার কারণে ঘুরে ফিরে বাণিজ্যের কথাটিই উঠে আসে। ‘বাণিজ্যের’ বিষয়টি হতে পারে প্রচার বা অপপ্রচার, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে জনগণ যা বিশ্বাস করে, তা-ই বেদবাক্য হিসেবে পরিণত হয় এবং জনগণের মনের ভেতরে জন্ম নেয়া বিশ্বাস থেকেই দল ও রাজনীতিকের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতে যা ঘটে তা অনেকাংশেই প্রচার বা অপপ্রচার, বিভ্রান্তিমূলক যা-ই হোক না কেন, প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনেই কিছু না কিছু রহস্য প্রকাশিত হয়, যা থেকে জনগণকে সরানো যায় না।
সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী এবং সুযোগসন্ধানী চক্র সবসময়ই ওঁৎ পেতে থাকে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারার জন্য। কোনো কমিটি গঠন বা নির্বাচনের নমিনেশনের সময় তাদের সাজ সাজ রবে দেখা যায়, কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের টিকিটিও দেখা যায় না। অথচ কোনো না কোনো কারণে মূল্যায়নের প্রশ্নে রাজপথের নেতাকর্মীদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদী চক্র এবং এতে শীর্ষ নেতাদের আশকারা থাকে। এটাই জাতীয় রাজনীতির ট্র্যাজেডি।
সরকারি দলসহ সবাই এখন স্বীকার করে, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসা দরকার। শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক বলেই ফেলেছেন, ‘কাউয়ার’ জন্য পার্টি অফিসে যাওয়া যায় না। সে দলে ‘কাউয়ার’ অভাব হয় না, কারণ সেখানে হালুয়া রুটির খনি রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলে কমিটি ও নমিনেশনের জন্য কেন অনেকে এত পাগলপারা? এর পেছনের কারণ হলো ‘যদি লাইগা যায়’। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে তো অনেকেই নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের সন্ধানে থাকে, কিন্তু এদের দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাজনীতির অপর নাম আন্দোলন-সংগ্রাম। অথচ কমিটি ও নমিনেশন শিকারের জন্য তারা যত ব্যতিব্যস্ত থাকে, দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে তো তৎপরতা থাকেই না বরং সরকারি দলের আঁতাতের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী বা নমিনেশন শিকারীদের প্রশ্রয় দেয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও দায়ী। এ ক্ষেত্রে নমিনেশন শিকারীরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ধার ধারে না নগ্নভাবে। অন্য দল থেকে আগের দিন দলে যোগদান করে পরের দিন নমিনেশন, এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিষফোঁড়ার মতো। তারা নমিনেশন না পেলে হয় পদত্যাগ, নতুবা ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। এ অবস্থায় যখন জাতীয় রাজনীতি চলে সেখানে তৃণমূলে হতাশা জন্ম দেয়। এ হত্যাশা একটি দলকে কোথায় নিয়ে যায়, তা বিরোধী দলে এসে ভুক্তভোগী দলই অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু সংশোধনের উপলব্ধি হয়েছে কি না, তা আঁচ করা যাচ্ছে না। কারণ তৃণমূলকে বঞ্চিত করে জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের ঘটনাবলি অহরহ ঘটছে।
