গরু জবাই নিষিদ্ধ করায় ভারতের ক্ষতি
ভারতীয় গরু - ছবি সংগৃহীত
ভারতে গরুর সুরক্ষা ও জবাইবিরোধী ভাবাবেগ উত্তপ্ত একটি রাজনৈতিক ইস্যু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী গরু সুরক্ষা ও গরুর গোশত পরিহার করাকে তার এজেন্ডার অংশে পরিণত করেছিলেন। ১৯৫০ সালে পাস হওয়া ভারতীয় সংবিধান গরুর সুরক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়।
অবশ্য সেক্যুলার কংগ্রেস সরকার ভারতে ওই আইন কঠোরভাবে পালন করেনি। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো অবশ্য বিক্ষোভ করেছিল। বেশ কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ হয় বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ক্ষমতায় এলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। তারা ২০১৭ সালে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে।জবাই করার জন্য গরু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সন্দেহে মুসলিমদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এমনকি ফ্রিজে গরুর গোশত রাখা সন্দেহে বা বহন করার সন্দেহেও পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা দেখা যায়।
নিষিদ্ধ করা সমস্যার কারণ
অবশ্য ভারতে গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আর তা শ্রীলঙ্কায় গরু জবাই নিষিদ্ধ করার সাথে প্রাসঙ্গিকক।
জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. বিকাশ রাওয়াল ২০৭ সালে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, গরুর ওপর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হলে ভারতকে প্রতিরক্ষা বাজেটের ১.৫ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করত হবে গরুর যত্নে। অনুৎপাদনশীল গরুর জন্য ভারতকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে অতিরিক্ত ২৭০ মিলিয়ন ডলার।
তিনি বলেছিলেন, এই দেশে প্রতি বছর ৩৪ মিলিয়ন ছেলে বাছুর জন্ম নেয়। যদি ধরে নেয়া হয়, এসব গরু আট বছর বাঁচে, এটা সবচেয়ে কম হিসাব, তবে আট বছর শেষে অনুৎপাদনশীল গরুর সংখ্যা বাড়বে ২৭০ মিলিয়ন।
রাওয়ালের হিসাব অনুযায়ী, এর ফলে গরু পালনের বাজেট ৩৫ গুণ বেড়ে যাবে।গরুকে কেবল খাওয়ালেই চলবে না, সে যাতে ঘুরে না বেড়ায়, ফসল খেয়ে না ফেলে, তার জন্যও ব্যয় করতে হবে। তাছাড়া এসব গরুর আশ্রয়ের জন্য ৫ লাখ একর জমির প্রয়োজন হবে।এসব গরুর খাদ্য হিসেবে দিতে হবে সাত মিলিয়ন টন খাবার।এত খাদ্য উৎপাদনের মতো ভূমি ভারতে নেই।আর প্রতিটি প্রাণি যদি এক বালতি করে পানি পান করে, তবে মানুষের চেয়ে বেশি পানির প্রয়োজন হবে এসব প্রাণীর।
আবার গরিব ভারতীয় চাষীরা এসব অনুৎপাদনশীল পশুর ব্যয়ভার বহন করতে পারবে না। ফলে এসব গরুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারকেই বিলিয়ন বিলিয়ন রুপি ব্যয় করতে হবে। আবার অনুৎপাদনশীল গরু যদি সরকার পালন না করে এবং দুগ্ধ উৎপাদনকারীদেরই পুষতে হয়, তবে খামারিরা ডায়েরি ফার্ম প্রতিষ্ঠা এড়িয়ে যাবে।আর তাতে করে দুধের উৎপাদন কমে যাবে। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে সৃষ্টি হবে মারাত্মক সমস্যা।
রাওয়াল বলেন, ভারতে এখনই এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। ভারতে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা ৬২ মিলিয়ন। বিশ্বের প্রতিবন্ধী শিশুর এক তৃতীয়াংশই আছে ভারতে।
নিষেধাজ্ঞার আরো বড় অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে মাত্র ৩০ ভাগ গরু গোশতের জন্য জবাই করা হয় (স্থানীয়ভাবে খাওয়া কিংবা রফতানি)।৭০ ভাগ মরা গরু বিভিন্ন শিল্পে চলে যায়। জবাই করা গরুর হাড় ও চামড়া বিভিন্ন শিল্পপণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো চামড়াজাত পণ্য ছাড়াও টুথপেস্ট, বোতাম, পেইন্ট ব্রাশ, সার্জিক্যাল স্ট্রিটচ, মিউজিক্যাল ইন্ট্রুমেন্ট ইত্যাদি শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৪-১৫ সময়কালে ভারত ৬৫টি দেশে ভারত ২.৪ মিলিয়ন টন মহিষের গোশত রফতানি করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের মোট রফতানির ২৩.৪ ভাগ ছিল ভারতের। আর যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দফতর জানিয়েছে, ভারতের গরু/মহিষের গোশত শিল্পের রফতানির মূল্য ৪ বিলিয়ন ডলার।