ভূ-মধ্যসাগরে ঝড় এবং তুরস্ক-ফ্রান্স-ইসরাইল
ভূ-মধ্যসাগরে ঝড়ে তুরস্ক-ফ্রান্স-ইসরাইল - ছবি সংগৃহীত
ভূ-মধ্যসাগরে বিশেষত এর পূর্বাংশে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এক দিকে তুরস্ক ও এর মিত্র দেশগুলো আর অন্য দিকে ফ্রান্স, ইসরাইল, গ্রিস ও এর মিত্ররা বাকযুদ্ধ ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেকোনো সময় দু’পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সঙ্ঘাত শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। এটি এমন এক সময় ঘটছে যখন পৃথিবীর এই উত্তপ্ত এলাকায় কতগুলো ঘটনা ঘটে চলেছে যেটি পুরো অঞ্চলে এক ধরনের ভূমিকম্পের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মৃত্যু ও ইসরাইলের স্বীকৃতি
দুই রাষ্ট্রভিত্তিক শান্তি পরিকল্পনা তথা ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র পাশাপাশি থাকবে এবং তারা পরস্পরকে মেনে নেবে এটি ছিল আরব লীগের পক্ষ থেকে ২০০২ সালে দেয়া সৌদি যুবরাজ আবদুল্লাহর শান্তি পরিকল্পনা। আন্তর্জাতিকভাবে এই ফর্মুলাকে ভিত্তি ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা ও এর বাস্তবায়ন কাজ চলে আসছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা এই শান্তি আলোচনায় আর কোনো পক্ষ নেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টা কাম ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যেভাবে চাইছেন সেভাবেই এই বিরোধের সমাধান তৈরি করা হচ্ছে। এর অংশ হিসাবে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করা হয়েছে।
মিসর জর্দানের পথ ধরে ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছাড়াই সংযুক্ত আরব আমিরাত ইহুদি রাষ্ট্রটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। প্রাথমিকভাবে বিরোধিতা করার পরও শেষ পর্যন্ত বাহরাইন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। বাদশাহ সালমান ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দেয়ার কথা ঘোষণা করার পর ক্রাউন প্রিন্স বন্দর বিন সুলতানসহ ২৪ জন সৌদিকে ওয়ান ইলেভেনের ঘটনায় গ্রেফতার করার নির্দেশনা জারি করেছে আমেরিকান আদালত। এরপর সৌদি মনোভাব নমনীয় হচ্ছে বলে আভাস দেয়া হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে।
বলা হচ্ছে, আরো কয়েকটি মুসলিম দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলে সৌদি আরবও একই পথে হাঁটবে। বাহরাইনের পর ওমান, সুদান, মরক্কো, আলজেরিয়া এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে মর্মে বলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে এক দিকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে অন্য দিকে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রকের আসনে বসানো হচ্ছে।
ইসরাইল হলো বন্ধু আর শত্রু তুরস্ক
এসব প্রক্রিয়া যখন চলমান তখন আরব লীগের সম্মেলনে ফিলিস্তিনিদের উত্থাপিত আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির নিন্দা করে পেশ করা এক প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে পাল্টা আরব দেশগুলোতে তুরস্কের হস্তক্ষেপের বিষয় নিয়ে একটি উপকমিটি করা হয়েছে। দৃশ্যত এটি আরব ইসরাইল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি সাব কমিটির স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ আরব শাসকরা তাদের শত্রুর তালিকায় ইসরাইলকে স্থলাভিষিক্ত করল তুরস্ককে দিয়ে।
আরব রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে বাগে আনার জন্য একটি হুমকি দরকার ছিল ইসরাইল ও তার মিত্রদের। এতদিন সেই হুমকি হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল ইরানকে। নেতানিয়াহুর দক্ষিণপন্থী সরকারের সমর্থক জেরুসালেম পোস্টে এখন নতুন সুর তুলে বলা হচ্ছে ইরান এখন আর আরব দেশগুলোর জন্য হুমকি নয়। অবরোধসহ নানা ব্যবস্থা নেয়ার কারণে ইরান দুর্বল হয়ে গেছে। এখন নতুন উদীয়মান আরব শত্রু হচ্ছে তুরস্ক। ইসরাইলি পত্রিকার এই বক্তব্য এবং আরব লীগের সম্মেলনের কার্যক্রম একই ধারায় এগিয়েছে।
তুরস্ককে টার্গেট করা হয়েছিল বেশ ক’বছর আগেই। ২০১৬ সালে এর অংশ হিসেবে এরদোগানের বিরুদ্ধে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ইন্ধন জুগিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। এর পর থেকে আমিরাতের ইসরাইলপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ যেখানে তুরস্ক গিয়েছে সেখানেই হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে। লিবিয়ায় এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে কার্যত আমিরাতকে ইসরাইলের সম্প্রসারিত রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। এখন মুসলিম দেশগুলোতে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার সব ধরনের কার্যক্রম মূলত পরিচালিত হচ্ছে আরব আমিরাতের মাধ্যমে।
আমিরাতের মতো একই ভূমিকায় বাদশাহ সালমানকে নামাতে ব্যর্থ হয়ে ইসরাইল এখন নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। ওয়ান ইলেভেনের ঘটনায় যুক্ত করে ২৪ প্রভাবশালী সৌদির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ছাড়াও মিসর, জর্দান আর ইরাককে নিয়ে একটি ইসরাইলপন্থী ইউনিয়ন করে আরব নেতৃত্ব গ্রহণের হুমকিও দেয়া হয়েছে। বাদশাহ সালমানের ৩৫ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সব আয়োজন করলেও সিনিয়র সৌদি নীতি প্রণেতারা এটি চাইছেন না। ওয়ান ইলেভেনের বিচারের নামে সেই প্রতিবাদ রুদ্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাদশাহ সালমান হয় ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি মেনে নেবেন, অথবা তিনি ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় তরুণ পুত্রকে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেবেন।
ধারণা করা হয় যে, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মক্কা-মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও কাবা শরিফের প্রধান খতিব আবদুর রহমান সুদাইসকে দিয়ে জুমার খুতবায় ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষে কথা বলা হয়েছে। যে সুদাইস গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বর্বর হামলায় মজলুম গাজাবাসীর মুক্তির জন্য অশ্রুসিক্তভাবে হারাম শরিফে মোনাজাত করেছিলেন তিনি এখন জুমার খুতবায় ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন।
এতে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সৌদি সিদ্ধান্তের ওপর মোহাম্মদ বিন সালমানের অবস্থান জয়ী হতে যাচ্ছে। হয়তোবা বাদশাহ সালমান কুশনার-নেতানিয়াহুর চাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন নয়তো সালমান অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এমবিএস অধ্যায়ের সূচনা করার চেষ্টা হবে। বাদশাহ হওয়ার পর এমবিএসই সৌদি আরবে ইসরাইলের স্বীকৃতি ও উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন। কুয়েতের আমিরও কোনোভাবেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন না বলে সেখানে এমবিএসের মতো নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে।
তুরস্ককে কেন প্রতিপক্ষ করা হচ্ছে?
আরব লীগে তুরস্কের ‘আগ্রাসন’ পর্যবেক্ষণের জন্য স্থায়ী উপকমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়ার মানে হলো আরব লীগের নতুন লড়াই তুরস্কের বিরুদ্ধে। আর সেটির আয়োজন হচ্ছে ইসরাইলের ইচ্ছানুসারে।
তুরস্কের বিরুদ্ধে এসব তৎপরতার জন্য আঙ্কারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টান-জায়নিস্ট ইভাঞ্জেলিকাল জোটকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অপারেশনাল স্তরে আরব বিশ্ব থেকে তুরস্ককে বিচ্ছিন্ন করার কাজ দেয়া হয়েছে। তারা এ কাজে অর্থায়ন করে আসছে আর এই কৌশলের আসল সমর্থক হলো ইসরাইল এবং কিছু ইসরাইলপন্থী মার্কিন রাজনীতিবিদ।
২০০২ সালে সৌদি আরব কর্তৃক সূচিত আরব পিস ইনিশিয়েটিভ প্রতিষ্ঠিত শান্তির নীতিটি বজায় রাখার জন্য ইসরাইলের সাথে সাধারণীকরণের ব্যাপারে আরব লীগের পুরণো উপকমিটি এখনো বিদ্যমান। সেটিকে অকার্যকর করে তুরস্কের বিরুদ্ধে নতুন উপ কমিটি করে বার্তা দেয়া হয়েছে যে, ইসরাইল আরব লীগের শত্রু নয়; শত্রু হলো তুরস্ক। জর্দানের সরকারি মুখপত্র জর্ডান টাইমসে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, তুর্কি সেনা এবং আঙ্কারা সমর্থিত মিলিশিয়ারা তিনটি আরব দেশ : লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইরাকে সক্রিয় রয়েছে। এ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আরব বিশ্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও অবশ্যই স্বীকৃতি জানাতে হবে এবং তাতে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে একনায়কতন্ত্র ও রাজতান্ত্রিক সরকারগুলো গণতন্ত্রকে তাদের ক্ষমতার সামনে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করতে শুরু করেছে। আরব বসন্তের পর থেকে এসব দেশ ইরানের পাশাপাশি গণতন্ত্রকামী ইসলামিস্টদের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। অন্য দিকে ইসরাইল চাপ সৃষ্টি করে স্বার্থ আদায়ের জন্য কম বৈধ বা অবৈধ সরকারগুলোকে সবচেয়ে ভালো মনে করে। এ কারণে ইসরাইলের নিজস্ব শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র অনুসরণ করা হলেও চার পাশের কোনো দেশেই গণতন্ত্র চর্চা তথা জনগণের ইচ্ছায় শাসন পরিচালনার বিষয়টি তেলআবিব পছন্দ করে না। দেশটির নীতিপ্রণেতারা জানেন, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের বেশির ভাগ ইসরাইলকে জবরদখলকারী মনে করে। এ কারণে ইসরাইল ও একনায়কতান্ত্রিক শক্তিগুলোর স্বার্থ একই রেখায় মিলে যায়। এর পাশাপাশি ইউরোপের মধ্যে সব সময় একটি ভয় কাজ করে যে, তুরস্ক শক্তিমান হয়ে অটোমান উত্তরাধিকারের দিকে ফিরে যায় কিনা। এসব সমীকরণ তুরস্কের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বৈরিতার বলয় তৈরি করেছে। যার সদস্য ফ্রান্স, আমিরাত, সৌদি আরব, মিসর থেকে ইসরাইল পর্যন্ত।
ম্যাক্রনের ক্রুসেড সফল হবে?
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন হঠাৎ করে ক্রুসেডের মনোভাব নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন ভূ-মধ্যসাগরে। গাদ্দাফির যুগের সেনা জেনারেল খলিফা হাফতারকে লিবিয়ার রাজধানী দখল করার জন্য জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সহায়তা করে এসেছেন। সম্প্রতি, বৈরুত উদ্ধারের আওয়াজও তুলেছেন তিনি। রহস্যজনক বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের ঘটনার পর এমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন : ‘ফ্রান্স যদি ভূমিকা পালন না করে তবে ইরানি, তুর্কি এবং সৌদিরা লেবাননে হস্তক্ষেপ করবে, এতে লেবাননে তার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
এর মধ্যে ফরাসি যুদ্ধজাহাজগুলো সাইপ্রাসের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে গ্রিকদের সাথে যৌথ মহড়া দিচ্ছে। ম্যাক্রোন চলতি সপ্তাহে কর্সিকায় এক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের আগে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তুরস্ক আর এই অঞ্চলে অংশীদার নয়, ইউরোপীয়দের অবশ্যই এরদোগানের সরকারের ব্যাপারে ‘স্পষ্ট ও দৃঢ়’ থাকতে হবে। ইউরোপীয় দেশগুলোর তুরস্কের সাথে ‘লাল রেখা’ তৈরি করা উচিত।
ম্যাক্রন বলেছেন, তার বিরোধ তুরস্কের সাথে নয়, এরদোগানের সাথে। এই কৌশলটি আগেও গ্রহণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। সমস্যা হলো, লিবিয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া বা জেরুসালেমে ফিলিস্তিনের অধিকারকে সমর্থন করা বা ইরাকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে নিষ্ক্রিয় করা অথবা সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীকে শায়েস্তা করা- এসব পদক্ষেপে এরদোগানের নীতির প্রতি তুর্কি সেনাবাহিনী এবং প্রধান তুর্কি রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
এরদোগানের রক্ষণশীল ইসলামপন্থী ভিত্তি ভাঙার জন্য সক্রিয় একটি নতুন দলের প্রধান ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলু ম্যাক্রনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বলেছেন : ‘ম্যাক্রনকে অবশ্যই তার সীমানা মেনে চলতে হবে এবং তুরস্ক ও এর প্রেসিডেন্টকে অপমান করা বন্ধ করতে হবে। ম্যাক্রনের অহঙ্কারী বক্তব্যগুলো তার ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় দেয় এবং তুরস্কের গণতন্ত্র এবং জনগণের স্বাধীন ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে।’
এরদোগান তুরস্ককে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার সশস্ত্র বাহিনী সিরিয়া ও লিবিয়ায় রাশিয়ান বাহিনীর মুখোমুখি হতে সক্ষম, তবে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে আলোচনার টেবিলেও তিনি তার দেশের স্বার্থ রক্ষাকারী ভূমিকা রাখতে পারেন। তুরস্কের অর্থনীতি এবং এর সামরিক বাহিনী স্বাবলম্বী। ইসরাইল ও আমেরিকা সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালেও উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোন উৎপাদন শুরু করে আঙ্কারা।
তুরস্ক যখন কৃষ্ণসাগরে গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তুর্কি সংস্থাগুলোর কাছে গ্যাসক্ষেত্রগুলো বিকশিত করার এবং দেশীয় বাজারে সরবরাহ করার প্রযুক্তি রয়েছে। দেশটি মিসরের মতো ব্রিটিশ, ইতালিয়ান এবং মার্কিন সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরশীল নয়। এই নির্ভরতার অর্থ হলো, তারা গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত সম্পদের একটি বড় অংশকে কেটে নেয়।
