ইসলামের দৃষ্টিতে ৬টি দিকে তাকানো নিষিদ্ধ
ইসলামের দৃষ্টিতে ৬টি দিকে তাকানো নিষিদ্ধ - ছবি সংগৃহীত
চোখ আল্লাহর দান। যার নাই সে বুঝে চোখ কত বড় নেয়ামত। কারণ, চোখ ছাড়া দুনিয়া অন্ধকার। ‘বলুন, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা মূলক-২৩) চোখ বা দৃষ্টিশক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভ হতে এমন অবস্থায় নির্গত করেছেন যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা নাহল-৭৮)
চোখের কৃতজ্ঞতা আদায় হবে চোখের উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে। চোখের উত্তম ব্যবহার হলো নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকা। সৃষ্টি দেখে আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করা। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- ‘তারা কি দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কিভাবে উহা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আকাশের দিকে, কিভাবে এটিকে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পর্বতমালার দিকে, কিভাবে এটাকে স্থাপন করা হয়েছে। ভূমির দিকে, কিভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে!’ (সূরা গাশিয়া-১৭-২০) অর্থাৎ আল্লাহর কুদরত দেখে তারা শিক্ষা নিতে পারে। এভাবে আল্লাহর পরিচয় তাদের সামনে ফুটে উঠবে।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে। এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।’ (সূরা ইসরা-১০৯) নবীজী সা: বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারে না, যেমন দোহনকৃত দুধ ওলানে প্রবেশ করানো যায় না। (তিরমিজি-১৬৩৩)
চোখের অপব্যবহার হলো আল্লাহর নিদর্শন দেখেও শিক্ষা গ্রহণ না করা। আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা। চোখ দিয়ে হারাম জিনিস দেখা। বেগানা নারীকে দেখা। চোখের খেয়ানত করা। চোখের জিনা করা ইত্যাদি। ইরশাদ হয়েছে- আমিতো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তদ্বারা তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চক্ষু আছে তদ্বারা দেখে না। তাদের কর্ণ আছে তদ্বারা শ্রবণ করে না। এরা পশুর মতো। বরং ওরা পশুর থেকেও অধিক বিভ্রান্ত। ওরা গাফেল। (সূরা আরাফ-১৭৯) এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা চোখের অনুত্তম ব্যবহার অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টি দেখে আল্লাহর পরিচয় পাওয়ার পরও হকের অস্বীকারকারীকে পশুর থেকেও অধম বলেছেন।
ইবনে আব্বাস রা: চোখের খেয়ানতের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, একদল লোকের পাশ দিয়ে যখন কোনো নারী অতিক্রম করে তখন কেউ কেউ সাথিদের কাছে এমন অভিনয় করে যে, তারা মনে করে তাদের সঙ্গী বেগানা নারী থেকে দৃষ্টি অবনত রাখছে। কিন্তু যখনই সে বুঝতে পারে তার সাথিরা বেখেয়ালে আছে, তখন সে ওই নারীর দিকে তাকায়। এ জাতীয় অবৈধ গোপন দৃষ্টিগুলোই হলো চোখের খেয়ানত। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-১৭২২৮)
নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত সম্পর্কে নবীজী সা: কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ...যদি আমি জানতাম যে, তুমি আমার দিকে তাকিয়েছ তবে আমি তোমার চোখ নষ্ট করে দিতাম। দৃষ্টির খারাপি থেকে বাঁচার জন্যই তো অনুমতির বিধান দেয়া হয়েছে। (বুখারি-৬২৪১)
আরেক হাদিসে নবীজী সা. ইরশাদ করেছেন, তোমার অনুমতি ছাড়া কেউ যদি তোমার ঘরের ভেতর তাকায় আর তুমি কঙ্কর মেরে তার চোখ ফুটো করে দিয়ে থাকো, এতে তোমার কোনো দোষ হবে না। (বুখারি-৬৮৮৮)
উল্লিখিত দুটি হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, একে অপরের যেকোনো গোপনীয় বিষয়ে দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। এ হিসেবে- ১. নারী-পুরুষ পরস্পরের সতরের দিকে তাকানো নিষেধ। পুরুষের সতর নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত। নারীর সতর মাহরামদের সামনে মুখাবয়ব, হাতের কব্জি এবং পায়ের টাখনু ছাড়া বাকি দেহ। গায়রে মাহরামের সামনে পূর্ণ শরীর। ২.কারো ঘরের ভেতর সদর দরজা দিয়ে কিংবা জানালা ইত্যাদি দিয়ে দৃষ্টি দেয়া নিষেধ। ৩.কারো ব্যক্তিগত কোনো তথ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত নিষেধ। ৪. কারো মোবাইলের মেসেজ, ইনবক্স ও গেলারি ইত্যাদি দেখা নিষেধ। ৫. কারো ব্যক্তিগত কাগুজে চিঠিপত্র দেখা নিষেধ। ৬. পরীক্ষার হলে একে অপরের খাতা দেখা নিষেধ।
কুদৃষ্টির ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: এক হাদিসে বলেছেন, চোখের জিনা হলো (হারাম) দৃষ্টি। (বুখারি-৬৬১২) সুতরাং চোখের জিনা থেকে বাঁচতে হলে- ১. পুরুষের জন্য গায়রে মাহরাম নারীর দিকে তাকানো নিষেধ। নারীর জন্য গায়রে মাহরাম পুরুষের দিকে তাকানো নিষেধ। ২. গঠন-আকৃতিতে আকর্ষণীয় নাবালিকা মেয়েদের দিকে তাকানো থেকেও বিরত থাকতে হবে। ৩. দাড়িহীন কমনীয় বালকের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকেও বাঁচতে হবে।
চোখের অনুত্তম ব্যবহার থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে এক নম্বরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন (দেহের) যা সাধারণত প্রকাশ থাকে, তা ব্যতীত তাদের রূপ সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার ওড়না দ্বারা আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌনকামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের রূপ সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে ঈমানদারগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (সূরা নূর-৩০, ৩১)
দুই নম্বরে নবীজী সা: বলেছেন, হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে স্ত্রীর ভরণপোষণ ইত্যাদির সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে (হারাম) দৃষ্টি থেকে চোখকে অধিক অবনত করে এবং লজ্জাস্থানের অধিক সুরক্ষা দেয়। (বুখারি-৪৭৯৬)
জুনাইদ বাগদাদী রহ.কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, হারাম দৃষ্টি থেকে বাঁচার উপায় কী? তিনি বলেছিলেন, সর্বদা এ কথা মনে রাখা যে, তুমি হারামের দিকে দৃষ্টিপাত করার আগে আল্লাহর দৃষ্টি তোমার ওপর রয়েছে। (জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম-১/৪০৯)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম, দক্ষিণ কাজলা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা