মোতোয়ালির ৫ গুণ ও ৬ দায়িত্ব
মসজিদ - মোতোয়ালির ৫ গুণ ও ৬ দায়িত্ব
দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার ঘর হলো মসজিদসমূহ। পৃথিবীতে যে ঘর সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছে তা বাক্কা (মক্কা) নগরীতে অবস্থিত। পবিত্র কুরআনুল কারিমের বর্ণনায় দেখা যায়, আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়াত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভিতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। ( সূরা আল-ইমরান ৯৬ ও ৯৭)
পৃথিবীর সর্বপ্রথম যে মসজিদ নির্মিত হয় : হজরত আবু যার আল-গিফারী রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মাসজিদুল হারাম। রাবি বলেন, আমি আবার বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বলেন, তারপর মাসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বলেন। চল্লিশ বছরের। এখন তোমার জন্য সমগ্র পৃথিবীই মসজিদ। অতএব যেখানেই তোমার সালাতের ওয়াক্ত হয়, সেখানেই তুমি সালাত আদায় করতে পারো। (ইবনে মাজাহ ৭৫৩ )
মসজিদ নির্মাণকারীদের গুণাবলি
পৃথিবীতে মানুষ নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিভিন্ন ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। মুসলমানরা আল্লাহর ইবাদাতের জন্য পাড়া-মহল্লায়, শহর-বন্দরে, অফিস-আদালতে মসজিদও নির্মাণ করে থাকে। তবে যারা মসজিদ নির্মাণ করবে তাদের নিকট এমন কতিপয় গুণাবলি থাকতে হয়, যা অন্যান্য ক্ষেত্রে না থাকলেও চলে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ (নির্মাণ) করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর ও পরকালের প্রতি এবং কায়েম করেছে সালাত ও আদায় করেছে জাকাত এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। অতএব, আশা করা যায়, তারা হেদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা আত-তাওবাহ ১৮)
উপরোক্ত আয়াতের পরিপেক্ষিতে বলা যায়, মসজিদ পরিচালনা কমিটি বা মোতোয়ালির মাঝে কমপক্ষে পাঁচটি গুণ থাকতে হবে।
১. আল্লাহর প্রতি ঈমান থাকা ২. পরকালের প্রতি ঈমান থাকা ৩. সালাত কায়েম করা ৪. জাকাত আদায় করা ৫. আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় না করা।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণের ফজিলত : মসজিদ নির্মাণ করা হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। হজরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ নামের জিকিরের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ তৈরি করেন। (ইবনে মাজাহ ৭৩৫)
পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করার নির্দেশ : হজরত আয়িশাহ্ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করার এবং তা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ ৪৫৫)
আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় স্থান : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো মসজিদসমূহ আর সবচেয়ে খারাপ জায়গা হলো বাজারসমূহ। ( সহিহ মুসলিম ১৪১৪)
মসজিদ কমিটির করণীয় : মসজিদ পরিচালনা কমিটির কিছু উল্লেখযোগ্য করণীয় রয়েছে। যা পালনে অবহলা করলে দুনিয়াবি নানা ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে আর পরকালে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে।
১. ওয়াকফ্কৃত জায়গায় মসজিদ স্থাপন করা : ব্যক্তি মালিকানাধীন বা সরকারি জায়গায় মসজিদ স্থাপন না করে ওয়াকফ্কৃত স্থানে মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। মসজিদের সম্পূর্ণ জায়গা বিনা শর্তে ওয়াক্ফ করা (লিখিত আকারে) থাকতে হবে। যাতে পরবর্তীতে কেউ ওই জায়গার মালিকানা দাবি করতে না পারে।
২. মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা : মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রয়োজনে প্রত্যেক নামাজের আগে ধৌত করা বা ঝাড়ু দেয়ার ব্যবস্থা করা। হজরত আবু সাঈদ আল-খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে ময়লা দূর করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। (ইবনে মাজাহ ৭৫৭)
৩. মসজিদে বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করা : নাবী সা:-এর মুক্ত দাসী মায়মুনাহ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! বায়তুল মাকদিস (মসজিদুল আকসা) সম্পর্কে আমাদের জন্য আপনার অভিমত কী? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তোমরা সেখানে গিয়ে সালাত আদায় করতে পারো। ওই সময় শহরটি শত্রুদের দখলে ছিল। সেজন্য রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তোমরা সেখানে গিয়ে সালাত আদায় করতে না পারলে সেখানে বাতি জ্বালানোর জন্য তেল পাঠিয়ে দিও। (আবু দাউদ ৪৫৭)
৪. মসজিদে থুথু না ফেলার ব্যবস্থা করা : মসজিদে থুথু নিক্ষেপ করা পাপের কাজ। হজরত আনাস ইবনু মালিক রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, মসজিদের মধ্যে থুথু ফেলা পাপের কাজ। আর ওই থুথু মাটিতে পুঁতে দেয়াই এর কাফফারাহ্। (সহিহ মুসলিম ১১১৮ )
৫. মসজিদকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা : হজরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, যে এ রসুনজাতীয় উদ্ভিদ খাবে, কোনো কোনো সময় আবার তিনি বলেছেন : যে ব্যক্তি পেঁয়াজ, রসুন বা মুলা খাবে সে যেন আমার মাসজিদের কাছেও না আসে। কেননা মানুষ যেসব জিনিস দ্বারা কষ্ট পায় মালাকগণও (ফেরেশতাগণ) সেসব জিনিস দ্বারা কষ্ট পায়। (সহিহ মুসলিম ১১৪১)
৬. মসজিদে প্রবেশের দোয়ার ব্যবস্থা করা : মসজিদে প্রবেশের সময় দোয়া পাঠ করা সুন্নত। এ দোয়াটি যাতে মুসল্লিরা প্রবেশের সময় পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করা। হজরত ফাতিমাহ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: মসজিদে প্রবেশকালে বলতেন, আল্লাহর নামে (প্রবেশ) এবং আল্লাহর রাসূলকে সালাম। হে আল্লাহ! আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দিন। (ইবনে মাজাহ ৭৭১)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করার এবং মোতোয়ালি হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : খতিব, ইসলামিয়া হাট জামে মসজিদ, উত্তর পতেঙ্গা ও সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ, সিইপিজেড, চট্টগ্রাম