এসব কিছুর কারণেই ফ্রান্স তুরস্কের ব্যাপারে কিছুটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে ব্লুমবার্গের মূল্যায়নটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্লুমবার্গ ম্যাক্রনের নতুন চেষ্টার ব্যাপারে বলেছে, তার জন্য দ্বিতীয় গিঁটটি কড়া নাড়ছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরের অভ্যন্তরে বিপর্যয় নিয়েই তুরস্কের ব্যাপারে বাকবিতণ্ডা আরো একবার বন্ধ করেছেন। তার বক্তব্য এরদোগানের মেরুদ- দুর্বল করছে না, আর ম্যাক্রন আর্থিক হাতিয়ার ব্যবহারের জন্য বিশ্ব ঐকমত্য গঠনের জন্য যে লড়াই করছেন, তুরস্কের পশ্চাদপসরণ ঘটানোর জন্য নৌবহর পাঠানোর মতোই তার কার্যকারিতা হবে অনেক কম। ফরাসি প্রেসিডেন্টের ভারী কথাগুলো ইতোমধ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়া থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি ভুল জায়গায় পা ফেলেছেন।
কেবল কয়েক সপ্তাহ আগে, ম্যাক্রন দাবি করেছিলেন যে ইতোমধ্যে এক বেগুনি রেখা তিনি এঁকে ফেলেছেন। আর গর্ব প্রকাশ করে বলেন, তুর্কিরা কথাকে নয়, পদক্ষেপকে সম্মান করবে। তবে এ পর্যন্ত ম্যাক্রনের অনলাইন শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যে নৌবাহিনী ওয়ার্কআউটে সহযোগিতা করা বা না করার মতো পদক্ষেপগুলো আঙ্কারায় তাকে পুরোপুরি বাড়তি উপহাসের পাত্র বানিয়েছে।
ফ্রান্স তার ন্যাটো সহযোগীদের কাছ থেকে নৌসহায়তার আশা করতে পারে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাইপ্রাসের কাছে অস্ত্রের বিক্রয় নিয়ে দীর্ঘদিনের আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিক থেকে এরদোগানের বিরোধিতা করে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা বেশি নয়। ম্যাক্রন তার কুৎসাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে এরদোগানের বিরোধিতা বজায় রাখতে পারবেন। তবে এগুলো ইতোমধ্যে নিষ্ফল হয়ে তার কাছে ফিরে আসতে শুরু করেছে। গ্রিক ও সাইপ্রিয়টরা দ্রুতই ফরাসি সংহতির অভিব্যক্তি নিয়ে ক্লান্ত বোধ করবে এবং আঙ্কারা সম্ভবত প্যারিসের সাথে অতিরিক্ত বাক্যযুদ্ধে আহ্লাদ অনুভব করবে।
মার্কেল কী করবেন?
জার্মানি বর্তমানে পালাক্রমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছে এবং চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল তুরস্ক ও গ্রিসের বিরোধ নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করছেন। যদিও ইইউ তুরস্কের বিরোধিতা করে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞাগুলোর বিষয়ে সতর্ক করেছে, তবে তিনি এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন।
মার্কেল যখন শান্তি আলোচনার কথা বলছেন তখন ম্যাক্রনের সম্পর্কচ্ছেদের জন্য তাড়াহুড়োকে সম্ভবত তিনি ভালো মনে করছেন না। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাশ স্পষ্ট করে তুলেছেন যে, নৌমহড়া ভালো কোনো ফল আনছে না। কর্সিকায় ছয়জন ইউরোপীয় নেতার উপস্থিতি সত্ত্বেও তুরস্ককে মোকাবেলা করার জন্য উৎসাহী বড় শক্তি ফ্রান্স একা। আর ম্যাক্রন নিজেই বিভিন্ন ধরনের সঙ্কটে রয়েছেন। তার নিজ দেশে করোনাভাইরাস উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি মহামারী মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছেন। তার অর্থনৈতিক প্রণোদনা পরিকল্পনাকে ১০০ বিলিয়ন ইউরোর (১১৮ বিলিয়ন ডলার) জুয়া হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়।
বিদেশেও মোকাবেলা করার জন্য ম্যাক্রনের সামনে বিভিন্ন সঙ্কট রয়েছে : ম্যাক্রন লেবাননবাসীকে তাদের রাজনীতিবিদদের কবল থেকে উদ্ধারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কয়েক মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সামনে আসবে। আর মালির রাজনৈতিক উত্থান সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্সের সন্ত্রাসবাদবিরোধী উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। লিবিয়ায় এরদোগানের সাথে তার দ্বন্দ্বটিও ম্যাক্রন ঠিকঠাক মতো চালিয়ে যেতে পারছেন না।