একটি রাজনৈতিক দলের ফাউন্ডেশন হচ্ছে তার নীতি ও আদর্শ, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, বরং সাধারণ সদস্য থেকে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত স্বচ্ছ অনুশীলনের মাধ্যমে নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তবে এ অনুশীলন নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে শুরু করলে তৃণমূলে স্বাভাবিক গতিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুবা জাতীয় নেতাদের মঞ্চের বক্তৃতা ও ব্যক্তি চরিত্রে যখন সামঞ্জস্য থাকে না তখনই দেখা দেয় মনস্তাত্বিক কমিউনিকেশন (Mental Commuication) গ্যাপ। ফলে একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হয় যে, নেতারা গলা ফাটিয়ে ডাক দিলেও কর্মীরা রাজপথের আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়। একটি দলের নীতি ও আদর্শ কর্মীদের মন, মগজ ও রক্তে মিশিয়ে দিতে হবে। এমনও দেখা গেছে, ছয় দফা বা ১৯ দফা কী তা বলতে পারে না এমন লোকও সংশ্লিষ্ট সেই দলের এমপি/মন্ত্রী হয়েছেন, দল নিয়ন্ত্রণ করছেন। একটি দল সময়ে সময়ে ক্র্যাকডাউন হওয়ার এটাও অনেক কারণের একটি।
একটি দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন চাটুকারের অভাব হয় না, বুদ্ধিজীবীরা রং পাল্টিয়ে আজব আজব কথা বলতে শুরু করেন, দলীয় প্রধানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন এবং বিভিন্ন কারণে দলীয় রাজনীতির পরিবর্তে প্রশাসনিক কাঠামোভিত্তিক কর্মকাণ্ডই বেশি হয়ে থাকে। দল তখন কর্মীনির্ভর না হয়ে প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়ে। কিন্তু বিরোধী দলে থাকাকালেই দল গোছানোসহ দলকে নীতি আদর্শভিত্তিক গড়ে তুলতে হয়। দলটি বিরোধী দলে থাকাকালে চাটুকাররা দূরে সরে গেলেও ওঁৎ পেতে থাকে কখন কাকে ল্যাং মেরে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা যায়।
একটি রাষ্ট্র যুদ্ধে যাওয়ার আগে তার সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে হবে, যারা হবে ঈমানদার এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর অভ্যাস নেই যাদের। আন্দোলনে যাওয়ার আগে একটি রাজনৈতিক দলকে তার কর্মীবাহিনী বাছাই করতে হবে। সে কর্মীবাহিনী হতে হবে পরীক্ষিত যারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাবে না, শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল থাকবে। অন্য দিকে, পরীক্ষিত কর্মী বাছাইয়ে সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানীকে চিহ্নিত করতে না পারাটাই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের চরম ব্যর্থতা।
দলীয় নমিনেশন নির্ধারণে একটি নীতিমালা থাকা দরকার। কারা নমিনেশন চাইতে পারে বা নমিনেশন পাওয়ার যোগ্য তার মাপকাঠি কী হবে তা-ও নির্ধারিত হওয়া দরকার। নমিনেশন পেপার নীতিমালার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই হওয়া প্রয়োজন। নতুবা দলের আদর্শে বিশ্বাস করে না, দলের দুঃসময়ে কোনো ভূমিকা নেই এমন লোকও নমিনেশনের সময় ‘শক্তিশালী বাঘ’ হয়ে দাঁড়ায়। যে কেউ দলের নমিনেশনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় নমিনেশন চাওয়াকে রেলস্টেশনে ‘বাবু একটি টিকিট’ চাওয়ার মতোই মনে করে। নমিনেশন পাওয়া না পাওয়ার বিষয়ে দল বহির্ভূত লোকরাই বিভিন্ন অপবাদে দলকে অভিযুক্ত করে, নমিনেশন না পেলে সটকে পড়ে।
এক শ্রেণীর রাজনীতিক রয়েছেন যারা নমিনেশন পাওয়ার জন্য ভিন্ন দলের সাথে ‘তলখাতির’ করেন। কোরবানির হাটের মতো, এক হাটে বিক্রি না হলে অন্য হাটে তো বিক্রি হবেই। টার্গেট শুধু ভালো মূল্য পাওয়া, অর্থাৎ নমিনেশনই মূল লক্ষ্য। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে সংগঠনে তদবির বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। ঝুঁকি নিতে পারে, দৃঢ়চিত্তে রাজনীতিকে ধারণ করতে পারে, এমন কর্মীকে সাংগঠনিক কাঠামোতে যথাযথ দায়িত্ব অর্পণ করলে দলীয় রাজনীতি জনগণের কাছে মূল্যায়িত হবে এবং রেজাল্ট জমা হবে দলের অ্যাকাউন্টে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com