এই পরিস্থিতিতে, প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় বিরোধের মধ্যে তার অলঙ্কৃত অগ্নিকুণ্ডলি বহন করতে চাইছেন। আর চ্যান্সেলরের সাথে কথা বলা থেকেও তিনি দূরে রয়েছেন। সব মিলিয়ে ম্যাক্রন কতটা সফল হবেন তাতে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ন্যাটো মিত্র হিসেবে ছাড়তে চাইছে বলে মনে হয় না। জার্মানিও সমঝোতাই চাইছে। ফলে তুরস্ককে কন্টেইন করতে চাইলেই যে ইসরাইল, মিসর, আমিরাত, সৌদির মতো দেশগুলো সফল হবে এমনটি মনে হয় না।
নতুন মেরুকরণ কি আসন্ন?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ইসরাইলের প্রতি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সর্বব্যাপী চাপ সৃষ্টি করছে মুসলিম দেশগুলোর ওপর। এই চাপের কাছে অনেক আরব দেশ বেশ খানিকটা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হয় যে, বাহরাইনের পর ওমান একই পথে যেতে পারে। সৌদি আরব ও সুদানের কথা বলা হলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশ দু’টির পক্ষে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া সহজ হবে না। এর পরও সেটি ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক মেরুকরণ ঘটতে পারে।
এই মেরুকরণের একটি ফর্মুলা হামাসের দ্বিতীয় প্রধান নেতা ইরান সফরের সময় দিয়েছেন। আর তুর্কি সমর্থনপুষ্ট হামাস এবং ইরান সমর্থনপুষ্ট হিজবুল্লাহর মধ্যে সমঝোতায়ও এই মেরুকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইসরাইল উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক দেশ ও মিত্রদের নিয়ে যত চাপ বাড়াবে তুরস্ক-ইরানের মধ্যে ঐক্য ততটা বাড়বে। এর সাথে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তানসহ আফ্রো-এশিয়ায় বেশ ক’টি মুসলিম রাষ্ট্র থাকতে পারে। এটি হলে মুসলিম বিশ্ব এমনভাবে ভাগ হবে যাতে একদিকে গণতন্ত্র চর্চার দেশগুলো এবং ব্রাদারহুডের মতো জনসমর্থিত রাজনৈতিক শক্তি থাকবে অন্য দিকে ইসরাইলের নিরাপত্তা আশ্রয়ের অধীনস্থ কয়েকটি আরব দেশ এবং তাদের প্রভাব বলয়ের রাষ্ট্রগুলো থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র এই পক্ষে থাকলে পাল্টা পক্ষে রাশিয়া-চীনের অবস্থান তৈরি হতে পারে। অবশ্য ইসরাইলকে সর্বাত্মকভাবে প্রশ্রয় দেয়ার এতটা প্রান্তিক নীতি যুক্তরাষ্ট্র নাও নিতে পারে। আর সেটি হলে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার পথ থেকে আমেরিকা বিরতও থাকতে পারে।
ভোরের আলো ফুটবেই!
মধ্যপ্রাচ্যে এখন যে অমানিশা ঘনীভূত হওয়ার অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা একসময় কেটে যাবে। করোনা উত্তর সময়ে নতুন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প জয়ী হলে হয়তো কিছুটা আগ্রাসী হয়ে উঠতে চাইবেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ইসরাইলও মধ্যপ্রাচ্যে তার নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে চাইবে। কিন্তু আমেরিকার সামনে চীন-রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ যেমন অনেক বড়, তেমনিভাবে ইউরোপ তার উদ্যোগগুলোতে সেভাবে পাশে নাও থাকতে পারে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারেও তাদের অবস্থান এক নয়। জার্মানি তো নয়ই এমনকি ব্রিটেনও নানা ইস্যুতে স্বতন্ত্র অবস্থান নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আগ্রাসী অবস্থাও বেশি দিন চালাতে পারবে বলে মনে হয় না। নিজ নিজ দেশের বৈরী জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আরব সরকারগুলো ইসরাইলের সাথে একাকার হয়ে খুব বেশিদূর যেতে পারবে বলে মনে হয় না। আরবেও নতুন একটি ঢেউ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। সেটিই হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলিম বিশ্বের জন্য নতুন ভোরের আলোকরেখা।
mrkmmb@gmail.com